খেতে আমি খুব ভালবাসি আর আমি খেতে পেলে আমায় আর কেউ পায় না। পন্ডিচেরি ট্রিপ-এ ঘোরার সঙ্গে খাওয়াটাও শুরু থেকেই প্রায়োরিটি লিস্ট-এ ছিল। শান্ত নিরিবিলি হোয়াইট টাউনের অলি-গলি দারুণ সব ক্যাফে আর রেস্টুরেন্ট-এ ভর্তি। একে দুদিনের ট্রিপ, তার ওপর অজস্র প্ল্যান, আগে থেকে রিসার্চ করে রীতিমতো হোয়্যার টু আর হোয়্যার নট টু গো-এর লিস্ট বানিয়ে নিয়েছিলাম। গেস্ট হাউসে হাউজফুল ব্রেকফাস্ট-এর আয়োজন থাকায় ওই পার্ট-টা বাইরের খাওয়া থেকে বাদ রাখতেই হয়েছিল, কিন্তু বাকি সকাল-দুপুর-বিকেল-সন্ধে-রাতগুলো খাই খাই করে কয়েক কিলো ওজন বাড়িয়ে ফিরেছি আমরা দুই বন্ধুতেই।
আমাদের এয়ারপোর্টে দেখা হওয়ার পর অন দ্য ওয়ে খাওয়া শুরু হয় চেন্নাইয়া ইডলি আর ঠান্ডা বড়া দিয়ে। পন্ডি পৌঁছতে পৌঁছতে খিদে পঞ্চমে। প্রথমেই থিন ক্রাস্ট পিৎজার লোভে খটখটে রোদে অটো ধরে পৌঁছে গিয়েছিলাম ক্যাফে এক্সটাসি, মিশন স্ট্রিট-এ। এটি নিখাদই ভালো পিৎজার জন্য বিখ্যাত। এখানে বেশি সময় কাটিয়ে লাভ নেই কারণ পন্ডিচেরির ইউএসপি ভিজুয়াল ট্রিট এখানে একেবারেই নেই। বিয়ার পাওয়া যায় কিন্তু আমাদের তো সেটা খাওয়ার জন্য অম্বিয়ান্স চাই। তাই ঠিক হয়েছিল পিৎজা খেয়ে আবার অন্য কোথাও বসা হবে। মেনু কার্ড খুঁজে পর্ক পিৎজা অর্ডার দিতে গিয়ে জানলাম নিপা ভাইরাসের ভয়ে পর্ক সাময়িকভাবে বন্ধ, অগত্যা চিকেনের ওপর ভরসা রেখে অর্ডার দিয়ে দিলাম একটা মিডিয়াম পিজালিয়াস পিৎজা, টপিং-এ চিকেন, হ্যাম, মাশরুম, বেলপেপার, অনিয়ন, ক্যাপসিকাম, অলিভ, ফ্রেশ ক্রিম। মিডিয়াম হিসেবে এখানে সাইজ বেশ বড়। চিজে ঠাসা থিন ক্রাস্ট পিৎজা কোল্ড ড্রিঙ্ক সহযোগে ভালোই লাগল খিদের মুখে। তবে এক্সটাসির যত প্রশংসা শুনেছিলাম তাতে তৈরি হওয়া বেঞ্চমার্ক এই পিৎজা ঠিক ছুঁতে পারল না।
ওখানে বসেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল নেক্স ডেস্টিনেশন করোমণ্ডল ক্যাফে। কিন্তু এতো জায়গায় খেতে আর চড়তে গেলে অটোর ভরসায় থাকলে চলবে না। তাই দুটো সাইকেল ভাড়া নিয়ে এক্সপিডিশনে ইন্ধন জোগানো গেল ভালোই। অলি-গলি ঘুরে আমরা এসে পৌঁছলাম শ্যাওলা রঙা ইয়া লম্বা দরজাওলা ক্যাফে-তে। হালকা গোলাপি দেওয়াল, শ্যাওলা সবুজ দরজা, দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলে বাঁদিকে গাছপালা ঘেরা ওপেন এয়ার বসার জায়গা ডানদিকে লাল সিঁড়ি উঠে গেছে খোলা দালান পেরিয়ে এসি ঘরে। গরমের দুপুরে এসি-ই ভালো তাই কাঁচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে হলুদ আলোর নিচে এলিয়ে বসলাম। ভিতরটা থিম মাথায় রেখেই শ্যাওলা সবুজ আর সাদায় সাজানো। সবুজ দেওয়ালে তুলির টানে আঁকা সাদা পাতাবাহার, আবার অন্য ঘরে একব্বারে নির্ঝঞ্ঝাট সাদা জানলা-দেওয়াল, এসি ঢাকা শ্যাওলা রঙের পোচে, বাহারি ঝাড়বাতিতে মায়া আলো। বেশ বসে থাকা যাওয়ার মতো থিম। এদিকে পেট ভর্তি, আর খানার চেয়ে পিনার টান বেশি। চিলড বিয়ার আর ব্যাম্বো আইল্যান্ড ক্রানচি কালামারি অর্ডার করা হল। বিয়ারে গলা ভিজিয়ে মনও ভিজল। আলতো ব্যাটারে মুচমুচে স্কুইড ভাজা, সঙ্গে স্যালাড আর টার্তার সস, বিয়ারের সঙ্গে জমে গেল। আরও অনেক লোভনীয় নাম মেনুতে থাকলেও পিৎজার চাপে আর কিছু খাওয়া গেল না। অম্বিয়ান্স অনুযায়ী করোমণ্ডল ক্যাফে বেশ ঠিকঠাক দামের, এখানে না খেলে লস।
