প্রায় এক বছর পর বেড়াতে বেরোলাম। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে, মনকে বুঝিয়ে, ভয়কে জয় করে নিয়ে ফেললাম সিদ্ধান্ত। দোকা নয়, দল বেঁধে উত্তরবঙ্গ যাওয়ার প্ল্যান ছকে ফেলা হল আড্ডা দিতে দিতে। শ্বশুরবাড়ির পাড়ায় আমাদের একটা দল আছে, সেখানে বেশিরভাগই আমাদের চেয়ে বয়সে ছোট। তবে সিং ভেঙে বাছুরের দলে ঢুকতে তো আমাদের জুড়ি নেই। তাই সদলবলে সাজিয়ে নেওয়া হল ট্যুর প্ল্যান। সকলে ভোট দিয়ে ঠিক হল আমরা ডুয়ার্স ও কালিম্পং এর কিছু জায়গায় যাব। প্রথম গন্তব্য ডুয়ার্স।
প্ল্যানমাফিক পদাতিক ধরতে পৌঁছে গেলাম শিয়ালদহ স্টেশন। ১০ জনের দল, জলপাইগুড়ি থেকে যোগ দেবে আর একজন। মনের মধ্যে ভীষণ উত্তেজনা। কামরার বাকি লোকজনের বিরক্তিকে তখন থোড়াই কেয়ার। হল্লা হাটি করতে করতে কেটে গেল সময়। সকালে যখন জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনে নামলাম ঘড়িতে তখন সাড়ে দশটা। গাড়ি বলে রাখা ছিল আগে থেকেই। স্টেশন থেকে বেরিয়ে সকলে চড়ে বসলাম। একটা হোটেলে গিয়ে সেরে নেওয়া হল ব্রেকফাস্ট। তারপর সোজা যাত্রা শুরু লাটাগুরির হোটেলের পথে। সোজা রাস্তায় কৃষি আন্দোলনের অবরোধ থাকায় আমাদের ঘুরপথে যেতে হল, সেই সুবাদে দেখা হয়ে গেল তিস্তা ব্যারেজ আর নদীর বুকে পরিযায়ী পাখি।
কথা ছিল আমরা এদিন পৌঁছে ফরেস্ট সাফারি করব। আগে যখন ডুয়ার্স গিয়েছি সরাসরি ফরেস্ট অফিস বা জঙ্গলে ঢোকার রাস্তার সামনের অফিস থেকে বুকিং নেওয়া হয় দেখেছি। সেই পরিকল্পনা নিয়েই আসা। কিন্তু গাড়িতে উঠে জানা গেল এখন আর সাফারির বুকিং স্পট থেকে হয় না, অনলাইনে করতে হয়। তাড়াতাড়ি সাইট খুলে দেখলাম সেদিন বিকেলের সাফারির বুকিং আর নিচ্ছে না। আমাদের হাতে আর একটা দিন সময়ও নেই, তাই আলোচনায় ঠিক হল পরদিন সকালে সাফারি সেরে নেওয়া হবে। বুক করা হল চাপরামারি ওয়াচ টাওয়ারের সাফারি। অনলাইনে শুধু ফরেস্ট এ এন্ট্রি ফি টা দিয়ে বুক করতে হয়। সাফারির সময় অনুযায়ী ফরেস্ট অফিসে হাজিরা দিয়ে বাকি বুকিং সেরে নিতে হয়। আমাদের সাফারির সময় ছিল পরদিন সকাল সাড়ে ৬ টায়। ভোরের সাফারি থাকলে আগের দিন রাত ৮ টায় গিয়ে বুকিং মিটিয়ে আসতে হয়। পরদিন সকালে সরাসরি গেলেও হয়, কিন্তু নির্দেশ অনুসারে আগের দিন গিয়ে কথাবার্তা বলে অগ্রিম টাকা দিয়ে আসাই ভালো।
অনেকটা পথ ঘুরে আসার ফলে যখন হোটেলে পৌঁছলাম তখন প্রায় ৩ টে। গ্রিন টাচ ইকো রিসর্ট বাইরে থেকে বেশ সাজানো গোছানো সুন্দর। ঘরের ভিতরে টুকটাক গলদ থাকলেও মানিয়ে গুছিয়ে থেকে নেওয়া যায়। রুম এ গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বুঝলাম বেজায় খিদে পেয়েছে। হোটেল এ পৌঁছনোর আগেই খাবার বলে দেওয়া ছিল ফোন এ। সবাই মিলে আরাম করে খেলাম। আমাদের ট্রিপ- এর প্রধান উদ্যোক্তা রিক বলেছিল এই হোটেল থেকে সরাসরি চলে যাওয়া যায় জঙ্গলের