বছর পাঁচেক হল আমি উত্তর কলকাতার একটা ফ্ল্যাটে থাকি। আমার সেমি-সাজানো সংসার। তিনতলা বাড়ির তিন তিনটে ছাদওলা আস্তানা থেকে এসে এমন ছাদহীন হয়ে পড়ে মন কেমনের স্যুটকেস গুছিয়েছিলাম বেশ কিছুদিন। তারপর ওই সব যেমন হয়, গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। আমার ফ্ল্যাটে বিশাল ছাদ আছে, দূরে তাকালে আর্বানার টাওয়ার আছে, মেঘ না থাকলে হাওড়া ব্রিজ আছে, কিন্তু অধিকারের ভাগ সিকিও নেই। আমার বাড়ির তিন ছাদের সঙ্গে আমার মুড অনুযায়ী এপয়েন্টমেন্ট বাঁধা ছিল, কলকাতা এসে 5 বছরে 5 বারও ছাদে গেছি কিনা সন্দেহ।
কিন্তু এই যে প্রায় মাস দুয়েকের গৃহবন্দি জীবন, এই জীবনই ফ্ল্যাট বাড়ির ছাদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব করিয়ে দিল বেশ। আমার ফ্ল্যাটের জানলাটার সঙ্গে আমার দোস্তি খুব। বেশিরভাগ সময় ওদিকে তাকিয়ে থাকতে বেশ লাগে। কিন্তু ছাদে ওঠায় তেমন ড্রাইভ পাইনি কখনো। একে ল্যাদখোর, তায় ভাগের ছাদ। বন্দি দশায় প্রথম ছাদে গেলাম জনতা কার্ফিউ-এর দিন বিকেলে। আশে পাশের বিভিন্ন বাড়ি থেকে হাততালি, কাঁসর, ঘণ্টার আওয়াজ একা থাকার মনখারাপটা ভুলিয়ে দিল। মনে হল, একা কই, এইতো আমার মতোই আছে কতগুলো মানুষ। সবাই কেমন ‘আমরা করব জয়’-এর সঙ্গে একই সুরে তাল দিচ্ছে। মনে হল মাঝে মাঝে যাওয়াই যায় ছাদে।
ওয়ার্ক ফর্ম হোম-এর চাপে আবার আমার যে কে সেই। জানলা, খাট, ল্যাপটপ, রান্নাঘর, একটু হালকা থাকলে বারান্দা। মুখ গুঁজে কাজ করতে করতে হঠাৎ একদিন বিকেলে জানলায় মেঘেদের ভেসে যাওয়া দেখে ছাদে যাওয়ার মন হল। গিয়ে দেখি আসে-পাশের ছাদেও চাঁদের হাট। কেউ হাঁটছে, কেউ ক্রিকেট খেলছে, কেউ হাত-পা নাড়িয়ে চাড়িয়ে এক্সারসাইজ করছে। উপরে তাকিয়ে দেখি মেঘেদের মিছিল লেগেছে। আকাশ এত পরিষ্কার পার্কস্ট্রিট-এর 42 দেখা যাচ্ছে ঝকঝকে। অনেক পাখি ডাকতে ডাকতে উড়ে যাচ্ছে। এই যে এতগুলো মানুষ দেখা এদের দেখে ঘরবন্দি থাকার দুঃখটা খানিক উবে গেল। সেই শুরু হল আমার বিকেলে এক ফাঁকে ছাদে যাওয়া। পাখির ডাক শুনতে শুনতে সূর্যাস্ত দেখা, পাশের সবুজ জলাভূমিতে বক দেখা, হাওয়ার তালে নানান গাছেদের দোল দেখা। এক এক দিন আবার আমার বাড়ির ফেলে আসা ছাদ, আমার শৈশব ফিরিয়ে দিতে লাগল এই ছাদ। সখ্যতা বাড়ল। কার্নিশ, বাঁধানো বসার জায়গা, রেলিং, দূরের বাড়িগুলো, সব কিছুই ক্রমে কাছের হয়ে উঠতে লাগল।
