আধো আধো কথা বলতে শেখার সময় উচ্চারণের ভুলে তৈরি হওয়া ডাক, সময়ের হাত ধরে সেই ডাকেরই পরম্পরা হয়ে যাওয়া, বাঙালি বাড়িতে এ ঘটনা আকচার ঘটে। আমাদের বাড়িতে এমন একটা ডাক ছিল নাম্মা- ঠাকুরমা থেকে ঠাকুমা ছাড়িয়ে সোজা নাম্মা দিয়েই শুরু হয়েছিল একটা সম্পর্কের পথ চলা। তারপর সেই একটা থেকেই অনেক কটা। ছিল বলছি কারণ সেই ডাকটা হারিয়ে গেল কাল। আমাদের বাড়ির নীচের তলার ঘরটা ফাঁকা হয়ে গেল ঝুপ করে। আর সেই ডাকটার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেল আমার একটা নামও- সোনাই। ‘সোনাই এসেছিস?”, “সোনাই আজই চলে যাবি?” শেষ কয়েক বছরের অভ্যাসের মতো এই লাইনগুলো আর শোনা হবে না শ্রীরামপুর গেলে। সদর দরজাটা ঠেলে খুললে খাটের ওপর বসা হাসি মুখটা ভ্যানিশ!
এই বছরটা ভালো নয় সে তো মেনে নিয়েছি কবেই, কিন্তু সেই না ভালো’র ভাঁড়ার বেড়ে চলেছে রোজ। রবিবার অনেক রাতে খাওয়ার ফলে কাল সকালে ঘুম ভেঙেছিল টক ঢেঁকুর নিয়ে। বাবার ফোন এসে বলে দিল এ সকালটা আসলে টকই। কান্না পেল না, এদিকে স্মৃতির দালান উপচে পড়ল। সেই ছোট্ট থেকে সাদা আঁচলের নীচে খুঁজে নেওয়া স্বস্তির গন্ধটা মনে পড়ে গেল। আমি অনেক ছোট থেকেই নাম্মার কাছে শুতাম। ছোট কাকুর বিয়ের আগে আমি নাম্মা আর ছোট কাকু, তারপর আমি আর নাম্মা। ঘুমের মধ্যে চড়কি পাক খেতে খেতে নাম্মাকে খাট থেকে ফেলে দেওয়ার উপক্রম করতাম। ভয়ের স্বপ্ন দেখলে আঁচল চেপে ধরতাম। পরীক্ষার আগে গোটা ঘরের আলো জ্বালিয়ে রেখে, নাম্মা জোড়ে নাক ডাকলে নাক টিপে দিয়ে, রাতে বাথরুম যাওয়ার হলে ডেকে তুলে বিরক্ত করতাম। প্রথম অপারেশনে, হঠাৎ জ্বরে, পেট গরমে, হাম হওয়ায়, প্রথম পিরিয়ড-এর ব্যথায় ওই সরু সরু আঙুলগুলোর হাত বোলানোয় সবচেয়ে আরাম পেতাম। আমার প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় নাম্মার হাতে মাখা ডাল ভাত না পেলে খাওয়া হত না। কলেজের দিনগুলো পর্যন্ত সেই মাখা ভাত অমৃতের মতো খেয়েছি এই আমি, যে এখন অন্য কেউ মেখে দিলে খেতে পারে না। অমন ডাল-ভাত আর কেউ মাখতেও পারে না। ঠিক যেমন জন্মদিনের পায়েস বা অরন্ধনের কচু, নাম্মার মতো কেউ রাঁধে না। আমার জলের বোতল, টিফিন বক্স, ওই বাড়ির নকশা করা থালা, গ্লাস, চিরুনি, চুলের ফিতে সবেতেই নাম্মা ছিল। আমার গোটা মেয়েবেলাটাকে ওই সারা করে পরা সাদা শাড়ি আগলে রেখেছিল। ছোট থেকেই খুব আদুরে ছিলাম না আমি, বরং নিজের জগতে থাকতাম বেশি, কিন্তু ওই মিষ্টি হাসি মুখটা যখন পুজোর জোগাড়ের ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যেও তেলতেলে হাতে নাড়ু পাকিয়ে ঠাকুরের নৈবেদ্য-এ দেওয়ার আগে আমার হাতে তুলে দিত, তার চেয়ে বেশি আদর আমি আর কিছুতে পাইনি। যেদিন বিয়ে হয়ে চলে এলাম, খুব পণ করেছিলাম কাঁদব না, কিন্তু ওই নাম্মাই সবার আগে কাঁদিয়ে দিল। কাল যেমন সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল।
