বন্ধুভাগ্য-টা আমার চিরকালই ভাল। জীবনের এতগুলো বছর পেরিয়ে এসে আমি গর্ব করে বলতে পারি বন্ধুত্ব বিষয়টায় জীবন আমাকে নিরাশ করেনি। তার মানে এই নয় যে কখনোই দাগা খাইনি, তবে ‘যে সহে সে রহে’ হয়ে থেকে গেছি বা গেছে অনেকেই। সেইসব থেকে যাওয়া বন্ধুত্বের পাল্লা আমার ভারি, চলে যাওয়া বন্ধুদের চেয়ে।
ফ্রেন্ডশিপ ব্যাপারটা কী বুঝতে শেখার আগেই আমাদের গলির দু’বাড়ি পরে আমারই প্রায় সমবয়সী একটি মেয়ে আমার বন্ধু হয়। প্রথম বন্ধু। ওর দুদিকে বিনুনি করা নিটোল মুখটা এখনও মনে পড়ে। আমাদের খেলনা বাটি, জন্মদিন সেসব-ও অল্প-স্বল্প ধূসর ছবির মতো। আর মনে আছে আমরা একই দিনে স্কুল-এ ভর্তি হয়েছিলাম, কিন্তু অন্য ক্লাস-এ। তারপর থেকেই নতুন বন্ধু হওয়ার শুরু। ছোট থেকেই দলবাজিতে আমার সিদ্ধহস্ত। কোথা থেকে শিখেছিলাম জানা নেই। নিজেদের দলে বাইরের কাউকে আমাদের পছন্দ ছিল না মোটেই। তখন যাঁদের ছাড়া টিফিন রুচতো না মুখে এখন তাদের মুখ দেখি ফেসবুকে।
হাইস্কুল ছিল ফ্রেন্ডশিপ-এর আখড়া। কত মুখ, কত বকবক। তার মধ্যেই মনের মতো কেউ কেউ। মনে আছে তখন আমাদের একটা বেস্ট ফ্রেন্ড বেস্ট ফ্রেন্ড খেলা ছিল। পাল্টে যেত সেই মুখটা মাঝে সাঝেই, রাগে অভিমানে। আবার ফিরে ফিরে আসতো। ক্লাস টেন থেকে টুয়েলভ অবধি, এভাবেই হুশ করে কেটে গেছে। সেই মুখগুলোর অনেকেই প্রথম জন্মদিনের উপহার, প্রথম ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড, প্রথম মিউজিক্যাল গ্রিটিং কার্ড-এর সাক্ষী। সেইসব মুখ এখনও সাফল্যে একইভাবে হাততালি দেয়, হতাশায় হাত বাড়ায়।
টিউশন পড়তে গিয়ে প্রথম ছেলে বন্ধু। সেই দলে বিভিন্ন স্কুলের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশে জানতে শেখা নতুন অনেক কিছু। বই, ক্যাসেট দেওয়া-নেওয়ার মধ্যেই কখন মন দেওয়া-নেওয়াও। ঝগড়া-কথা বন্ধ, ভাব হলে হাপুস নয়ন। সাইকেল চড়ে চষে ফেলা মফস্বল। এইসব বন্ধুত্ব চিনচিনে ব্যথার মতো, যতদিন মন থাকবে, ততদিন থেকে যাবে। কলেজ, ইউনিভার্সিটি বুঝিয়ে দিয়েছিল ফ্রেন্ডশিপ বুঝে শুনে করতে হয়। সবাই বন্ধু হয় না বুঝতে শেখা তখন। তবে যারা হয় তারা থেকে যায়। জীবনের বাকি ওঠা-পড়াগুলোয় কাঁধ, হাত বা একদম পাঁজাকোলা করে তুলে ধরতেও দ্বিধা করে না।