আমাদের বাড়ির ছাদের সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। তিন তলা হওয়ার আগে এবং পরে নানান সুসময় আর মনখারাপের সাক্ষী থেকেছে ও বাড়ির ছাদ। মনে পড়ে ছোটবেলায় গরমের দুপুরে পা পুড়ে যাওয়ার উপক্রম হলেও ছাদে ধরাধরি খেলা, লোডশেডিং-এর রাতে মাদুর পেতে ছাদে শুয়ে থাকা, বাড়ির সবাই মিলে গল্পের ঝুলি খোলা, চোখের পাতা এক না হওয়া অবধি কালপুরুষ, সপ্তর্ষিমণ্ডল, ধ্রুবতারা, লুব্ধক, কে আগে কী খুঁজে পেল তাই নিয়ে টানাটানি বা হঠাৎ ডানা ঝাপটে উড়ে যাওয়া লক্ষ্মীপেঁচা। পিসিমণিরা এলে আড্ডা জমতো আরো, গান, নাটক, কবিতাপাঠ, হাহাহিহি, সন্ধে হলেই ছাদ-যাপন। আর ছিল ছুটির শীতের দুপুরে গরম হতে দেওয়া কম্বলে ঠেসান দিয়ে বসে বসে গল্পের বই, মায়ের এক আলমারি রোদে দেওয়া শাড়ি লুকিয়ে লুকিয়ে গায়ে ফেলে দেখা, ঠাকুমার পাশে বসে এবড়ো-খেবড়ো বড়ি দেওয়া, কদবেল মাখা, আমসি, চিনি দেওয়া বাতাবি লেবু। কতবার যে আচার চুরি করতে গিয়ে এন্টেনা নাড়িয়ে দিয়ে টিভির ছবি উড়িয়ে দিয়েছি।
কতদিন বাড়ি যাই না। নিজের ঘর টা, ছাদে দাঁড়িয়ে শুধু তাকিয়ে থাকাটা কতদিন পাই না। ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদের সঙ্গে নিজের প্রিয় ছাদের গল্প করি। শ্রীরামপুরের বাড়ির তিনটে ছাদের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় যেটা, ওটা থেকে গোটা আকাশটা দেখতে পেতাম। সবসময় মনে হত ওই আকাশটা আমায় দেখে, আমায় চেনে। ওই ছাদের একপাশে একটা ঢালু স্লিপের মতো জায়গা ছিল, ওখানে উঠে দাঁড়িয়ে দূরে গঙ্গার রেখা দেখা যেত, টাইটানিক চলতো মনে মনে। প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে কথা বন্ধের ফিরিস্তি, বলে উঠতে না পারা প্রথম প্রেম, মায়ের বকুনি, খারাপ নম্বর, না লিখতে পারা কবিতা, সব ওই ছাদ আগলে রাখতো। যেমন রাখতো বান্ধবীদের ফেলে যাওয়া খেলার হিসেব, গল্পের খাতা। কি জানি এই ফ্ল্যাট বাড়ির ছাদটা আমায় কোনোদিনও চিনবে কিনা!
কোয়ারেন্টাইন জীবন ও সময় দুটোই পাল্টে দিয়েছে আমাদের সকলের। এখন সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই দেখি অনেকেই ছাদটাকে বেছে নিয়েছেন নিজেদের ভালোলাগার কোণ হিসেবে। নাচ, গান, কবিতায় সেসব ছাদ নতুন নতুন গল্প লিখছে। অনেকেরই ছাদ-এর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে। অনেকেই দমবন্ধ ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদেই মুক্তির স্বাদ পেয়েছেন। এসব দেখে উপলব্ধি হয়েছে নতুন রকম। আসলে প্রতিটা ছাদের আলাদা আলাদা গল্প থাকে। শ্রীরামপুর আর কেষ্টপুরের ছাদদুটোর গল্প আলাদা। সেই গল্পে নিজেকে জুড়ে নেওয়াটুকুই আসল। জুড়ে নিতে একবার পারলে আকাশটাকে নিজের ভাবাই যায়, সে যতই ছাদের অনেক ভাগীদার থাকুক।