বেনারস-এর প্রতি টান আমার ছবি দেখে। পরিচিত ফটোগ্রাফার দাদাদের ছবি মনে মনে ওই জায়গাটায় টেনে নিয়ে গেছে কতবার। অবশেষে ভ্যাগের শিকে ছিঁড়েছিল বিয়ের পর, দুপক্ষের মা-বাবাদের সঙ্গী করে। আর যেমন-তেমন সময় নয়, একেবারে দেব দীপাবলির সময়। বারাণসী তখন আদতেই দেবতাদের। হাজার প্রদীপ শিখায় আলোকিত ঘাট থেকে ঘাট। সেদিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকতে থাকতে সত্যিই মনে হয় ‘মাটিতে আজ স্বর্গ এসেছে নামি’।
রাস্তাঘাট একটু নোংরা হলেও বারাণসী জায়গাটার একটা টান আছে, গঙ্গার তীরের আরাম আছে। ঘড়ির দিকে তাকানোর প্রয়োজন নেই, ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে চলা বা বয়ে চলার তৃপ্তি আছে। আর যাদের লস্যি, রাবড়ি, মালাই দেখলে স্যালাইভা চঞ্চল হয়ে ওঠে তাদের টেস্ট বাড-কে খুশি করার মতো অনেক সম্ভারও আছে। তবে এ লেখা বারাণসী বেড়ানো বা ওখানকার খাওয়ার ঠেকের খবর দেওয়া নিয়ে নয়, বারাণসীর উৎসবের অংশ হওয়া নিয়ে। প্রতি বছর বেনারসে দেব দীপাবলির আয়োজন হয় কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে, মূলত নভেম্বর-ডিসেম্বর-এ দীপাবলির 15 দিন পর। অর্থাৎ এই দীপাবলি হয় পূর্ণিমার রাতে। বারাণসীর ঘাটে ঘাটে জ্বলে ওঠে হাজার হাজার মাটির প্রদীপ। কথিত আছে, এই তিথিতে ভগবান শিব ত্রিপুরাসুর পরাজিত করেছিলেন। তাঁর এই জয়ের উদযাপনে দেবতারা ভগবান শিবের স্থান কাশী-তে নেমে আসেন গঙ্গাস্নান করতে। দেবতারা এ দিন দীপাবলি পালন করেন বলেই এই উৎসবের নাম দেব দীপাবলি। সাধারণ মানুষও এ সময় বেনারসের ঘাটে পুণ্যস্নান সারতে আসেন দূর-দূরান্ত থেকে। বিকেলে ঘাট সাজে প্রদীপে, ঘরে ঘরে জ্বলে ওঠে সলতের আলো। দ্বশাশ্বমেধ ও রাজেন্দ্রপ্রসাদ ঘাট সংলগ্ন গঙ্গার পাড়ে বাঁধা হয় স্টেজ, চারদিকে থাকে বাহারি আলো, রঙিন ফুল, শিকলি, মালা। মানুষের ভিড়ে সেখানে পা ফেলা দায়। সারি সারি নৌকোয় দর্শনার্থীদের ভিড়। মঙ্গলারতির মধ্যে দিয়ে বন্দনা হয় মা গঙ্গার। সন্ধ্যা নামলে ঘাটে ঘাটে চলে আরতি। আতশবাজির রোশনাইয়ে রঙিন লাগে আকাশ। রাস্তায় বের হয় প্রসেশন।
2015-এ দেব দীপাবলি পরেছিল 25 নভেম্বর, আমরা কলকাতা থেকে রওনা দিয়েছিলাম 22 নভেম্বর রাতের ট্রেনে। প্ল্যান ছিল গিয়ে বেনারসে অলি-গলি, বাঙালি টোলা, কাশী বিশ্বনাথ মন্দির, সঙ্কটমোচন মন্দির, সারনাথ দেখে নেব গঙ্গার ঘাটে দীপাবলির রোশনাই দেখার পাশাপাশি। বেনারসের বেসিক ট্যুর ডিটেলস আর দিচ্ছি না, ওটা মোটামুটি সব ট্রাভেল এজেন্সির পেজ-এ সহজলভ্য। তার চেয়ে দেব দীপাবলির গল্পটা মনে রাখার মতো। চেনা বেনারসের চেয়ে আলাদা, আলোয় মাখামাখি এক নতুন অচেনাকে চেনা। আগেই বলে রাখছি দেব দীপাবলিতে বেনারসে খুব ভিড় হয়। কার্তিক পূর্ণিমার 4 দিন আগে একাদশীর দিন থেকে শুরু হয়ে এই উৎসব শেষ হয় দেব দীপাবলির দিন অর্থাৎ পূর্ণিমার দিন। দেশ বিদেশের বহু জায়গা থেকে মানুষ জড়ো হয় ঘাটের মনোরম সৌন্দর্য দেখা ও পুণ্যার্জনের আশায়। তাই হোটেল বুকিং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেরে