বাঙালি চাইলে পারে। অনেক কিছু পারে। যতই বাঙালি ভাত খেয়ে ঘুমোক, এ রাজ্যে হচ্ছে না, হবে না-র ন্যাকা কান্না লোকে যতই কাঁদুক, গান্ডেপিণ্ডে খাওয়া-কলকাতা ঘোরা-অহেতুক বকবকের জালে জীবন যতই জড়িয়ে থাকুক, বাঙালির প্রাণশক্তি চাইলে ভিতর থেকে ঘেঁটি ধরে নাড়া দিতে জানে। সেই সত্যিটাই সৃজিত মুখার্জি দেখালেন উমা-য়। আমি ইদানিং ওনার ছবি দেখে একদম তৃপ্তি পাচ্ছিলাম না। অনেক চরিত্র, গল্পের ভিতরকার গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়ে খেই হারিয়ে ফেলছিলাম। হল থেকে বেরিয়ে এসে জাতিস্মর-এর মুগ্ধতা কোথায় যেন বেঞ্চমার্ক তৈরি করে দিয়েছিল মনের ভিতর। সেই উচ্চতায় বসাতে পারছিলাম না পরবর্তী কোনও ছবিকেই। উমা দেখে মুগ্ধর চেয়ে বেশি অবাক হলাম। এ ছবির গল্প আদ্যন্ত ইমোশনের পুরিয়ার মোড়া, বাঙালির পপকর্ণের সঙ্গে নোনাজল মিশিয়ে দেওয়ার যাবতীয় উপকরণ আছে এতে। তবে গল্প ছাপিয়েও যা নাড়া দেবে তা হল আনাচে-কানাচে গুঁজে দেওয়া ধর্ম-রাজনীতির গোঁড়ামির দ্বন্দ্ব, মননের অবক্ষয়কে জয় করার জোর, বাঙালিয়ানার উদযাপন ও এ শহরের সিগনেচার পাগলামি।
যে উৎসবে শাস্ত্র-নিয়মের বেড়াজাল ডিঙিয়ে একটা গোটা জাতি সকালের ভোগ আর রাতের স্কচ সমানতালে ম্যানেজ করে, সে উৎসব যে একান্তই প্রাণের তা নিয়ে দ্বিধা থাকার কোনও জায়গা নেই। কিন্তু এত মানুষের, এত বড় শহরে অকালবোধন পরিচালনা তো চাট্টিখানি কথা নয়। ঠিক সেই জন্যই কানাডার ইভানের ক্রিসমাস দেখার প্রেক্ষাপট যখন উমাকে কলকাতার দুর্গাপুজো দেখানোর পটভূমিতে বদলে যায় তখন কলজের জোর লাগে। তার ওপর যে মেয়ে কলকাতার পুজো দেখার জন্য পাগল, তাকে তো অল্পে খুশি করা দুঃসাধ্য। ছোট্ট উমার প্রতিটা ইচ্ছেপূরণের গল্প, সিঙ্গল পেরেন্ট হিমাদ্রির লড়ে যাওয়ার গল্প, হৃতগৌরব পরিচালকের মাস্টারপিস তৈরির গল্প, এক বাঙালি ক্রিস্টান মেয়ের মা সাজতে গিয়ে মা হয়ে ওঠার গল্প, গোঁড়া আবাসিকের নিজের মধ্যের সূর অসুরের দ্বন্দ্বের গল্প তাই এগোতে এগোতে আমাদের গল্প হয়ে যায়। এই আমরা যারা সব পেয়েছি’র দেশ খুঁজতে খুঁজতে আদতে না পাওয়া আঁকড়ে ধরে ঘুমোতে যাই, কলকাতার ওপর হাজার দোষারোপ করি কিন্তু এ শহরটা ছাড়তে হবে ভাবলে আঁতকে উঠি, রাজনীতিকে তর্কে বন্দি রেখে অবহমানের বাইরে বেরোতে ভয় পাই, এ ছবি তাদের সাহস দেয়। চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় শুধুমাত্র এ শহরেই স্বপ্ন সত্যির জন্য হুজুগে মেতে ওঠা যায়, বসের কাছে নির্দ্বিধায় ছুটি চাওয়া যায়, প্রতি সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নামানো যায়, গলায় টাই ঝুলিয়ে মাখামাখি সিঁদুরে অকাল বিসর্জনে নাচা যায়, আবেগে ভেসে রাজা-উজির এক হওয়া যায়, শুধু মনের জোরে স্থান-কাল-পাত্রের হিসেব গুলিয়ে দেওয়া যায়।
