আমি বড় হয়েছি হিন্দু বাঙালি পাড়ায়। তাই ঈদে আমাদের এলাকায় কোনও উৎসব দেখিনি কখনো। কিন্তু প্রতি বছরই আমাদের ঈদের নেমন্তন্ন থাকতো এক আত্মীয়ের বাড়ি। আমার মায়ের মাসি সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিয়ে করেছিলেন মুসলিম পরিবারে। সেই মাসিদিদা দাদুর বাড়ি দারুন সব খাবারের লোভে হাজির হয়েছি ঈদে, বার কয়েক। অবশ্যই সকলের ছুটি-ছাটা বিচার করে। বিয়ের আগে থেকেই মা-বাবা আর মাসিদিদা-দাদু খুব বন্ধু ছিল। তাই আমাদের সঙ্গে খাতির ছিল আলাদা। আমি অনেক বড় বয়স অব্দি জানতামই না যে দাদু মুসলমান, ওদের বাড়ি, ঘর, কথা বার্তা সবই তো আমাদের মতো। আলাদা কোথায় কোনওদিন বুঝতে পারি নি।
বারুইপুরে ওদের ওখানে কাটানো একটা ঈদের স্মৃতি মনে পড়ে খুব। ঈদের দিন বাড়িতে সকাল থেকে পরোটা, দু-তিন রকমের মাংস, পোলাও, মিষ্টি, সিমাই, এলাহি আয়োজন। রাস্তায় চারিদিকে আলো, বাড়িতে অতিথি সমাগম, সন্ধেয় পাড়ার স্টেজে নানান অনুষ্ঠান, প্রতিযোগিতা, হৈ হৈ ব্যাপার। সেই সব কিছুতে আমি ভরপুর অংশ নিয়েছিলাম। মনে আছে সেই বছর ঈদে আমার নতুন জামা হয়েছিল, নীল-সবুজ রঙা চুড়িদার। বাপিই কিনে দিয়েছিল, সব ছোটরা নতুন পরছে, আমিও যাতে পরি।
আমার পিসিমণির বাড়ি ছিল খিদিরপুর। ঈদের সময় সেখানে গেলেও উৎসবের আঁচ পেতাম। পিসিমশাইয়ের সঙ্গে বাজারে গিয়ে ঈদের পসরা দেখতে সবচেয়ে ভালো লাগতো। নানান রঙের আলোয় সাজানো দোকান, নানা ডিজাইনের ফেজটুপি, রঙিন বিস্কুট আর কেনাকাটার ভিড়। শিরমল, সিমাই দেখে জিভে জল আসত। সিমাই কিনে বাড়ি ফিরেই গরম দুধে দিয়ে খেতে বসতাম। সিমাই টা দেওয়া মাত্রই উপরে ঘি ভেসে ওঠা দেখার কি যে সুখ ছিল।
আমার স্কুল কলেজ জীবনে মুসলিম বন্ধু থাকলেও তাদের সঙ্গে ঈদের নেমন্তন্ন পাওয়ার মত সখ্যতা ছিল না। বরং চাকরি করতে গিয়ে আমি অনেকের সঙ্গে কাছ থেকে মিশেছি। তাদের বাড়ি থেকে আসা পোলাও মাংস কাবাব-এ ভাগ বসিয়েছি নির্দ্বিধায়। বায়না করেছি সিমাই বা হালিম-এর। আমার জন্য ঈদের পরদিন আলাদা প্যাক করে কাবাব এনে চুপি চুপি ডেস্ক-এ দিয়ে গেছে এমন বন্ধুও পেয়েছি। এক কথায় রমজানের সময় পার্কসার্কাসের তস্য গলি থেকে হালিম এনে হাজির করেছে তারা, প্রতি বছর। কী তার স্বাদ, আহা! রিয়াজ, ইফতিকার, নাসির ভাই, ভুট্টোরা আমাদের খেতে ভালোবাসায় বার বার ইন্ধন দিয়েছে ঈদের পরদিন সারা অফিসের জন্য অঢেল খাবার এনে। মনে পড়ে না আমি বা আমরা কোনোদিনও পুজোর পর এত মিষ্টি নিয়ে অফিস গেছি বলে!
হালিম জিনিসটা প্রথম খেতে শেখা আরসালান বা জিশান-এ। রমজানের আসল স্বাদ নিতে জাকারিয়া স্ট্রিট যেতে শেখা অনেক পরে। ফিয়ার্স লেন-এর রাস্তায় এডামস-এর সুতলি কাবাব, বা আলাউদ্দিন-এর সিমাই, মিষ্টি খেয়ে মনে হয়েছে একেই ‘জন্নত’ বলে। যে দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি তারা পরম যত্নে আমায় খাইয়েছেন। অন্যসময় যাওয়া আর রমজানে যাওয়া বার বার আলাদা হয়ে থেকেছে আমার কাছে, আতিথেয়তায় আর উৎসবের আঁচে। লস্যি, চিকেন চেঙ্গিসি বা হালিম খেতে খেতে মানুষের হাসিমুখগুলো দেখে বার বার মনে হয়েছে এই উৎসবটা আমারও। আর সেই কারণেই গত দু-তিন বছরে মানজিলাতের ছাদে বসে হালিম খাওয়াটা একটা প্রাক-ঈদ অভ্যেস হয়ে গেছে। যেমন অভ্যাস হয়ে গেছে অফিসে সদলবলে জাম জাম, জাইকা বা সাইমার ভুরিভোজ।
এ বছর ঈদ-টা আলাদা। এ বছর ঈদ মানে আমার কাছে আর খাওয়া-দাওয়া নয়। যে জাকারিয়া স্ট্রিটের ছবিতে ফুড পেজ গুলো ভরে যায়, সে রাস্তা এবার খাঁ খাঁ। পার্ক সার্কাসে ভিড় নেই অলি-গলিতে। দোকানে দোকানে যে মুখগুলো না চেনা সত্ত্বেও হেসে তাকাত তারা কেমন আছে জানা নেই। ঈদের কেনাকাটা নেই, মেলা নেই, গান-বাজনা নেই। চেনা জানা অনেকেই বাড়ি যেতে পারেনি। অনেকেই বাড়িতে থেকে ছোট করে পালন করে নিচ্ছে উৎসবের নিয়ম। দেখা-সাক্ষাৎ নেই। মন ভালো নেই।
তাই এবার চেনা মানুষগুলোর খোঁজ খবর নেওয়াটা অনেক দামি। অনেক দামি পাশে আছি বলা টা। যদি সব ঠিক হয়ে যায় একদিন, অকারণে সৃষ্টি করতে চাওয়া ভেদাভেদের চেষ্টাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আবার না হয় সবাই মিলে হালিম খাওয়া যাবে হই হই করে।