শিক্ষক দিবস। এই দিনটা এলেই অনেকগুলো মুখ চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে ওঠে। হাসি মুখ, গম্ভীর মুখ, রাগি মুখ, বিরক্ত মুখ। সেইসব মুখ যাঁরা আজকের ‘আমি’-টাকে গড়ে দিয়েছেন যত্ন করে। তাঁদের বকুনি, চুলের মুঠি, প্রশ্রয়, পিঠ চাপড়ে দেওয়াগুলো আজও খুব প্রিয়। আমার প্রথম শিক্ষক/শিক্ষিকা কে, যদি বলতে হয় তাহলে সেটা স্কুলের আগেই, আমার মা। যে আমার ছাড়া আরও অনেকেরই শিক্ষিকা। স্কুলের স্কেল আর বাড়ির খুন্তি, এটুকুই যা তফাৎ। তবে আমার জীবন এবং শিক্ষার অনেক পাঠই তার কাছে নেওয়া। বাবা এমন অনেক কিছু শিখিয়েছে যা আমায় অন্য আর কেউ শেখাতে পারতো না। সেসব শেখার শেষ হয় নি, হয় না কখনোই।
প্রথম যেদিন বাবা-মায়ের সঙ্গে স্কুলে গেলাম, যিনি মায়ের কোল থেকে প্রায় কেড়ে নিয়ে ভিতরে গিয়েছিলেন, তাঁর ওপর খুব রাগ হয়েছিল। আর পরে তিনিই যখন ক্লাসে এসে গুড মর্নিং বললেন, সবাই গলা মিলিয়ে উত্তর দিল ‘গুড মর্নিং টিচার’। আমি ভেবেছিলাম ওনার নাম টিচার। তার অনেক পরে বুঝতে শেখা টিচার-এর আসল মানে। ততদিনে অবশ্য সেই মায়ের থেকে কেড়ে নিয়ে আসা মানুষটাকে ভালো লেগে গেছে।
আমি ছোটবেলায় লেজ বিশিষ্ট না হলেও শান্ত শিষ্ট ছিলাম। তাই কিন্ডারগার্টেন স্কুলে বদমায়েশির জন্য শাস্তি কমই পেয়েছি। যা শাস্তি মনে পড়ে, হয় ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গে ঝগড়া মারামারি করে প্রচন্ড বকুনি, নয়ত ক্লাস চলাকালীন কথা বলার জন্য বন্ধু-সহ কান ধরে বাইরে। শেষের টা যদিও শাস্তি না, তখনকার টিচার-রা বুঝতেন না। পড়া ভুল করলে যে দিদিমণিদের চোখ দেখে ভয় লাগত, স্কুলের ফাংশনে তারাই হাতে ধরে শিখিয়ে দিতেন নাচ-নাটক। তখন তাদের ক্লাসের চেয়ে একদম আলাদা লাগত।
হাই স্কুলে গিয়ে টিচার-দের আরও কাছ থেকে চেনা। অতো বড় স্কুল, টিচার্স রুম-এর পর্দা সরিয়ে উঁকি দিয়ে অতো দিদিমণি দেখে অবাক হয়ে যেতাম প্রথম প্রথম। স্কুলের দি-এর আমরা মনে মনে ভালো আর খারাপ এই দুই জোন-এ ভাগ করে রাখতাম। অনেককেই সমঝে চলতাম। এক এক জনকে দেখলে তো সাত হাত দূর দিয়ে হাঁটতাম। আবার কেউ কেউ ছিল মায়ের মতো ভালো। মানে দোষ করলে শাস্তি আর অন্যসময় আদর, আবদার, তাদের প্রতি আলাদাই টান ছিল। একবার এক দিদিমণি গোটা ক্লাস জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম বলে বলেছিলেন ‘যা দেখছি এ এইট পাশও করবে না’। আবার সেই দিদিমণিই আমি চাকরি