এই সময়টা ভীষণ মনখারাপ হয়ে যায়। কেমন যেন ‘এইতো ছিল সব, কোথায় হারিয়ে গেল’-র একটা হাহাকার ওঠে পাক দিয়ে। লক্ষ্মী পুজোটা চলে গেলে যেন আরও বেশি করে। দীপাবলির অপেক্ষা থাকে কিন্তু উৎসবমুখর মনটা ভীষণ ঝিমিয়ে পরে এই সময়।
খুলে ফেলা মণ্ডপের বাঁশ জড়ো হয়। ছেঁড়া ব্যানারগুলো ব্যাজার মুখে তাকিয়ে থাকে। হট্টগোল থেমে যায়, অন্যভাবে পাওয়া মানুষগুলো রাতারাতি আগের মতো হয়ে যায়। রাস্তা নিজ্ঝুম, খাবার দোকান আলস্যের চাদর গায়ে দেয়, ল্যাম্পোস্টের আলোগুলোও যেন জোর কমিয়ে দেয় আপনা-আপনিই। চারদিক কেমন খাঁ খাঁ করে, ক্লাব কর্তৃপক্ষ মণ্ডপের আশেপাশের বাড়িগুলোর গায়ে জ্বলে থাকা আলো খুলে নেয়, রাস্তাগুলোয় মন মরা ছায়ারা ঘোরাঘুরি করে। বিসর্জনের পর ফাঁকা মণ্ডপটা স্বজন হারানোর দুঃখ আনে, তাকাতে পারি না ওদিকে।
এবার পুজোটা আরও অদ্ভুত। মহালয়ার পর লম্বা অপেক্ষায় পুজো পুজো ভাবটাই আসেনি। মহামারীর আবহে শিউলির গন্ধ, ঢাকের আওয়াজ মনটায় জাঁকিয়ে বসার আগেই সব শেষ। একটা লং উইকেন্ড যেমন হয়, আমরা বেড়াতে যাই বা একটু হই-হুল্লোড়ে ভাসি, তারপরেই আলস্য মেখে ল্যাপটপে মুখ রাখি, তেমনই যেন। আর পুজোর মাসখানেক আগে থাকতে যে আনন্দের ঢেউ ওঠে অন্যান্য বার, এবার সে সব কোভিড স্রোতে ভেসে গেছে। বুঝতেই পারছিলাম না আদৌ পুজোটা হবে কিনা। যে পাড়া ঝলমল করে খুঁটি পুজো থেকে, সেখানে এবার চুপিসারে প্রস্তুতি। লোকজন নেই, আলো নেই, বিজ্ঞাপনও না থাকার মতোই। আর পুজোর গন্ধ? রোজ রোজ অন্যান্য গন্ধ পাচ্ছি কিনা চেক করার চক্করে সেই ভাললাগা গন্ধটা এবার নেওয়াই হয়নি।
অন্যবার আমার পুজো শুরু হয়ে যায় তৃতীয়ার রাত থেকেই। বলা ভালো সর্টলিস্টার কার্ড ঝুলিয়ে ভিআইপি হয়ে ঠাকুর দেখার সুখ শুরু হয়ে যায়। টানা তিন রাত কলকাতা চষে একেবারে পারফেক্ট পুজো দেখা। তারপর ভালো-মন্দের তর্ক, ভোটাভুটি, অপার ভালোলাগা। বিগত পাঁচ বছরে এ নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। এবার তাও হল। শহর ঘুরে ঠাকুর দেখতে না পারার দুঃখ ঘিরে থেকেছে বেশ কটা দিন। একগাল হেসে রোল এগিয়ে দেওয়া দোকানি, ফুচকাওয়ালা, মাঝরাতে হাতে বেলুন তুলে দেওয়া লোকটা, গেস্ট দেখেই ভীষণ স্টাইলে ঢাক বাজিয়ে ওঠা ঢাকি, এদের সঙ্গে এবার আর দেখা হবে না ভেবে মন কেমন হয়েছে খুব। তবে আশার আলো খুঁজতে চেয়ে এটাও ভেবেছি, এবার পুজো হয়েছে এটাই তো পুরস্কার, বাকিটা না হয় থাক পরের বছরগুলোর জন্য।
তাও ওই কটা’দিন, ষষ্ঠীটা পড়ে যাওয়ার পরই সোনাকাঠির মতো ভালোলাগা মনটা ছুঁয়ে দিয়েছিল। এবার বোধয় ঢাকের আওয়াজ টা অন্যবারের চেয়ে বেশি জোরে শুনতে পেয়েছি, হয়তো মনটা শুনতে চেয়েছে বলেই। এবার অঞ্জলি দিইনি, মায়ের গালে সিঁদুর মাখিয়ে বরণও বাদ। বেরোনো হোক বা না হোক সাজগোজ হয়েছে রোজই। ছবি তুলে নিজেকে নিজে দেখাও। হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার জেরে কেষ্টপুর থেকে লেকটাউন পৌঁছে গেছি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম সময়ে। বন্ধুদের মুখ দেখেছি কত কত দিন পরে, খেয়েছি, হেসেছি, দিন-রাতের হিসেব বাদ দিয়ে। গাড়িতে চড়ে রাস্তার আলো দেখেছি। এও তো পাওয়া, পুজোর আনন্দ। আর ওই যে, যে লোকগুলো প্যান্ডেল বাইরে থেকে দেখার জন্যও লাইন দিয়েছে পাড়ার মণ্ডপে, তাদের দেখে চমকেছি…কিছুটা ভয়ে, কিছুটা চিন্তায়, কিছুটা আবার ভালোলাগায়। এই উৎসবটা বুঝি এমনই, কত মানুষ গোটা বছরটা এই কটা দিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটু অন্যরকম বাঁচার জন্য বেরিয়ে পড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও। তারপর তো আবার সেই একই হিসেব, পরিসংখ্যানে ঠাসা জীবন।
হেমন্ত এসে গেছে। এবার দুর্গা পুজোতেই রাতের রাস্তায় শীত শীত ভাব। সেদিন বান্ধবীর বাড়ির খোলা উঠোনে অনেক রাত অবধি বসে গল্প করে দেখলাম মাথায় হিমের ভিজে ভাব। এবার মা দুগ্গার সঙ্গে এসে গেছে শ্যামা পোকারাও। আগে দুর্গা পুজোর পর সপ্তাহ খানেক পেরিয়ে এরা এসে জানান দিত কালী পুজো আসছে, তারপর উৎসবের ঝাঁপ বন্ধ। এবার এখনই বারান্দা থেকে ঘর, মোবাইল স্ক্রিন সর্বত্র তারা আলোকসন্ধানী। কিন্তু ওরা জানে না, আমরাও এবার আলো খুঁজছি ওদের মতো। মনে মনে। সব ভালো হয়ে যাওয়ার আলো, আবার আগের জীবনে ফিরতে পারার আলো। কি জানি সে আলো কবে আসবে!