2020। এমন বছর যা চলে গিয়েও মনে থেকে যাবে সব্বার। এমন বছর যা কেটে যাওয়ার অপেক্ষায় আমরা দিন গুনছি সেই কবে থেকেই। এমন বছর যার পাওনা-গন্ডার হিসেব মেলানো যাবে না কোনওদিন। সেই বছরের শেষ দিন আজ, যেমনই হোক, ডিসেম্বরের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে অভ্যাসবশতই ফিরে তাকাই, দেখতে পাই শুধু একটা অসুখ বা একটা ঝড় নয়, আরও অনেক কিছুর জন্যই এ বছরটার ইতিহাস লিখে রাখার প্রয়োজন আছে।
মার্চ-এর মাঝামাঝি থেকে বাড়িতে। কর্মক্ষেত্রে সময়ের হিসেব-নিকেশ উল্টে গেছে কয়েক মাসেই। কাজের ফাঁকে বাসন মাজা, ঘর গোছানো যেমন হয়েছে, রাত 10 টার পরে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে থাকা, 11 টায় ক্লায়েন্ট মিটিং-ও স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছর ঘুরে যাবে, এই অভ্যেস যাবে কিনা চিন্তায় আছি।
একা একা থাকতে থাকতে সেটাও অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আশে পাশে বেশিক্ষণ লোকজনের আওয়াজ ভালো লাগে না। হাটের মাঝে বসে কাজ করতে পারা মানুষের কাছে ‘কথায় কান দিলে কাজে মন বসে না’ ধ্রুব সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। একা থাকার আনন্দও খুঁজে পেয়েছি। নিজের সঙ্গে কাটানো সময়ের প্রয়োজনিয়তা বুঝেছি।
রান্নাবান্না, গার্ডেনিং-এর মতো হবি-র রমরমা যখন সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে, প্রয়োজনের স্বার্থে সেইসব স্কিল আমাকেও বাড়াতে হয়েছে। ডালগোনা না শিখলেও ডাল রান্না শিখে নিয়েছি লকডাউন-এ। সঙ্গে কিছু অফবিট বা এক্সপেরিমেন্টাল-ও। গাছ-ফুল দেখতে চিরকালই ভাল লাগতো। মামার বাড়ি, নিজের বাড়ির ছাদেও বাগানের ফুলের দিকে তাকিয়ে কত দুপুর, বিকেল কাটিয়েছি। কিন্তু আমার দ্বারা ওসব হবে না-এই চিন্তাধারা নিয়েই এক কামরার ফ্ল্যাটে এসে একটা গাছও আনা হয়নি বিগত 5 বছরে। 2020-তে সেটা হল। বান্ধবীদের উৎসাহে, নিজের তাগিদে। এখন সাজানো বাগানে গাছেদের সঙ্গে আত্মীয়তা হয়েছে। পরিচর্যার চেয়ে যদিও চেয়ে থাকাতেই মনের শরীর ভালো থাকে বেশি।
যতই বাড়ির লোকজন চোখের সামনে থাকুক সবসময়, বিছানা আর বালিশের চেয়ে কাছের সঙ্গী আর কেউ হয় না তাও বুঝেছি এ বছর। বালিশে তুলো ভরাতে হয়েছে ল্যাদ-এর জেরে। মন ভালো রাখতে বাড়ি সেজেছে নতুন নতুন সাজে। ঘরে থাকার সুবাদে বেডরুম-এর দেওয়ালে টিভি এসেছে। এখন মোবাইলে নেটফ্লিক্স দেখতে অসুবিধে হয় বেজায়।
এ বছরটা কে আপন, কে পর, বুঝে নেওয়ার জন্য আদর্শ ছিল। কারা সব সময়ের জন্য আছে, কাদের না পেলে চলবে না সেসব জলের মতো পরিস্কার হয়ে গেছে। দূরে সরে যাওয়া কিছু মানুষ আবার কাছের হয়েছে, আর কিছু জনকে দূরে সরিয়ে দেওয়া শ্রেয় হয়েছে। আর কিছু তো কনস্ট্যান্ট থাকেই, তারা থেকে যাবে এই আশাও থাকে।
