সে এক দিন ছিল। আকাশে ঘুড়ির ঝাঁক ছিল, ভোকাট্টা-র ডাক ছিল, সন্ধে হলেই পিঠে-পুলির স্বাদ ছিল। মকর সংক্রান্তি তখন একটা গোটা দিনের উৎসব ছিল।
ছোটবেলায় মকর সংক্রান্তির আগের রাতে বন্ধ জানলার সামনে কম্বল ঝুলিয়ে দিতাম। যাতে সকালবেলা পাশের ছাদ থেকে চিৎকারের চোটে ঘুম না ভেঙে যায়। খালি গলায় না, একেবারে বক্স বাজিয়ে, মাইক এনে ছিল “ভোকাট্টা” বলার রেওয়াজ। আর এই উৎসব শুরু হয়ে যেত সকাল 6 টা থেকেই। আশেপাশের যে বাড়িতেই ছেলে-পুলে আছে, বন্ধুদের দল এনে তারা ছাদে জমিয়ে ঘুড়ি উৎসব করতো। সূর্যের আলো ফোটা থেকে আলো না নেভা পর্যন্ত! ছাদ থেকে ছাদে মাইকে এর ওর নাম ধরে ধরে খুনসুটি, পিছনে লাগার চল ছিল খুব। আমাদের বাড়িতে আমাদের জেনারেশন-এ ছেলে নেই, আর বাবা-কাকুরা কাজে ব্যস্ত থাকতো সকলেই। তাই ফাঁকা ছাদ থেকে এদিক-ওদিক দেখেই আমাদের দুপুর গড়িয়ে বিকেল হত। যে ছাদ থেকে ভোকাট্টা-র আওয়াজ বেশি, মনে মনে তাদের সঙ্গে দল গড়তাম।
স্কুলে পড়ার সময় এ দিনটায় ছুটি থাকতো, কিন্তু পড়াশোনা করার জো ছিল না। পড়তে বসতে হলেও কান খাড়া থাকতো বাইরের দিকে। কে কাকে ডাকছে, কোন ছাদ বেশি ঘুড়ি কাটছে, সেসবে খেয়াল রাখাতেই ছিল বেশি মন। তাও সকালটা বই নিয়ে কিছুক্ষণ কাটিয়ে তাড়াতাড়ি স্নান খাওয়া সেরে ছাদে উঠে পড়াই ছিল দস্তুর। তিন তলা বাড়ি, ছাদ থেকে বহুদূর দেখা যেত। আকাশের নীল ঢেকে যেত হাজার রঙে। সব বাড়ির মাথার ভিড়। মা-কাকীমারাও সব দুপুরের কাজ গুছিয়ে ছাদে এসে পড়ত, ছাদ থেকে ছাদ গল্প জমতো খুব। আমরা ছোটরা মেতে থাকতাম আকাশ নিয়েই। আমাদের ছাদের ওপর দিয়ে দূর থেকে ভেসে আসা ঘুড়ির সুতো গেলেই তা টেনে ধরতাম। সেই ঘুড়ি ধরায় ছিল দেদার মজা।
শীতের রোদ লাগতো চোখে মুখে, ছাদে গরম হতে দেওয়া লেপ-কাঁথা, বালিশে ঠেস দিয়ে বসতাম, বোনরাও থাকতো, কমলালেবুর খোসা জমাতে জমাতে ঘুড়ি গোনার বৃথা চেষ্টা করতাম, প্যাঁচ দেখতাম, কাটাকুটি খেলা দেখে হাততালি দিয়ে উঠতাম, চারিদিকে ‘ভো-কাট্টা’-র হুল্লোড়ে তখন ছুঁয়ে দিত আমাদেরও। আমরা ঘুড়ি ওড়াতে শিখিনি, চেষ্টাই করিনি কখনও। কিন্তু যে ছেলেকে পছন্দ নয় তার ঘুড়ির সুতো ছাদের ওপর এলে চুপি চুপি ছাদের খসখসে দেওয়ালে ঘষে সুতো কেটে দিয়ে ট্যাঙ্কের পিছনে লুকিয়ে পড়ে খুব মজা পেয়েছি, কখনো লুকিয়ে থেকে সুতো টেনে ধরে রেখেছি। কোনও বছর পাড়ারই দু-একজন দাদা কিংবা কাকিমণির ভাইরা ঘুড়ি লাটাই নিয়ে হাজির হয়ে যেত আমাদের ছাদে। সেই বছরগুলোয় মজা ডবল। আমরা বোনেরা হতাম লাটাই বাহক, আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে গুলিয়ে ফেলতাম কোন ঘুড়িগুলো আমাদের ছাদ থেকে উড়ছে! পেটকাটি, চাদিয়াল, বগগা চিনতে শেখা তখনই।
