লাটাগুরি থেকে পাত্তারি গুটিয়ে আমরা রওনা দিয়েছিলাম ঝালং এর পথে। ঝালং উত্তরবঙ্গ ভ্রমণকারীদের কাছে পরিচিত নাম। মূর্তি বেড়াতে গেলে অনেকেই ঝালং, বিন্দু, সামসিং, সানতালেখোলা ডে ট্রিপ করেন। আমিও গিয়েছি আগে ঝালং ছাড়া বাকি জায়গাগুলোয়। সে বছর বছর চারেক আগের কথা, তখন কোনও কারণে ঝালং রিভার ক্যাম্প বন্ধ থাকায় সে জায়গা আমাদের তালিকা থেকে বাদ গিয়েছিল। কিন্তু এবার ঝালং এ থাকার সুযোগ ছাড়িনি মোটেই। চারটে এসি কটেজ ই বুক করে নেওয়া হয়েছিল আমাদের দলের নামে।
ভুটান বর্ডারের কাছে অবস্থিত পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা নদীর ধারে গড়ে ওঠা সাজানো গোছানো রিসর্ট ঝালং রিভার ক্যাম্প, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বন দপ্তর দ্বারা পরিচালিত। সুন্দর এই ভ্যালিতে বয়ে চলেছে জলঢাকা নদী, নদীর ওপর বড় বড় বোল্ডার, নদীর দুদিকে পাহাড়, জঙ্গল। সেই পাহাড়ের গা বেয়ে হাঁটা পথ উঠে গেছে আরও ওপরে কোথাও। নদীর ধারে ধারে তৈরি হয়েছে গোটা ছয়েক কটেজ। ৪ টি এসি, দুটি নন এসি। আগে ঝালং এ পাকাপোক্ত কটেজ ছিল না। নদীর ধার বরাবর ছিল টেন্ট। সেখানেই ট্যুরিস্টরা ক্যাম্পিং করত। বছর দুয়েক হল টেন্ট সরিয়ে পাকাপোক্ত কটেজ হয়েছে। প্রতিটি কটেজ থেকেই জানলার পর্দা সরালে দেখা যায় জলঢাকার শান্ত নিবিড় বয়ে চলা, সামনের পাহাড়, নীল আকাশ, মেঘেদের আনাগোনা। ইচ্ছে হলেই নেমে পড়া যায় জলে। কিংবা বোল্ডার এ বসে জলে পা ডুবিয়ে দেখে নেওয়া যায় নতুন একটা সূর্যোদয় বা সন্ধ্যে নামা। আমাদের মতো কংক্রিটের জঙ্গলে থাকা মানুষদের কাছে এসব দিন পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা মতো। সেসব অনুভব আমরা হারিয়ে যেতে দিই না, আগলে রাখি।
আমাদের গাড়ি লাটাগুড়ি থেকে জঙ্গলের রাস্তা ধরে মূর্তি হয়ে ধরে নিয়েছিল পাহাড়ি পথ। সে রাস্তাতেও দুদিকে জঙ্গল। গাড়ি ঘুরে ঘুরে উঠছিল উপরে। মাঝে মাঝে জীব জন্তুদের করিডোর, রাবার প্ল্যান্টেশন,আবার জনবসতি এলাকায় রঙচঙে বাড়ির আঙিনা জুড়ে নানান ফুল। যেমন তাদের রং, তেমনই রূপ। শীতের ডুয়ার্স, কালিম্পং এ এটাই মজা, এতো সুন্দর সব ফুল দেখা যায়, চোখ ফেরানো দায়। উপরে উঠতে উঠতে একটা ভিউ পয়েন্ট এ গাড়ি দাঁড়ায়। সেখানে মেঘের কোলে পাহাড়, পাহাড়ের গা জুড়ে সবুজ, নিচে তাকালে দেখা যায় ক্ষুদে গাছপালা, বাড়িঘরের পাশ দিয়ে জলঢাকার বয়ে চলা। শান্ত নদীর তীরে আঁকা ছবিটির মতো যেন।
