কলকাতাকে,
তুমি আমার প্রথম সব কিছু না জানলেও তোমায় আমার শহর বলে ডাকতে গর্ব হয় খুব। গর্ব হয় শহরতলিতে জন্মেও তোমার অলি-গলির সঙ্গে সখ্যতার গল্প গলা ফাটিয়ে বলতে। গর্ব হয় তোমায় নিয়ে লেখা সব গানে বা কবিতা আওড়ানোয়। গর্ব হয় ‘কলকাতায় থাকি’ বলতে পারায়। তোমার সুনাম শুনলে এমনিই ঠোঁটে হাসি খেলে যায়, মন ভালো হয়ে যায় এই মেঘলা দিনে, একলাতেও।
তোমার সঙ্গে আমার প্রথম দেখার স্মৃতি তেমন স্পষ্ট না। তবে মনে পড়ে চিড়িয়াখানায় প্রথম বাঘ দেখে বাবার আঙুল চেপে ধরা, ট্রেনে চেপে এসে হাওড়া স্টেশনে নামার আনন্দ। কোলে চড়ে কলকাতা দেখা। আর একটু বড় হতে ছুটি পেলেই পিসিমনির বাড়ি। বাস থেকে রাজভবন, ধর্মতলার ভিড় দেখা। ফেরিওয়ালা, রাতের নিয়ন, হোর্ডিং-এ নতুন নাম চেনা। দাদার সঙ্গে সাইকেলে চড়ে চষে ফেলা খিদিরপুর। ডক, জাহাজ দেখা। কাঠফাটা দুপুরে জাদুঘরের ঠান্ডা। ময়দানে ট্রাম, ভিক্টোরিয়ার সিংহদ্বার, পাতাল রেল, তারামণ্ডলের 3D শো। কিন্তু সে চেনায় ভালোবাসার চেয়ে বিস্ময় বেশি। টানের চেয়ে জানার তাগিদ বেশি।
তোমায় নিজের মতো করে পাওয়া বাড়িতে লুকিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসায়। একলা পথ হাঁটায়। বাস থেকে ভুল স্টপে নেমে পরে শহীদ মিনারের মাথা দেখে দেখে কাদায় পা ডুবিয়ে রাস্তা খোঁজায়। হগ মার্কেটের ভিতরে একই পথ চার বার ঘুরে অবশেষে মনে করে রাখা দোকানের নাম খুঁজে পাওয়ায়। তোমায় পাওয়া ফুটপাথে দর দামে, লেবু জলে। মেট্রো সিনেমার সামনে অপেক্ষায়। বাসের জানালায়। গড়িয়াহাটে দু’হাত ভর্তি ব্যাগ নিয়ে কম্পিটিশনে জিতে গিয়ে ট্যাক্সি ধরায়। প্রথম প্রিন্সেপ ঘাটে, ঘটিগরমে, নৌকাবিহারে। সেড না পেয়ে ভিজে যাওয়া বইপাড়ায়। নন্দনে লেবু-চা-এ, একাডেমির নাটকে।
আমার মতো শহরতলির ভীতু মানুষদের তুমি সাহসীও করেছ অনেক। বার বার হারিয়ে গিয়েও মাথার মধ্যে তোমায় মনে রাখার নানান ছক কষেছি। শ্যামবাজারে নেতাজীর হাত কোন দিকে তা দেখে পাঁচ মাথার কোন মোড়টা থেকে বাড়ি ফেরার বাস পাব, বা বাস থেকে নেমে শিয়ালদহ স্টেশনে ঢুকতে মার্কেটের ঠিক কোন গলিটা দিয়ে শর্টকাট হবে, কিংবা কে সি দাস দেখতে পেয়ে গেলেই বুকের ঢুকপুকুনিটা কেমন কমে যাবে, বইপাড়ায় কোন গলিটায় গেলে প্যারামাউন্ট আর কোনটায় কফিহাউস- থাম, দোকানের নাম, দেওয়ালের রং এসবের হিসেব রেখে মনে রাখার নিজস্ব থিওরি তোমার ওপর ভরসা করেই শেখা। আজ আমার চেয়ে অনেক বেশি তোমায় চেনা লোকের সঙ্গে থেকেও, নিজের অজান্তেই সেইসব হিসেব মনের মধ্যে কষে চলি। তোমায় নিজের মতো করে পাওয়ার লোভে।
আমার খুঁটিটা যখন উপরে এনে পাকাপোক্ত তোমার কাছে পুঁতলাম তার অনেক আগে থেকেই আমি তোমার হয়েছি। সেই ইউনিভার্সিটির সময় থেকে। সিনেমাহলে, চেনা অচেনা রাস্তায়, ট্রামলাইনে, টানা রিকশায়, এক্কাগাড়িতে তুমি বেঁধে ফেলেছো আমায় আষ্টে-পিষ্টে। শব্দে, সুরে, কোলাহলে, হট্টগোলে তুমি রোজ নতুন করে ধরা দিয়েছ। এসপ্লেনেড-এর শপিং-এ, কুমোরটুলির অবাক বিস্ময়ে, বাগবাজার ঘাটের রোজনামচায়, পার্কস্ট্রিট-এর নিয়নে, লেকগার্ডেন্স-এর ছায়া ছায়া পথে, কলেজ স্ট্রিটের জ্যামে, সল্টলেকের ভুলভুলাইয়ায় তুমি জড়িয়ে গেছ আমার ভিতর-বাহিরে। সময় এগিয়েছে, বেড়েছে তোমার প্রতি টান। বেড়াতে যাওয়ার আনন্দের চেয়ে তোমার কাছে ফেরার আনন্দ তাই বড় হয়ে গেছে বার বার।
অনেকের মতোই তোমার এ বছরের জন্মদিনটা অন্যরকম। কোলাহল নেই, ময়দানে ক্রিকেট নেই, রাস্তায় যানজট নেই, নিউমার্কেট ভিড় নেই, নাহুমস-এ কেক-এর লাইন নেই, ফুটপাথে এগরোল বা বিরিয়ানীর ভিড় নেই, ইউনিভার্সিটি ফাঁকা, কফিহাউস ফাঁকা…ফাঁকা হাওড়া ব্রিজ, ফাঁকা ট্রামলাইন…ফাঁকা মনের ভিতরটাও।
কিন্তু তোমার প্রতি ভালোবাসায় ফাঁক নেই এতটুকুও। বিশ্বাস রাখি, তুমি সেরে উঠবে তাড়াতাড়ি। সেরে উঠব আমরাও। আমাদের আবার দেখা হবে, আগের মতোন।
– আমি