আমাদের পাড়ায় যেহেতু ঘুড়ি ওড়ানোটা রীতিমতো একটা উৎসব ছিল তাই এর প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত অনেক আগে থেকেই। দাদারা হামানদিস্তা-এ ভাঙা কাঁচ গুঁড়ো করতো। তারপর সেই কাঁচ মিশিয়ে তৈরি হত রং। আমাদের বাড়ির সামনে খুঁটি পুঁতে সুতো বেঁধে দেওয়া হত মাঞ্জা। কার মাঞ্জায় কত জোর তা দেখানোরও একটা প্রতিযোগিতা ছিল সবার মধ্যে। পাড়ার গলিতে গলিতে সংক্রান্তির সপ্তাহখানেক আগে থেকেই এই দৃশ্য দেখা যেত প্রতিবার। সেই সুতোয় এতো ধার হতো, কতবার হাত কেটেছে হিসেবই নেই।
সংক্রান্তিতে আকাশে ঘুড়ি দেখার যেমন উৎসাহ ছিল তেমন ছিল পিঠে খাওয়ার। আমাদের বাড়িতে সংক্রান্তির আগের দিন বছরের প্রথম পিঠে হত। গুড় আসতো কলসিতে। আশকে পিঠে বানানোর জন্য আসত মাটির পাত্র। উনুনে সেই মাটির পাত্র গরম করে তাতে তৈরি হত পিঠে। আশকে পিঠে খেজুর গুড় আর গরম দুধে দিয়ে খেতে দারুন লাগত। আমাদের বাড়িতে নানান রকম পিঠে হত ওই সপ্তাহটা টানা! সিদ্ধ পিঠেরও ছিল নানান ভ্যারিয়েশন। কোনোটায় নারকেল কোরার পুর, কোনোটায় গুড়ের পাক দেওয়া নারকেল-এর পুর, কোনোটায় আবার ঝাল ঝাল তরকারির পুর। এর সঙ্গে ছিল নারকেল আর ক্ষীরের পাটিসাপটা, সরুচাকলি, রস বড়া, দুধ পুলি, রস পুলি, নলেন গুড়ের পায়েস, রাঙালুর পিঠে, ভাজা পিঠে, কত্ত কি! রাতে পিঠে খেয়েই সেরে ফেলতাম ডিনার। মা-কাকিমারা পিঠে গড়ত আর নাম্মা বিশেষ কায়দায় সেগুলো সিদ্ধ করত। আর আমরা পড়াশোনায় জলাঞ্জলি দিয়ে সেই যজ্ঞ দেখতাম।সবাই মিলে গল্প-আড্ডায় জমে যেত খাওয়া-দাওয়া।
তারপর কবে যেন বড় হয়ে গেলাম। আমাদের বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আশে-পাশের বাড়ির দাদারাও চাকরি বাকরিতে ব্যস্ত হয়ে গেল। বক্স-মাইক সরে গেল সংক্রান্তির ছাদগুলো থেকে। ঘুড়ি থাকল, কিন্তু আকাশ ঢাকল না। আমারও কলেজ জীবন থেকে এইদিনটার ছুটিটা বাতিল হয়ে গেল। আকাশ দেখাও কমে এল তাই। পিঠের ভ্যারিয়েশনও কমে গেল। ‘আছে’ গুলো নিমেষে ‘ছিল’ হয়ে গেল।
বিয়ে হয়ে কলকাতার যে পাড়ায় এসেছি সেখানে প্রায় সবই ফ্ল্যাট বাড়ি। সংক্রান্তির বিশেষ কোনও উৎসব নেই। কতিপয় ঘুড়ি ইতিউতি ওড়ে কখনও সখনও। তবে সংক্রান্তির দিন এ বাড়িতেও আমার পছন্দের পাটিসাপটা, দুধ পুলি হয়। মার কাছে এই দিনটায় যাওয়া না হলেও মায়ের মতো যত্ন করে পিঠে খাওয়ানোর মানুষ আমার আছে। সেই পিঠেতে বাড়ির গন্ধ খোঁজার ভীষণ তাগিদটাও আছে। কিন্তু পার্বণটা আর আগের মতোন নেই। মা-নাম্মার হাতের পিঠে মিস করাটা আছে। কিন্তু শ্রীরামপুরের বাড়িতে নাম্মা আর নেই।
ওই যে শুরুতে বলেছিলাম, সে এক দিন ছিল। আকাশে ঘুড়ির ঝাঁক ছিল, ভোকাট্টা-র ডাক ছিল, সন্ধে হলেই পিঠে-পুলির স্বাদ ছিল। মকর সংক্রান্তি একটা গোটা দিনের উৎসব ছিল, এখন শুধু নিয়মরক্ষা হয়ে গেছে।
(ছবিটা ধার করা দিদিভাই-এর থেকে)