এ জায়গা থেকে আর মিনিট চল্লিশের মধ্যেই ঝালং। গাড়ি পাহাড়ি পথ, দোকানপাট, জনবসতি পেরিয়ে ছুটে চলল সেদিকেই। যখন রিভার ক্যাম্পের গেটে এসে গাড়ি দাঁড়াল তখন দুপুর। লাটাগুরির ঠান্ডা গায়ে মেখে রওনা দিয়েছিলাম, এখানে গাড়ির বাইরে পা রেখে বুঝলাম বেজায় গরম। পার্কিং এলাকা থেকে একটা পায়ে হাঁটা লোহার ব্রিজ ঢুকে গেছে ভিতরের ক্যাম্প-এ। ব্রিজের সামনে রিভার ক্যাম্পের সাইন বোর্ড। নিচে বয়ে চলেছে জলঢাকা। নদীর ওপর ছড়ানো ছেটানো বোল্ডার। চারপাশে গাছপালা। ছোটবেলায় আঁকা ছবির মতো ঝালং।
আমরা ব্রিজ পেরিয়ে ভিতরে ঢুকে আরও বিস্মিত হলাম। কি সুন্দর বাঁধানো পথের ধারে ধারে নানান বাহারি গাছ, কোনোটায় রঙিন পাতা, কোনোটায় আবার রঙিন ফুল। একটু হেঁটে আসার পর ডাইনিং হল কাম অফিস। সেখানে ঢুকে চাবি নিয়ে আমরা চললাম কটেজ এর দিকে। কটেজগুলো নদীর দিকে মুখ করে ধাপে ধাপে সাজানো। চারিদিক ঝকঝকে, পরিষ্কার। বাঁধানো রাস্তা কোথাও খাড়াই, কোথাও সিঁড়ি বেয়ে চলে গেছে উপরের দিকে। ঝালং এর পাশেই ভুটান বর্ডার, তাই এখানে ভারতীয় মোবাইলের নেটওয়ার্ক প্রায় থাকেই না। মোবাইল ফোন দুদেশের সময় দেখায় নিজের ইচ্ছেমতো। এমন জায়গায় নেটওয়ার্ক না থাকাই ভালো। নিজের সঙ্গে কাটানোর মতো সময় তো আজকাল পাওয়া যায় না।
আমরা যে যার কটেজে ঢুকে ফ্রেশ একটু ফ্রেশ হয়েই বেড়িয়ে এলাম। পেটে তখন খুব খিদে। ঘড়ি বেলা ৩ টে ছাড়িয়েছে। আমরা এখানে দুপুরের খাবার বলে রেখেছিলাম। কব্জি ডুবিয়ে লাঞ্চ সারা হল। তারপর সোজা নদীর ধারে। এতো নিরিবিলি সুন্দর জায়গা যে বসে বসেই দিব্যি সময় কাটিয়ে দেওয়া যায় চারদিক দেখতে দেখতে। জলে নেমে, পাথরে থেকে পাথরে ছুটে বেরিয়ে ভীষণ আনন্দ করতে করতে আমরা সন্ধ্যে নামালাম। এরপর একটু রেস্ট, তারপর নদীর ধারে বন ফায়ার।
নদীর ধারে পাথরে বসে বন ফায়ার এর অভিজ্ঞতা এই প্রথম। ওপরে তাকিয়ে দেখলাম আকাশ জুড়ে তারা। রুম থেকে চেয়ার টেবিল আনতে হল এতো জন বসার জন্য। চারদিক অন্ধকার। খালি কটেজ গুলোর সামনে আলো আর যেখানে আমরা বসেছি সেখানে কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা। চারদিক ফাঁকা। তাকালে ভীতু মানুষদের গা ছমছম করতে বাধ্য। নদীর ওপারে কিছু গাছের শরীর থেকেই যেন আলো বেরোচ্ছে মনে হল। নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিতান্ত বেসুরো মানুষ দু কলি গেয়ে উঠলেও এখানে খারাপ লাগবে না। রাত যত বাড়তে লাগল মনে হতে লাগল, রোমান্টিকতা আর রোমাঞ্চ এখানে যেন মিলেমিশে গেছে। সেদিন অনেক রাত অবধি গল্প করে আমরা ঘুমোতে গেলাম।