মনে নেই ঠিক কবে থেকে ফ্রেন্ডশিপ ডে এসেছিল আমাদের জীবনে কিন্তু হাতড়ালে আনন্দবাজারে এক-ঝাঁক হাসি মুখের ফটোফিচার আর কুছ কুছ হোতা হ্যায়-তে শাহরুখ-এর হাতে একগোছা ব্যান্ড মনে পড়ে। পকেটমানি জমিয়ে ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড, চন্দ্রবিন্দুর গান, সদ্য বাজারে আসা বাংলা কার্ডের বেমক্কা কবিতায় বেশ মজেছিলাম আমরা, বেশি দামি ব্যান্ডটা বেস্ট ফ্রেন্ড-এর, বন্ধুর চেয়ে একটু বেশি ভালো লাগতে শুরু হওয়া ছেলেটাকে ব্যান্ডের সঙ্গে উপরি দুটো রাংতায় মোড়া চকোলেট, সবাই মিলে টাকা থাকলে মনজিনিস না হলে মুগের লাড্ডু, সেইসব নিয়ে ভেসে ছিলাম বেশ।
আমাদের বাস ভাড়া না দিয়ে নেমে পড়া, কোনোদিন মায়ের মুড ভালো থাকলে এক্সট্রা পাওয়া 10 টাকা, বহু কষ্টে ফুচকাওলাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া সময়গুলো ফ্রেন্ডশিপ ডে উদযাপনের রসদ জুগিয়েছে রোজ। তারপর কবে হুট করে বড় হয়ে যাওয়া টাইপ ট্রানজিশন-টা হল, খেই পাই না। আর বড় হয়ে যাওয়ার তোড়ে দূরে হয়ে গেলাম আমরাও। যতই অর্কুট-এ জড়িয়ে থাকা থাক, ফেসবুকে খুঁজে পাওয়া থাক, ওসবে আর স্কুলের টিফিন, পাশাপাশি সাইকেল, কলেজ কেটে সিনেমা, টিউশন ফেরতা কাঠি আইসক্রিমের গন্ধ থাকে কি! লাইক, কমেন্ট, কেমন আছিস আর হ্ম্ম-তে ফুরিয়ে যায় সময়। আমরা ছড়িয়ে থাকি, আগলে রাখি 3 মাস ধরে প্ল্যান করে একটা বিকেলে রেস্টুরেন্ট ভিজিট-এ “ওমা তুই কত পাল্টে গেছিস” বা “মনে আছে আমাদের সপ্তমীর বিকেল”-এর মতো খড়কুটো।
বড় বয়েসের বন্ধুরা জীবনে জায়গা করে নেয় একটু অন্যভাবে। তারা থাকে, দূরে হোক বা কাছে, কথা শেষ না হতে চাওয়া ফোন কল-এ, দিন-রাতের হিসেব উল্টে দেওয়া স্কাইপে, বছরে একবার দেখা পাওয়ায়। আবার পাশের ডেস্কে, লাঞ্চের টেবিলে, ডেডলাইন নিয়ে ঝগড়ায় যখন বন্ধ দরজায় ধাক্কা লাগে, বন্ধুত্বের গল্প লেখা হয় অফিসের পর কফিশপে, শনিবারের আড্ডায়, গ্রুপ ট্রিপ-এ বা ওয়ার্ক ফর্ম হোম-এর টিমস-এ। এদের সঙ্গে ছেলেবেলা নেই কিন্তু ছেলেমানুষি এখনও আছে। ফ্রেন্ডশিপ ডে-র বাড়াবাড়ি নেই, লাইফ হ্যাকস-এর লিস্ট আছে, অহেতুক কথা বন্ধ নেই, অকারণে ট্রিট আছে। এই লকডাউন-এও এরা ডাউন হতে দেয় না একদম।
কোথাও পড়েছিলাম 7 বছর ধরে বন্ধু-টন্ধু থাকলে বন্ধুত্ব ভাঙার চান্স কমে আসে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হারানোর ভয় তাই কমেছে। কাছে হোক বা দূরে, ছায়া হয়ে থাকাগুলো বেড়েছে। বছর বছর ফ্রেন্ডশিপ ডে নিয়ে মাতামাতি থাক আর না থাক আমাদের বন্ধুভাগ্য ভালো থাক। হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়ার উচ্ছাস থাক। গালাগালি, গলাগলিগুলো ননস্টপ মেমরি কার্ড ভরুক।