যদিও কিছু কনস্ট্যান্ট এ বছরটাতেই হারিয়ে গেছে। ছেলেবেলাটা ঝোলায় পুড়ে নিয়ে চলে গেছে ঠাকুমা। প্রথম বুঝেছি কাছের মানুষকে হারানোর দুঃখর চেয়ে বড় কিছু হয় না। ছোট থাকতে চাওয়ার সিনেমা আর বড় হয়ে যাওয়ার সিনেমার প্রিয় দুই নায়কও এ বছরই চলে গেছেন… নায়ক-নায়িকা নিয়ে আমার অতো মাথাব্যথা নেই কিন্তু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বা ইরফান খান-এর মতো মানুষরা পর্দা থেকে কখন যে জীবনের নায়ক হয়ে গেছেন, অজান্তেই। এ বছর জীবনের চেয়ে মৃত্যুর খবর এসেছে বেশি। বছরের শেষ তারিখটাও তার ব্যতিক্রম নয়।
লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং শব্দগুলো সব সময়ের সঙ্গী হয়েছে। পজিটিভ থাকার রোজকার চেষ্টাতেও নেগেটিভিটি জড়িয়ে গেছে। লকডাউন উঠে গেলেও ভয় আরও বেশি করে জাঁকিয়ে বসেছে। সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং প্র্যাকটিস করতে করতে বেশি লোক দেখলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়াটা অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে। উচিত অনুচিত-এর টানাপোড়েনই কেটেছে বছরের অনেকটা সময়। কিছুদিন একটু সাহস সঞ্চয় করতে পারলেও ভয়ের কাছেই হার মেনেছি বেশি।
গোটা বছরটা জুড়ে অনেক না এসে জড়ো হয়েছে জীবনে। বেড়াতে না যাওয়া, পাশের বাড়ি না যাওয়া, খেতে না যাওয়া, পুজো দেখতে না যাওয়া, বিয়েবাড়ি না যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা না হওয়া, দেখা হলেও জড়িয়ে না ধরা, হাত না ধুয়ে কিছুই না করা, মাস্ক না খোলা, লিখতে ভালো না লাগা, পড়তে ভালো না লাগাগুলো ঘিরে ধরেছে রোজ। এক এক দিন নিজেকে ঘাড় ধরে বসিয়েও দু-চার শব্দের আঁকিবুঁকি ছাড়া বেশিদূর এগোতে পারিনি। তবু কিছু প্রিয় বই, প্রিয় সিরিজ ভালোলাগার প্রলেপ দিয়েছে না পাওয়া-এ।
যেমনই যাক এ বছরটা শিখিয়েছে অনেককিছু। নিজেকে ছাড়াও ভালোবাসার অনেককিছু আছে তা বুঝিয়েছে। বুঝিয়েছে আমি অনেকের চেয়ে অনেক বেশি ভাগ্যবান। শিখিয়েছে কিছু জিনিস ছেড়ে দিতে হয়, আটকে রাখতে চাইলেও উপায় থাকে না। খুব মন খারাপের মাঝেও আশাবাদী হতে শিখিয়েছে। ঘুরে দাঁড়াতে শিখিয়েছে। আর শিখিয়েছে যতই মানুষ বলে নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাবি, আমাদের জীবন আসলে খুব ঠুনকো।
নতুন বছর নিয়ে খুব আশায় বুক বাঁধিনি। কারণ, একটা রাতে কিছুই বদলাবার না। তার চেয়ে বরং হারিয়ে ফেলা জোড়গুলো 2021-এ নিজের তালেই ধীরে সুস্থে ফিরুক। 2020-র শিক্ষাগুলো পথ দেখাক। বাকি যা হবে সময় বলুক।