নরম বিছানায় লেপের আদরে যখন আমরা গভীর ঘুমে আমাদের কটেজের দরজায় খুব ধাক্কা। সেই শব্দ দরজা থেকে জানলায় ছড়ালো। অর্ক তো ঘুমের ঘোরে উঠে দরজা খুলেই ফেলেছিল প্রায়, তারপর দেখি এ ধাক্কা মানুষের নয়, পাখিদের। নানান রকম পাখি জানলা দরজায় মনের আনন্দে ঠোক্কর দিচ্ছে। আসলে ঝগড়া করছে, নিজের প্রতিচ্ছবির সঙ্গে। সে শব্দে ঘুমিয়ে থাকা দায়। আসলে আমাদের কটেজগুলো দরজা জানলা গুলোয় রিফ্লেকটিভ কাঁচ। সেখানে পাখিরা নিজেদের ছবি দেখে ভাবছে তাদের আগেই অন্য পাখি এসে বসে আছে এখানে, তাই ডানা, পা, ঠোঁট সবকিছুর ব্যবহারে তাদের তাড়াবার চেষ্টা করছে। সাতসকালে ঘুমের দফারফা যখন হয়েই গেল জানলার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকালাম। সকালের রোদে অপূর্ব সুন্দর তখন ঝালং।
কিছুক্ষণ ঘর থেকে দেখেও মন ভরল না। বেড়িয়ে পড়লাম। নরম রোদে গাছের ছায়া পড়েছে বাঁধানো রাস্তা জুড়ে। ওপরে তাকিয়ে দেখলাম আকাশ এখানে সত্যিই নীল। জলের রং আলো পড়ে আরও সবুজ। হালকা হাওয়ায় দুলছে ফুল, গাছের ছায়া-রা। দূরে পাহাড়ের গা বেয়ে মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে হেঁটে চলেছেন নেপালি বহেনিরা। জলের ওপর বোল্ডারে তাকিয়ে দেখলাম নাম না জানা পাখিরা এ পাথর থেকে সে পাথর করে বেড়াচ্ছে। ভোরের মতো দল বেঁধে না হলেও, নিজের ইচ্ছেমতো। ছবি তোলার চেষ্টা করলেই ফুড়ুৎ হয়ে যাচ্ছে।
অনেকটা সময় প্রকৃতির সঙ্গে কাটিয়ে ধোঁয়া ওঠা চা এ আড্ডা হল খানিক। তারপর সবাই স্নান সেরে তৈরি হয়ে নিলাম। ঝালং কে টাটা বলার সময় এগিয়ে এল। ব্রেকফাস্ট সেরে সব গুছিয়ে তখন আমরা কটেজের বাইরে। রিভার ক্যাম্প এর বাইরে লোহার সাঁকোটায় দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। তখন শেষ বারের মতো দু চোখ ভরে দেখে নিচ্ছি ঝালং এর রূপ। শান্ত, সুন্দর, আলো ঝলমলে সে রূপ। সাঁকো থেকে নিচে তাকালে জলঢাকা, ওপরে তাকালে সবুজ আর নীল। জলের বয়ে চলার শব্দ কান ছুঁয়ে যাচ্ছে সকলের বেরোনোর তোড়জোড়ের মধ্যেই। বোল্ডারগুলো বছরের পর বছর ধরে এই একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে জলের ওপর। ঠিক যখন সেদিকে তাকিয়ে আছি মাথায় এল, জলঢাকার ওপর বোল্ডারগুলো কেমন নদীর জলটা ঢেকে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে সেই কবে থেকে….মনে মনে তখন হাসছি, এইতো বেশ, নামের স্বার্থকতা।
টুকিটাকি তথ্য
ঝালং রিভার ক্যাম্প বুক করা যায় বন বিভাগের (WBFDC) ওয়েবসাইট থেকে।
ভাড়া এসি কটেজ 2500+ট্যাক্স
নন এসি কটেজ 2000+ট্যাক্স
খাওয়ার খরচ আলাদা, তবে খুবই সাধ্যের মধ্যে।
বন ফায়ার করলে দুপুরের মধ্যে জানিয়ে দিতে হয়।
শিলিগুড়ি বা নিউ জলপাইগুড়ি থেকে সোজা গাড়ি বুক করে চলে যাওয়া যায় ঘণ্টা দুয়েকে।