ছোটবেলায় পড়তে বসে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতাম। মা বলতো, রোজ বই খুলে রেখে একভাবে বাইরে তাকিয়ে থাকতে পারিস কী করে! আমি ভাবতাম, তাকিয়ে থাকি হয়তো একভাবে, ভাবনায় তো আমি তখন বিদেশ ঘুরে অনেক দূরে!
স্যারেদের বাড়ি পড়তে গিয়েও সোজা তাকালে জানলা দেখা যায় এমন জায়গায় বসতাম। বাইরে দেখতে দেখতে জানা অঙ্ক ভুল হয়ে যেত। স্যার বলেছিল, আপনার মেয়ে খালি জানলা দিয়ে আকাশ দেখে। বাবা বলেছিল আমার মেয়ে তো, একটু অমন হবে।
স্কুলে প্রতি ক্লাসেই জানলার ধারের বেঞ্চটা খুব প্রিয় ছিল। ঝগড়াও করেছি সহপাঠীদের সঙ্গে ধারে বসা নিয়ে। দিদিমণিদের কাছে অনেকবার বকুনি খেয়েছি পড়ায় মন না দিয়ে জানলার বাইরে চেয়ে থাকার জন্য।
বাস-ট্যাক্সি-অটো-ট্রেন-প্লেন-এর জানলার ধার আসলে আমার বেরিয়ে পড়ার দরজা। প্রথম পাহাড় দেখা, প্রথম হাত বাড়িয়ে চায়ে গরম, প্রথম মেঘেদের উঁকিঝুঁকি, প্রথম সেই হাওয়াদের মুখে ঝামরে পড়া এইসব জানলাদের সঙ্গে বন্ধুত্বের জেরেই। বয়স ও সময়ের সঙ্গে পাল্টে যেতে থাকা সেইসব জানলা আমার অনেক কিছুর সাক্ষী।
চাকরি জীবনে যাতায়াতের পথের জানলাগুলোই জীবন জানার জানলা ছিল। নানারকম মানুষ দেখা, প্রতিবাদী মিছিল দেখা, হোর্ডিং দেখা, আমার কলকাতা দেখা তখনই। কর্পোরেট প্রেসার-এ জানলার কাঁচে মুখ রাখার অবসর পাইনি সেভাবে। আবার কোনও কোনও অফিসে অবসর থাকলেও জানলা পাইনি।
আমার বর্তমান অফিস যখন ওয়ার্ক ফর্ম হোম-এর অপশন দিল তখন অনেক না ভালোলাগার মধ্যে ভালোলাগা ছিল বাড়ির জানালাটা। ওই চার দেওয়ালে বন্দি অফিসটায় মানুষগুলো যদিও এক একটা মনের জানলা। তাদের সঙ্গে স্কাইপে দেখায় সুখ নেই, তবে স্বস্তি আছে। এই যে সবাই নিয়ম মেনে সাবধানে আছে। কাছের মানুষগুলোর কাছাকাছি আছে।
শেষ এক সপ্তাহ ধরে এই এক কামরার ফ্ল্যাটের জানলাটাই সম্বল। ওখান দিয়ে অনেকটা সবুজ আর আকাশ দেখা যায়। কখনও খুলে দিয়ে বাতাস মাখি, কখনো বন্ধ কাঁচের ভিতর দিয়েই চেয়ে থাকি। এ কদিন ওখান দিয়েই বেরিয়ে পড়ছি টুকটাক। পাহাড়, সমুদ্র, মরুভূমি বা জঙ্গল, যখন যেমন ইচ্ছে ঘুরে নিচ্ছি মনে মনে। পরিবেশ দূষণ কমে যাওয়া, দেশ বিদেশের ব্যস্ততম এলাকায় শুনশান পথ-ঘাট, ভেনিসের পরিষ্কার ক্যানালের জল দেখে এই দুঃসময়েও খুশি হচ্ছি। ফেসবুক, whatsapp দরকার না পড়লে দেখছি না। ভালো লাগছে না সারাক্ষণ করোনার চোখরাঙানি। হতাশাকে প্রশয় দিচ্ছি না মোটেই। আশা রাখছি আবার নতুন দিন আসার। বাংলা নববর্ষ আসছে না?
মন খারাপ হচ্ছে না এমন না। তবে আমার জানলা দিয়ে আমার পৃথিবীটাও মন্দ না। সকালে উঠে একটু সময় নিয়ে ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে মুচকি হাসার অবসরটা মন্দ না। জানলা দিয়ে যতদূর চোখ যায় তার চেয়ে বেশি দেখতে পাওয়ার ইচ্ছেটাও মন্দ না। নিজের এই পৃথিবীটায় একটু সতর্ক হয়ে বাঁচতে পারলে সারা পৃথিবীটা চাক্ষুস দেখার স্বাদ হয়তো মিটবে আবার। মনের জানালাগুলো ততদিন না হয় আমরা সবাই হাট করে খুলে রাখি… কি পারবো না?