উমা খুব সহজে ছোট-খাটো চোখে লাগা, অপ্রয়োজনীয় মেলোড্রামাগুলোকে ছাপিয়ে যায় গল্পের সঠিক খাতে বয়ে চলায়, মেটাফর-এর ব্যবহারে, অভিনয়ের জোরে। এ ছবির গল্প বাবা-মেয়ের হলেও, ছবির ভিতর তৈরি হতে থাকা ছবির পরিচালক কোথাও গিয়ে নায়ক হয়ে ওঠেন দর্শকের চোখে। অঞ্জন দত্ত এখানে তাঁর মনের মতোন চরিত্র পেয়েছেন এবং আবারও প্রমাণ করেছেন অভিনেতা অঞ্জনকে দর্শক বেশি ভালোবাসতে বাধ্য। সারা প্রতিটা দৃশ্যেই খুব সাবলীল। একেই নিজের বাবার সঙ্গে অভিনয়, তার ওপর চেনা জানা মানুষদের সামনে অভিনয়টা সহজভাবে করে যাওয়াটা বেশ শক্ত, সারা সেখানে ফুলমার্কস পেয়েছেন। রুদ্রনীল, সুজন, যীশু এবং স্বয়ং সৃজিত নিজেদের জায়গায় পারফেক্ট। যাঁদের কথা আলাদা করে না বললে অন্যায় হয় তাঁরা অনির্বাণ, মনোজ মিত্র ও বাবুল সুপ্রিয়। অনির্বাণ-এর থেকে চোখ সরানো যায় না, ওয়েব সিরিজের ব্যোমকেশ যে অভিনয়ে এই ইন্ডাস্ট্রির অনেককেই টেক্কা দেওয়ার দম রাখে, তার প্রমাণ প্রতিটি দৃশ্যে তিনি রেখেছেন। মনোজ মিত্রর ওই কয়েক মিনিটের সিন মনকে নাড়া দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। বাবুলকে সাধুবাদ একটি ভিন্নমতের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থেকেও এমন বাঙালিয়ানার গা ভাসানো ছবিতে অভিনয় করার জন্য। এ ছবির গানে গায়ে কাঁটা দেয়। কোনো একটা গানও অপ্রয়োজনীয় মনে হয়নি। অনুপম রায় আর নীল দত্ত যেন নিজেদের ভেঙেচুরে আমবাঙালিকে জেগে ঘুমানো থেকে এক ধাক্কায় জাগিয়ে দিয়েছেন, এক সুরে বেঁধেছেন।
উমা আদতে একটা বহুদিন ধরে দেখা স্বপ্নপূরণের গল্প। একটা সংঘবদ্ধ হওয়ার গল্প। নতুন কিছু, বদলে দেওয়ার মতো কিছু করার জন্য বন্ধু হয়ে ওঠার গল্প। এ ছবি দেখে মনে হয়, যুদ্ধসাজ সেজে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ালে হয়তো আমরা পারব। আমাদের আমিগুলোকে একজোট করে আলস্য ভেঙে জেগে উঠতে পারব। মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা আমাদের ভেঙে দিতে চাওয়া অশুভ শক্তিগুলোকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য আমাদের ভিতরের ‘উমা’কে জাগাতে পারব। বাঙালির এই স্বপ্নটা পূরণ হবার অপেক্ষার পায়ের তলায় সর্ষে বেঁধে দেয় উমা। বলে যায়, “তুমি চোখ বুঁজো না, আমি এলাম বলে…”।