পথে। তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে সন্ধে নামার আগে সে জায়গা দেখে নেওয়া দরকার। তাই আমরা খেয়ে উঠেই হোটেল লাগোয়া চা বাগানের পথ ধরলাম। চা বাগান বলতে আমরা যেমন বুঝি এটা ঠিক তেমন না। ঘন সবুজ পাতায় ঢাকা ভ্যালির মত নয় এ দৃশ্য বরং কোথাও কোথাও পাতা তুলে নেওয়ার ফলে ন্যাড়া, কোথাও পাতার রং গাঢ় সবুজ, কোথাও ফ্যাকাশে। আমরা সরু হাঁটা পথ ধরে যত ভিতরে ঢুকলাম জায়গাটাকে তত ভালো লাগতে লাগলো। কোনো কোলাহল নেই, মাঝে মাঝেই খুব কাছেই কোথাও ডেকে উঠছে ময়ূর। পানকৌড়ি, হর্নবিল কখনো সখনো উড়ে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে যেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম সেখানে ছোট জলাশয়। নিচে নেমে লাফিয়ে পেরিয়ে ওপারে যাওয়া যায়, কিন্তু সে সাহস করিনি। ওদিকে জঙ্গল আরও গহীন। তখন শেষ বিকেলের আলো ফুরিয়ে আসছে। পিছন ফিরে দেখি আকাশ লাল। সেই লাল একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ছে গোটা আকাশের গায়ে। গোধূলি যে এতো সুন্দর করে মায়ায় বাঁধতে পারে তা ঠিক ঐসময় ওই ফাঁকা জঙ্গল ঘেরা চা বাগানে না দাঁড়ালে বুঝতাম কি কোনোদিন….জানি না। কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে আর একটা সূর্যাস্তের স্মৃতি বুকে নিয়ে ফিরে এলাম হোটেলের ঘরে।
রাত ৮ টার আগেই প্রকৃতি ভবন এর অফিসে গিয়ে পরদিন ভোরের সাফারির কথাবার্তা সেরে টাকা জমা করে এসেছিলাম। একটা জিপে ৪ জনের বেশি আর ওঠা যায় না করোনা আবহে। অনলাইন বুকিং এ একটি গাড়িতে ৬ জন হিসেবে বুকিং নিলেও অফিসে গিয়ে এক গাড়িতে ৪ জনের হিসেবেই তিনটে গাড়ির বুকিং হল। রাতে হোটেল এ বারবেকিউ এর আয়োজন ছিল। সেখানে খাওয়া দাওয়া আড্ডা জমল খুব। তারপর ডিনার সেরে বুঝলাম বিছানা টানছে। পরদিন আলো ফোটার আগেই ওঠা, তাও শুতে শুতে প্রায় ১২ টা বেজে গেল।
যখন ঘুম ভাঙল তখন ঘড়িতে সাড়ে ৫টা। আমাদের দলেরই একজন সকলকে দরজা ধাক্কা দিয়ে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। সুয্যি মামা তখন সবে চাদরের আড়াল থেকে আড়মোড়া ভাঙছে। সবাই তৈরি হয়ে যখন পৌঁছলাম ফরেস্ট অফিসে তখন প্রায় সাড়ে ৬ টা। আমাদের ১১ জনের দলের জন্য বরাদ্দ ৩ টি জিপে আমরা পটাপট উঠে পড়লাম। জিপ ছুটে চলল হুহু করে। তখনও জঙ্গলে কুয়াশার চাদর। হুড খোলা জিপে ঠান্ডায় কেঁপে উঠছি আমরা। রাস্তা ফাঁকা, থেকে থেকে পাক দিয়ে উঠছে ধুলো। ডানদিকে সূর্যদেব লালের আভা ছড়াচ্ছেন। লাটাগুরি হয়ে মূর্তি খুনিয়ার দুধারে গহীন জঙ্গল পেরিয়ে যখন চাপরামারির ভিতরে ঢুকলাম তখন নরম রোদ ধুয়ে দিচ্ছে চারপাশ। সরু রাস্তার দুপাশে জঙ্গল তখন সবে ঘুম থেকে উঠছে। বনফুল দুলছে হালকা হাওয়ায়। ঢুকেই দেখলাম ময়ূররা ঘুরে বেড়াচ্ছে। চারিদিকে পাখির ডাক, পাতাঝরা রাস্তার সঙ্গে আলাপ জমাচ্ছে নতুন দিনের রোদ। এক কিলোমিটার জঙ্গুলে পথ পেরিয়ে গাড়ি যেখানে এসে থামল সেখানেই ওয়াচ টাওয়ার। গাড়ি থেকে নেমে দেখি ঘাসের ওপর শিশির চকচক করছে। পাখির ডাক, ময়ূরের কর্কশ চিৎকার ছাড়া বাকিটা নিস্তব্ধ, নিঝুম। আর এই সব কিছুর মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ওয়াচ টাওয়ার। নিচ থেকে দেখলে মনে হয় ক্যাসেল। ওয়াচ টাওয়ার থেকে সোজা চোখ মেললে জঙ্গলের করিডোর-এ বন্য প্রাণীদের নিত্য যাতায়াত।