ফেলা দরকার। ট্রেনের টিকিটেরও হাল একই থাকে। তবে বাস বা গাড়িতে রোড ট্রিপও করা যেতে পারে তেমন অসুবিধে না থাকলে। তবে দ্বশাশ্বমেধ ঘাট সংলগ্ন গদলিয়া চত্ত্বরে ভিড়ের চোটে হাঁটা দায় হয়ে দাঁড়ায়। দ্বশাশ্বমেধের আরতি দেখার ইচ্ছে থাকলে গদলিয়ার কাছাকাছি হোটেল-এ থাকা সুবিধাজনক। এ ঘাটের আরতি সবচেয়ে বড়। তবে এসময় অন্যান্য ঘাটগুলিতেও বড় করে আরতির আয়োজন হয়। তবে দ্বশাশ্বমেধের কাছে থাকার আর একটা সুবিধা বিশ্বনাথ মন্দির এবং ভালো খাবারদাবারের জায়গাগুলো কাছেই। সিঁড়ি ভাঙায় সমস্যা না হলে গঙ্গার তীর বরাবর হোটেলগুলোয় থাকা সবচেয়ে ভালো। নিজের ঘরে বসে গঙ্গার সেজে ওঠা দেখার সুযোগ এখানেই পাওয়া যাবে। তবে এ সময় ভাড়া একটু বেশির দিকেই থাকে। আর ঘাটের ওপরের হোটেলের ডিমান্ডও বেশি থাকে। তাই অনেক আগে থেকে বুকিং করা না থাকলে জায়গা পাওয়া মুশকিল। ভিড়ের মধ্যে একটু নিরিবিলি চাইলে অসি ঘাটের দিকে থাকা ভাল। ইদানিং বিদেশি পর্যটকদের এদিকটা পছন্দ হওয়ায় বেশ কন্টিনেন্টাল খাবারের রমরমা হয়েছে। থাকা যেখানেই হোক প্রদীপ দিয়ে আলপনা 7 কিমি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত 87টি ঘাটেই কম-বেশি দেখতে পাওয়া যাবে। আর ঘাট বরাবর হেঁটে হেঁটে এই আলোর সাজ দেখার যা সুখ, কিলোমিটারের কথা খেয়ালই থাকবে না।
সে বার বেনারস পৌঁছে থেকেই উৎসবের তোড়জোড় দেখেছি। রাস্তায় ভিড়, পুণ্যার্থীদের ঢল, নৌকো চড়ার দরদাম, খাবার দোকানে লাইন শুরুতেই বুঝিয়ে দিয়েছিল এটা অন্য বেনারস। যেদিন গেছি সেদিন থেকেই দেখেছি ঘাটে ঘাটে আলোর উৎসব। সিঁড়ির ধাপে ধাপে মাটির প্রদীপ জ্বালানোর ভিড়। যে কেউ এসে জ্বালাতে পারে প্রদীপ। দেব দীপাবলির দিন সাজগোজের বহর ছিল সবচেয়ে বেশি। দুপুর থেকে নানান ডিজাইনের আলপনার ওপর প্রদীপ সাজানো শুরু হয়ে গিয়েছিল। আলো কমে যেতেই সবাই জড়ো হয়েছিল মোমবাতির প্যাকেট নিয়ে। আমিও অংশ নিয়েছিলাম প্রদীপ জ্বালানোয়। সন্ধে নামার পর যখন সব ঘাট আলো ঝলমল করছে, সে দৃশ্য দেখে মনে হয়েছিল সত্যিই বুঝি দেবতারা নেমে এসেছেন মাটিতে। প্রতিটা সিঁড়িতে আলোর মালা, কোথাও ফুলের নকশা, কোথাও রঙ্গোলি, ঘাটের কার্ভ ধরে তাকালে আলোর রেখাদের কেঁপে ওঠা চোখে ধাঁধা লাগায়। অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকলে খালি চোখেই আলোর bokeh হয়ে যায়। গঙ্গার দিকে তাকালে দেখা যাবে দূরে নৌকা থেকে কেউ নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে ভাসিয়ে চলেছে একটা একটা প্রদীপ, সেই প্রদীপের রেখা জলের মধ্যে দিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে কোনও নাম না জানা ঠিকানায়। ঘাটের কাছে মহিলারা জলের মধ্যে পা ডুবিয়ে প্রদীপ ভাসাচ্ছেন, সেই স্হানীয় প্রদীপের মধ্যে থাকা ফুল আর মোমের প্রদীপ জলের আলতো ঠেলায় দুলে দুলে ভেসে যাচ্ছে। কতদূর চলে গিয়েও সে আলো চিলতে রেখার মতো ভেসে চলছে তো চলছেই। দূরে ভেসে যাওয়া নৌকার মাথার ওপর পূর্ণিমার চাঁদ ঝলমল করছে। হঠাৎ দূরের কোনও ঘাট থেকে আকাশ আলো করা আতশবাজির রোশনাই বা ওড়ানো আলোর ফানুসের ভেসে যাওয়া দেখতে দেখতে খেয়াল থাকবে না রাত কত হল।