নাম্মার অনেক অল্প বয়সেই দাদু চলে যায়। কিন্তু জীবনের সবটা লড়াই সাফল্যের সঙ্গে লড়েছে নাম্মা। একা হাতে সংসার সামলানো হোক, কি ছেলে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া, স্কুলের দিদিমণি হিসেবে দায়িত্ব পালন হোক বা নিজের শখ পূরণ করে প্রায় সারা ভারত ঘুরে দেখা, সবটাই নাম্মা করেছে দক্ষতার সঙ্গে। নাম্মা যেমন পারদর্শিতার সঙ্গে জন্মাষ্টমীর মন্ত্র পড়তো, তেমনভাবেই পড়ত বিভূতিভূষণ। সেই সময়ের মফস্বলের মহিলা হিসেবে স্বামীকে ছাড়া নিজের উদ্যোগে ট্যুর অপারেটর-দের সঙ্গে এখান-সেখান বেড়িয়ে পড়া চাট্টিখানি কথা ছিল না। কিন্তু আমার নাম্মা পেরেছিল, উদাহরণ হতে। নাম্মার বেড়ানোর গল্প শোনা, বা বই পড়ে শোনানোগুলো ছিল আমার ব্যক্তিগত ঠাকুমার ঝুলি।
স্কুলের দিদিমণি হওয়ায় নাম্মার সাজপোশাক ছিল খুব পরিপাটি। বাড়িতে সারা করে শাড়ি পড়লেও স্কুলে বা কারও বাড়ি যাওয়ার সময় একদম টিপটপ। নাম্মার পায়ের কাছে বসে পাটভাঙা শাড়ির কুঁচি ধরা, শাড়িতে পিন লাগিয়ে দেওয়া ছিল আমার দারুণ পছন্দের। নতুন শাড়ি, শাড়ির পাড়ের নকশা এসব শেষ বয়স অবধিও খুব প্রিয় ছিল নাম্মার। আলমারি ভর্তি শাড়ি থাকলেও কেউ নতুন শাড়ি দিলে একগাল হাসতো। মুখে ‘কি করতে দিচ্ছিস?’ বললেও, অন্যের কাছে গর্ব করে সেই পাওনার গল্প শোনাত।
একটা সময় অবধি মাছ, লুচি পরোটা এসব খেতে খুব ভালোবাসলেও শেষ কয়েক বছরে হজমের গোলমালের জন্য খাদ্যতালিকা থেকে অনেক কিছুই বাদ গিয়েছিল। তবে নাম্মার সবচেয়ে প্রিয় খাবার ছিল আইসক্রিম। বিয়েবাড়ি হোক, মেলা হোক বা পুজো, রবিবারে বাড়িতে অতিথি সমাগম হোক, কি জন্মদিন, নাম্মার জন্য আইসক্রিম বা ভালো পান নিয়ে বাড়ি ঢুকলে নাম্মা ভীষণ খুশি হতো। আর নাম্মার আইসক্রিম খাওয়ার ভঙ্গির মধ্যে ছিল নাম্মার পোশাকি নামের স্বার্থকতা। কিশোরী লাহা একদম কিশোরী বালিকার মতো আলো ঝলমল মুখ নিয়ে চেটে চেটে আইসক্রিম খেত। সেটা দেখার যে কি সুখ ছিল। কোভিড পরিস্থিতিতে দুবার বাড়ি গেলেও আইসক্রিম নিয়ে যেতে না পারার আফসোসটাই শুধু রয়ে গেল এখন।
সকলকেই চলে যেতে হয় এটা জানা সত্ত্বেও কিছু মানুষের চলে যাওয়া বুকের মধ্যে বিষাদের বীজ পুঁতে দেয়। সার জল পেয়ে সেই বিষাদ একটু একটু করে মন থেকে বাড়ির দেওয়ালে, দরজা-জানালা, বালিশে, চাদরে, ফ্যামিলি এলবামে ছড়িয়ে পড়ে। আমরা পাতা ওল্টাই জীবনের।সুখের স্মৃতির জাল বুনি। কিন্তু তবুও সেই গাছটা থেকে যায়। কোনও একলা দুপুরে, আচমকা ঘুম ভেঙে যাওয়া মধ্যরাতে, নারকেল নাড়ুর কামড়ে, আইসক্রিমের কাপে ফিরে ফিরে আসে। ডাক আর নাম গুলোর জন্য ভীষণ ভীষণ কষ্ট হয় তখন।
(বি. দ্র. লেখার সঙ্গে নাম্মার ছবি ব্যবহার করতেই পারতাম কিন্তু প্রখ্যাত শিল্পী পার্থ ভট্টাচার্য-এর আঁকা এই ছবিটার চেয়ে ভালো আমাদের গল্প আর কোনও ছবি বলে না।)