শীতকাল মোটামুটি অনেকেরই প্রিয়। লেপের আদর জড়িয়ে পরে থাকা, পিঠে পুলি, নতুন গুড়, ঘুড়ি, বিয়েবাড়ির খাওয়া, মেলার মাঠ, ময়দানের ভোর, রোদের সঙ্গে সখ্যতা এসব নিয়ে শীতে আমরা বেশ থাকি। কিন্তু গোল বাঁধে শীত আসা আর যাওয়ার সময়টায়। পাখা আজ চালাব নাকি কাল থেকে, বা চাদরটা গায়ে দিলে গরম, খুলে ফেললে ঠান্ডা, অটোয় হাওয়া খেতে ভালোলাগা, আর হাওয়া লেগে গেলে এন্টিবায়োটিক-এর কোর্স কমপ্লিট না করে নিস্তার না পাওয়া, এ বড় বিষম জ্বালা।
ছোটবেলা থেকেই এই আসা-যাওয়ার সময় টায় শীত আমাকে জানান দিয়ে যায়, মানে হয় গলার শব্দ কদিনের জন্য জব্দ হয়ে যায় বা কদিনের জন্য লেপের তলায় সেঁধিয়ে থাকাটাই ডেসটিনি হয়ে যায়। যতই চেষ্টা করি আমার শীতের সঙ্গে ডিলিং-টা ঠিকঠাক হয় না কোনও বারই। ছোটবেলায় নিচের ঘরে ঠাকুমার কাছে ঘুমোতাম। পাখা চালানো নিয়ে অনেক সাধ্যসাধনা করেও বাবার কাছে পারমিশন মিলতো না। সবাই দোতলা, তিনতলায় উঠে গেলে ঠাম্মা নাক ডাকতে শুরু হওয়া অব্দি ওয়েট, তারপর টুক করে পাখার সুইচ অন। ঠিক একইভাবে আমি ঘুমিয়ে গেলে ঠাম্মাও কিভাবে যেন টের পেয়ে পাখার সুইচ অফ করে দিত। আমার ঘুম তাতে ভাঙতো না রোজ। তবে যেদিন ভাঙতো একই জিনিসের রিপিটেশন হত আবার! কিন্তু আমাদের একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল, এ খবর বাবা অবধি পৌঁছয়নি কখনোই।
মাধ্যমিকের সময় থেকে রাত জেগে পড়ার স্টাইলটা এডপ্ট করার শুরু, মায়ের সঙ্গে শোয়ারও শুরু। একতলা থেকে দোতলায় উঠে দেখলাম ভীষণ বিপত্তি। মায়ের আমার শীত পরার এক মাস আগে থেকে শীত করে আর শীত যাওয়ার এক মাস পর অব্দি ঠান্ডা লাগে। আমার হল মহা জ্বালা। আমি পাখা চালালেই মা খাপ্পা। স্বার্থপ্পর দিয়ে শুরু হয়ে সে অপবাদ কোথায় কোথায় যে যেত তার ইয়ত্তা নেই। মনে চরম অশান্তি নিয়ে শীতের ওপর রাগ করতাম। গল্পের বই বা ডায়রির পাতা উল্টে মনকে অন্যদিকে মজিয়ে রাখার চেষ্টা করা ছাড়া উপায় ছিল না। এমনকি অল্প করে পাখা চালানো শুরু হওয়ার পরও মা যখন আমার থেকে অনেক আগে ভোরবেলা উঠে ঘর থেকে চলে যেত পাখা টা বন্ধ করে দিয়ে যেত! কারণ, ভোরের ঠান্ডা নাকি লেগে যায়! তাকে কি করে বোঝাই, তোমার লাগে, আমার না! আর শীতও তেমন যন্তর সিজন। ওই পাখা অন অফের মধ্যে, সোয়েটার গলানো না গলানোর মধ্যে কখন যে হালকা টাচ দিয়ে যাবে সে ফিরিস্তি রাতে আমার কাশির চোটে মায়ের ঘুম বিগড়লে হাজার কথা শোনানোয় গিয়ে থামবে! শীত, মা আর আমি’র লড়াই বিয়েবাড়ির সময় সাল-সোয়েটার নেওয়ায় এলার্জি থেকে ‘যা ভালো বুঝিস কর’ হয়ে মাঝে সাঝেই ছোটখাটো ভাইরালে গিয়ে থেমেছে।
মনে আছে স্যারের বাড়িতে পড়তে গিয়েও পাখা অন-অফ নিয়ে আমার সঙ্গে স্যার-সহ অন্যান্যদের বিরোধ ছিল দেখার মতো। সেখানেও সংখ্যালঘু হয়ে হেরে গেছি বার বার। জোড় খাটালে স্যার বলেছেন, মন টা ঠিক করলেই নাকি গরম লাগবে না। আমি এখনও সে যুক্তির কোনও উত্তর খুঁজে পাইনি। উল্টে নিজেকে প্রশ্ন করেছি শরীর আর মনের এমন সমান্তরাল মিল কেন জীবনের অন্যক্ষেত্রে পাই না!
ভেবেছিলাম বিয়ে করে বর ভ্যাগে বোধহয় আমার শীতের ট্রানজিশন পিরিয়ড-এর হয়রানি যাবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি দিয়ে একটা শীতকাতুরে, ওভারপ্রটেক্টিভ ছেলেই জুটল। সে মাঝে মাঝে অতিরিক্ত কেয়ারিং হয়ে গিয়ে মাঝ রাতে গায়ে কম্বল চাপা দিয়ে দেয়, আর আমি ঘেমে নেয়ে উঠে দেখি সে পরম আরামে কম্বল জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। পাখা নিয়ে অশান্তি করে পার পাই না, কারণ কষ্টে সিষ্টে জিতে যাওয়ার দিনটাতেই শীত মোক্ষম চড়টা মেরে আমার গলায় ফ্যারিনজাইটিস দিয়ে যায়! তারপরের সাংসারিক অশান্তি সংসারে থাকাই ভালো।
এহেন আমি এই এতোগুলো বছর পেরিয়ে এসেও শীতের খাওয়া-দাওয়া, সাজা-গোজা, পার্টি-পিকনিক-এর আহ্লাদ ছাপিয়ে লড়ে যাচ্ছি। বেডসিট দিয়ে কম্বলটাকে রিপ্লেস করব কি করব না, পাখা ঘুরবে কি ঘুরবে না, অটোয় চড়ে কান ঢাকব কি ঢাকব না, রাজারহাটের দিকে গেলে জ্যাকেট লাগবে কি লাগবে না, সোয়েটারগুলো কেচে তুলে ফেলব কি ফেলব না, এসবের মাঝে একটা দুটো দমকা হাঁচি পজ দিয়ে যাচ্ছে।