পাওয়ার পর রাস্তায় দেখা হতে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। সেদিন উনি চ্যালেঞ্জটা না দিলে আজকে হয়তো এটা লিখতে পারতাম না। স্কুলে এমন কিছু দি ছিলেন যাঁদের কাছে না পড়লে জীবনটাই বাকি থেকে যেত। বাংলা, ভূগোল এমনকি ভীষণ ভয় পাওয়া অঙ্ক বা ইতিহাস সহজ হত না। আবার এমন কিছু দি ছিলেন তাঁরা ভীষণ অপ্রিয় থেকে প্রিয় হয়ে যেতেন নিজের মহিমায়। তাঁদের ক্লাস করার জন্য রেনি ডে-তে হাপুশুটি ভিজে স্কুলে যেতে কষ্ট হত না মোটেই।
ক্লাস এইট-এ প্রথম টিউশন পড়তে যাওয়া। ইংরেজি। স্যার পড়ার মাঝে মাঝেই নানান গল্প বলতেন, নিছক গল্প হলেও সেগুলোও যে শিক্ষা তা টের পেয়েছি পরে। নাইন থেকে পুরোদমে টিউশন পড়া শুরু। সেসব ব্যাচে টিচার-রা ছিলেন বাড়ির লোকের মতোই। গুরুগম্ভীর ভাবটা সেখানে থাকতো না, বরং আত্মীয়তা বাড়ত। এখানে স্যারের হাতে মাইনে দিয়েই ‘স্যার খাওয়ান’ বলার স্বাধীনতা থাকতো। সেইসব দিন রঙিন ছবির মতো, জীবন একঘেঁয়ে হলেও, রুটিন ছিল ভালোলাগার।
কলেজে গিয়ে বুঝলাম টিচার আসলে সত্যিই ফ্রেন্ড, ফিলজফার, গাইড। সাবজেক্ট-এর জন্য কিনা জানি না আমাদের ডিপার্টমেন্ট-এর স্যার ম্যাডাম-রা কুল ছিলেন। আমাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতেন। প্রয়োজনে ধমক দিতেন কিন্তু আড্ডাও দিতেন। সেসব গল্প সাংবাদিকতার গন্ডি ছাড়িয়ে ঢুকে পড়ত দেশ-বিদেশ ঘুরে সোজা অন্দরমহলে। ক্লাসের পাঠের চেয়ে সে পাঠ ছিল অনেক দামি। সেই শিক্ষক শিক্ষিকাদের অনেকেই শিক্ষক কম, আর বন্ধু বেশি হয়ে থেকে গেছেন আজও।
চাকরি জীবনে এসেও শিক্ষক পেয়েছি অনেক। দিদি, দাদা বা বন্ধু হয়ে অনেক অজানার পাঠ দিয়েছেন অনেকেই। হাতে ধরে শিখিয়েছেন, ভরসা করেছেন, বিশ্বাস করেছেন। শুধু কাজ বা অফিসের পলিটিক্স না, তাঁরা জীবনকেও দেখতে শিখিয়েছেন অন্য চোখে। নিজের পড়াশোনা, কেরিয়ারের বাইরেও আমার বন্ধুরা, আমার কাছের মানুষেরা, আমার চেয়ে বয়সে ছোট কিন্তু বুদ্ধিতে বড় ভাই-বোনেরা আমায় অনেক কিছু শিখিয়েছে। তাদের অনেককে দেখে আমি আজও নতুন কিছু শিখি।
নিজেও শেখাই নিজেকে। রোজ। সেসব শিক্ষা বয়স আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টায়। ভালো ছাত্রী কোনোওকালেই ছিলাম না, তাই মাঝে মাঝেই পাঠ ভুলে গিয়ে ভুল করি। কিন্তু চেষ্টাটা জারি থাকে। এই চেষ্টা জারি রাখাটাই আসল শিক্ষা, যেটা রন্ধ্রে রন্ধে ঢুকিয়ে দিয়েছেন আমার শিক্ষক/শিক্ষিকারা।