সে অনেকদিন হল মন ভালো নেই। দিনগুলো তবু চলে যাচ্ছে নিজের নিয়মে। আমার পৃথিবীটা ছোট হয়ে যাচ্ছে রোজ। মাঝে মাঝে মনে হয় ঘরের দেয়ালগুলো বুঝি আরও কাছে সরে আসছে। সেই ঘুম থেকে উঠে থেকে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত রোজের রুটিন এক, এলোমেলো হয়ে যাওয়ার কোনো উপায়ই নেই। হিসেবী মনটাও আজকাল চায় একটু বেহিসাব হোক, কিন্তু হয় কই!
সে অনেকদিন হল মন ভালো নেই। এতো দুঃসংবাদ, আলো থাকা সত্বেও এতো অন্ধকারে মন ভালো থাকার কথাও না। অনেক চেষ্টা করেও কিছুই গুছিয়ে উঠতে পারছিনা তাই। জানলার বাইরে তাকিয়ে নতুন কিছু খোঁজার চেষ্টা করে করে সেই কবেই ক্লান্ত হয়ে গেছি। গতবছর ভেবেছিলাম সব বুঝি পাল্টে যাবে সময়ের সাথে, আশা খুঁজেছি ভীষণ নিরাশায়ও, কিন্তু এখন সে সবেও ল্যাগ করছি। কোনো আত্মীয়, বন্ধু দুঃখের খবর বা মন খারাপ নিয়ে ফোন করলে তাকে মুখে আশার কথা শোনানোর চেষ্টা করি খুব, তবে বুঝতে পারি নিজের মুখের কথা নিজের মনই মানছে না। ভাগ্যিস ফোনের ওপারের মানুষটা আমার মুখ দেখতে পায় না। না হলে নির্ঘাৎ ধরা পড়ে যেতাম!
সে অনেকদিন হল মন ভালো নেই। বাবা মা কে দেখিনা কতদিন। কতদিন মায়ের রান্না চেটেপুটে খাই না। বাবাকে বারণ করি বাজার যেতে, বাবা কথা শোনে বলেই মনে হয়, কিন্তু তবু আমার ভয় যায় না। বেশি রাতে বাবার ফোন এলে কাঁপা হাতে তুলি। ওদের দোষ দিই কেমন করে, কারও মন কেমন কি আর সময় মেনে হয়?
সে অনেকদিন হল মন ভালো নেই। কলকাতা ঘুরে দেখি না কতদিন। হলুদ ট্যাক্সি চড়ি না, ফুটপাত ধরে হাঁটি না। বৃষ্টিদিনে অফিসের সামনের জল থৈ থৈ যে রাস্তা ভীষণ অপছন্দের ছিল, সেটাও মিস করি আজকাল। প্রিন্সেপ ঘাট, ময়দান, ভিক্টোরিয়ার সামনে সার সার দাঁড়িয়ে থাকা ঘোড়ার গাড়ি, বাগবাজারের গলি- তস্য গলি, হগ মার্কেটের সামনেটা, সবকিছু কেমন পিছু ডাকে। সামনে এগোলে কি ওদের সঙ্গে দেখা হবে না আর? ভয় হয়।
সে অনেকদিন হল মন ভালো নেই। বিকেলে মন খারাপ কাটাতে টুক করে সল্টলেক চলে গিয়ে পছন্দের জায়গায় ফুচকা খাওয়া নেই, বা বাপিদার মোমো নেই। রাস্তার দোকানে দাঁড়িয়ে রোল, আলুর চপ, ঝালমুড়ি, মালাই চা, সব চুকে বুকে গেছে। অফিসের বাইরের বাদাম মাখাওলা, ঠেলা নিয়ে ঘোরা আচারওলা, রাস্তায় হঠাৎ দেখতে পাওয়া ঘটিগরমওলা, ওদের মুখগুলো আর খুঁজে পাবো কি কখনো? টিভিতে চলতে থাকা সিরিজ এ কেউ রেস্টুরেন্ট- এ বসে খেলে, পপসিকল চুষলে রাগ হয় এখন। কিজানি যদি সব ঠিকও হয়ে যায় এভাবে আর খেতে পারার সাহস পাবো কিনা কখনো!
সে অনেকদিন হল মন ভালো নেই। লিখতে পারি না আজকাল, কাজের বাইরে কিছুই লেখা হয় না। অনেক বন্ধুরা জিজ্ঞেস করে, জানতে চায় লিখি না কেন….উত্তর পাই না। মন ভালো লা থাকলে তো লেখা আসে না। অনেক শব্দ ছুটে বেড়ায় মাথার ভিতর কিন্তু আটকে থাকে, বেরিয়ে আসতে চায় না। সমঝোতা করি নিজের সঙ্গে, সব থেমে গেলে কলমে আবার কথা বলবে তো, কে জানে!
সে অনেকদিন হল মন ভালো নেই। জীবন থেকে বাদ পড়তে পড়তে কতকিছুই আর কোনদিনও ছিল বলেই ভুলতে বসেছি। বন্ধুদের বিপদেও পাশে থাকতে পারব কিনা ভেবেও অসহায় লাগে। এভাবে তো বাঁচতে শিখিনি আমরা, কিন্তু পরিস্হিতি কেমন স্বার্থপর করে দিচ্ছে প্রতিদিন।
মন ভালো নেই, মন ভালো নেই। যে ভিড়ে মিশে থাকতে ভালো লাগতো এতদিন, সেই ভিড় দেখলেই আঁতকে উঠি। ঠাকুর দেখার লাইন, প্রতিবাদী মিছিল, হাওড়া স্টেশনের সাবওয়ের ভিড় স্বপ্নের ভিতর হানা দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। আবার কখনো দেখি শুনশান পথে একা দাঁড়িয়ে আছি, কেউ কোত্থাও নেই, কোনো শব্দ নেই, সবাই চুপ। জেগে উঠে খুব গড়িয়াহাট দেখতে ইচ্ছে করে, কিংবা ধর্মতলা, শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড়, হকারদের ডাক, গাড়ির হর্ন, কন্ডাকটর-এর চিৎকার, হাওড়ার বাস টার্মিনাসে ধাক্কাধাক্কি, শিয়ালদহ স্টেশনে ট্রেন ঢোকার হুড়োহুড়ি এই সব কিছু যা আনন্দের থেকে বিরক্তি দিয়েছে বেশি, সে সবকিছুর ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করে ভীষণ। জানি না, সেভাবে আর নিজের সঙ্গে দেখা হবে কিনা…তবু তো আশা বাঁচে, ধিকি ধিকি বুকের ভিতর…।
“চোখ খোলা তবু চোখ বুজে আছি কেউ তা দেখেনি
প্রতিদিন কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়
আশায় আশায় আশায় আশায়।”
(প্রিয় কবির কাছে আমার অনেক ধার, সেই ধার নেওয়া শেষ হবে না কোনোদিন।)