দেব দীপাবলির দিন অনেক পর্যটকদের মধ্যে নৌকা নেওয়ার চল আছে। এসময় নৌকা অবশ্যই আগে থেকে বুক করে রাখতে হবে। এ দিন ভাড়া থাকে আকাশ-ছোঁয়া। বছরে একদিন যে যেমন পারে কামিয়ে নেয়। আছে অনেক লোক একসঙ্গে বসে দেখতে পারার মতো বজড়াও। সেখানে শেয়ার-এ চড়া গেলেও ভাড়া চড়া-ই। নৌকাও শেয়ারে নেওয়া যায়, কিন্তু তার জন্য গিয়ে জুতসই লোক খুঁজে পাবার মতো ভাগ্যবান হতে হবে। অন্য সময় গেলে যেখানে ঘণ্টায় 150-200 টাকায় ঘোরা যায়, দেব দীপাবলির দিন শেয়ার নৌকাতে হাজার-দেড়হাজারও কম শোনাবে। 5-6 হাজার ভাড়া এমনিই হাঁকবে কম-বেশি সব নৌকাই। তবে আমার ব্যক্তিগত মত নৌকার চেয়ে পায়ে হেঁটে দেখার মজা বেশি। গঙ্গায় ভেসে থেকে সব ঘাটের আলো জ্বলা দেখা যাবে বটে কিন্তু কাছাকাছি তো যাওয়া যাবে না। এত নৌকা থাকবে, ভাসার চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকাই হবে বেশি। বিশেষ করে আরতির সময় দ্বশাশ্বমেধ ঘাটে এত ভিড় থাকে লোকের মাথার রেখা ছাড়িয়ে নৌকা থেকে আরতির কতটুকু দেখা যায় তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তার চেয়ে ঘাটে গিয়ে সামনে থেকে প্রদীপ জ্বলতে দেখা বেশি মনরোম বলে আমার মনে হয়েছে। আমরা আগের দিন নৌকাবিহার সেরে নিয়েছিলাম। দেব দীপাবলির দিন বিকেল থেকে রাত আলোয় ভাসতে ভাসতে অসি ঘাট, সিন্ধিয়া ঘাট, রাজ ঘাট, মুন্সি ঘাট, মনিকর্নিকা ঘাট, দারভাঙ্গা ঘাট, মানমন্দির ঘাট, দ্বশাশ্বমেধ ঘাট পায়ে হেঁটে ঘুরেছি। মাথার ওপর আতশবাজির ফেটে পড়া, পঞ্চপ্রদীপ নিয়ে আরতি দেখেছি ঘাটে ঘাটে। দ্বশাশ্বমেধে যখন উৎসবের উপচে পড়া ভিড় তখন মনিকর্নিকার বাঁধানো পারে প্রদীপের নিচের অন্ধকারে জ্বলতে থাকা মৃতদেহের লাইন, সৃষ্টি আর সমাপ্তির এমন সহাবস্থান এত কাছ থেকে দেখিনি কখনও।
এরপর আলোর রাজ্যে ধীরে ধীরে রাত নেমেছে, ভিড় কমে এসেছে, বাবা-মা’রা ফিরে গেছে হোটেল-এ। আমরা দুজনে বসে থেকেছি নাম না জানা কোনও এক ঘাটে। তাকিয়ে থেকেছি দূরে ভেসে যাওয়া নৌকার দিকে। তখন মাঝিরা ঘাটে নৌকা বেঁধে সারাদিনের হিসেব কষছে। কিছু মানুষ ইতি-উতি ঘুরছে। সন্ন্যাসীর সঙ্গে একদল বিদেশি গাঁজা নিয়ে বসেছে। তাদের হাহা-হিহি কানে আসছে। দূরে বয়ে চলা প্রদীপের আলোর রেখা তখন মৃদু। একদল বাবাজি ছাই মেখে হেঁটে চলে গেল পার দিয়ে। তেল কমে আসা প্রদীপ জ্বলছে টিম টিম করে। দূরে একটা ফানুস ছোটো হতে হতে হারিয়ে যাচ্ছে। চাঁদটা যেন চেয়ে আছে আমাদেরই দিকে। কতক্ষণ বসেছিলাম মনে নেই, উৎসব শেষের আলোটুকু নিভে আসার আগে বাঙালি টোলার আলো আঁধারী রাস্তা ধরে ফিরেছিলাম রুম-এ। সঙ্গে নিয়েছিলাম যত্নে রাখার মতো অভিজ্ঞতা।
বি.দ্র. – এ বছর দেব দীপাবলি ছিল 29 নভেম্বর, মানে গতকাল। এ বছর সবই অন্য সব বছরের চেয়ে আলাদা। উৎসব আছে, কিন্তু কোলাহল কম। আলো আছে, কিন্তু রোশনাই কম। মনটা তাও প্রতিবারের মতোই চলে গিয়েছিল বেনারসের ঘাটে, ফিরে আসা স্মৃতিদের হাত ধরে।