সেখান থেকে দূরে দেখা গেল কটা হরিণ, সাম্বার আর একটা বাইসন। তার থেকে অনেক বেশি ভালো লাগলো জঙ্গলের ভিতর আলো ছায়ার খেলা, নিস্তব্ধতার শব্দ খুঁজে বেরালাম খানিকক্ষণ। ফরেস্ট বাংলো টার দিকে জুলু জুলু চোখে তাকিয়ে রইলাম। মনে পড়ে গেল Mr & Mrs Iyer- কে। তাঁদের দেখেই তো এই জঙ্গলে ঢুকে পড়ার লোভ, রাতযাপনের ইচ্ছে। এ জঙ্গলে কখনো থাকা হবে কিনা জানা নেই, তবে প্রথম চোখে দেখার আনন্দেই মন জুড়িয়ে গেল।
ওয়াচ টাওয়ার এ গিয়ে বন্যপ্রাণীদের তেমন দেখা না মিললে মনটা যে খারাপ লাগে না তেমন না, তবে জঙ্গলের ভিতরের যে সৌন্দর্য্যটা সেটা এ সবকিছুকে ছাপিয়ে আমার মন ছুঁয়ে যায়। ওই যে হুড খোলা জিপে পাতা ঝরা রাস্তার ওপর দিয়ে ছুটে চলা, ধুলোর ঢেউ, শিরশিরে হাওয়া, ঝুপঝাপ শব্দ, হঠাৎ ঝোপের আড়ালে কিছু নড়ে ওঠা, পালিয়ে যেতে চাওয়া পায়ের আওয়াজ, পাখির তীক্ষ্ণ চিৎকার এসব প্রতি মুহূর্তকে থ্রিলিং করে তোলে। কটা ময়ূর দেখতে পেলাম, কটা হরিণ ঘুরে তাকাল, হাতির পাল আদৌ এল কিনা, সেসব নিয়ে মাথাব্যথা কম হয়। দেখতে পেলে মন্দ লাগে না তবে জঙ্গলের এই নিবিড় নিজস্ব ছন্দটা আমার খুব প্রিয়। সবুজ আর ধূসরের এমন সুন্দর সহাবস্থান অন্য কোথাও এভাবে দেখা যায় না। জঙ্গলের ভিতর যতবারই যাই অন্যের এলাকায় এসে পড়েছি, এমন একটা অনুভুতি হয়। সেখানে অল্প সময় ব্যয় করে অনুধাবন করা যায়, সেখানে জবর দখল করা যায় না।
অনেকটা সময় জঙ্গলের মধ্যে কাটিয়ে আমরা যখন জিপে উঠে বেরোলাম তখন ঘড়ি আট টা ছাড়িয়েছে। সূর্য পুরোপুরি উঠে পড়ায় ঠান্ডা ভোরের চেয়ে অনেক কম। দুদিকে জঙ্গল রেখে ভীষণ গতিতে ছুটে চলেছে জিপ। আমরা উঠে দাঁড়িয়ে চেয়ে দেখছি চারপাশ। হাওয়ায় প্রায় উড়ে চলে যেতে বসেছে টুপি, মাফলার। দুপাশে দেখছি আর বার বার মনে হচ্ছে আবার কবে ঢুকে পড়ব ওই অজানায়। আবার কবে জঙ্গলের সঙ্গে নিবিড়ে দেখা হবে। এইসব ভাবতে ভাবতেই পৌঁছে গিয়েছিলাম প্রকৃতি ভবনের অফিসে। সেখানে গিয়ে চা খেতে খেতে গুঞ্জন শুনি ভিতরে নাকি একটা ঘায়েল লেপার্ড রাখা আছে। আমাদের দেখার উৎসাহ তখন চরমে। অফিসে অনুরোধ করে দেখার সুযোগও হল। ঢেকে রাখা খাঁচার ওপর থেকে পর্দা সরাতেই দাঁত মুখ খিঁচিয়ে গর্জন করে এগিয়ে এলেন তিনি। খাঁচাবন্দি হলেও এত কাছ থেকে লেপার্ড দেখে সকলেই চমকে উঠলাম তা বলতে দ্বিধা নেই। আমরা তাড়াতাড়ি সেখান থেকে বেরিয়ে রওনা দিলাম রিসর্টের দিকে। এখান থেকে আবার নতুন গন্তব্যে যাত্রা শুরু। সে গল্প আসছে, শিগগির।