বেরিয়ে গেস্ট হাউজে যাওয়াই উদ্দেশ্য ছিল কিন্তু রাস্তায় ইট মাই কেক বেকারি দেখে চাকা আটকে গেল। এত মিষ্টি দেখতে দোকান হলে না ঢুকে থোড়াই যাওয়া যায়! সাইকেল পার্ক করে পিঙ্ক আর লেমন ইয়েলো রঙের দরজা ঠেলে ঢুকলাম ভিতরে। এটি একটি স্বনির্ভর উদ্যোগ। স্থানীয় মহিলারা এখানেই সব ডেজার্ট ঘরোয়াভাবে বানান, হোম বেকিং কনসেপ্ট। ঢুকেই লেমন পাই-টা মনে হল ডাকছে। ওটার সঙ্গে কাউন্টারের মহিলার সাজেশনে অর্ডার দিলাম গ্লুটেন ফ্রি চকোলেট ফনডেন্ট কেক। বসে খাবার জায়গা ওপরে। গোলাপি দরজা ঠেলে সরু সিঁড়ি, পাশে হলুদ দেওয়াল। দোতলায় ওঠার মুখে দেওয়াল জুড়ে আঁকা সেলফি ফ্রেম। ওপরটা ছিমছাম, কাঠের রঙিন টুল-চেয়ার, একপাশে সোফা, কাঁচের জার, টিনের গ্রেটার-এর ভিতর থেকে ঝোলানো হোমমেড আলো। উপরে উঠে রাস্তার দিকে মুখ করা চেয়ারে বসলাম। চোখ জুড়ে শুধু সামনের হলুদ বাড়ির মাথার ঝাঁকড়া বগেনভেলিয়া আর মেঘলা আকাশ। এরকম জায়গা পেলে বসেই কাটিয়ে দেওয়া যায়। পাই আর কেক এসে গেল কিছুক্ষণেই। পাই টায় লেবুর ভাগটা একটু বেশি লাগল। ফনডেন্ট কেক বেশ ভালো। কফি, কেক, ব্রেকফাস্ট, মকটেল, ওয়াফেল সবই এখানে পাওয়া যায়। দামটা স্বাদ অনুযায়ী একটু বেশির দিকে বলেই মনে হল। কিন্তু গরমের মধ্যেও এরকম ফেয়ারি টেল ব্যাকড্রপে নির্ঝঞ্ঝাট বসে ছবি এঁকে যাওয়া, বই পড়া বা শুধু চোখ মেলে তাকিয়ে থাকার জন্য ওই দামটুকু নগন্যই বলা চলে।
লাঞ্চ করতে বেরোনো দুই ভবঘুরে গেস্ট হাউসে ফিরলাম সাড়ে পাঁচটায়। বাকেট লিস্টের তিনটে জায়গা একবেলায় টিক দিয়ে ফেলেছি, আনন্দ ধরছে না। লাঞ্চে বসেই ঠিক করে ফেলেছিলাম দেখতে সুন্দর জায়গা ছাড়া যাব না। সন্ধের পর সমুদ্রের পাড়ে বসে ডিনার-এ কম্পিটিশন-এ থাকা রেস্টুরেন্টগুলো নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করে ঠিক করলাম ভিলা শান্তি। সাড়ে আটটা নাগাদ গিয়ে দাঁড়ালাম ফ্রেঞ্চ আর্কিটেকচারের সামনে। ধূসর সবুজ আর সাদা রং, বাইরেটা আলোআঁধারী, দুপাশে দুটো লন্ঠন জ্বলছে। ভিতর থেকে করিডোরে ছিটকে আসছে নরম হলুদ আলো। শান্তি নামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভিতরের বেশিরভাগই সাদা, ভিতরে ওপেন এয়ার বসার জায়গাও আছে, আবার মাথায় ছাদও আছে। তখন ঝিরঝিরে বৃষ্টি, তারওপর গরম। পাখার নিচে বসলাম। একপাশে সোফা, বাহারি কুশন, হেলানো চেয়ার আবার আর একদিকে সাদা টেবিল-চেয়ারে ক্যান্ডেল লাইটে ডিনার-এর ব্যবস্থা। আমরা ক্যান্ডেলাইট-এর সামনে বসে ককটেল অর্ডার করলাম। মেনুতে খুব বেশি অপশন এমনিও ছিল না। খাবারে এল গ্রিলড ফিস উইথ লেমনগ্রাস বাটার্ড রাইস-এর একটা ডিশ ও বিফ স্টেক উইথ পটেটো রিসতো। দুটো খাবারই ভীষণ লাইট। ঝাল মশলা কম। মাছের ডিসটা অল্প টেস্ট করে ভালোই লাগল। স্টেকটা কলকাতায় খাওয়া স্টেক-এর চেয়ে আলাদা। লাইট, জুসি। রিসতো-এর হালকা গ্রেভি-ই সস, আলাদা করে কোনও সস-এর ব্যবস্থা নেই। স্টেক-এর ওপর ফ্রায়েড নুডলস ধরণের কিছু দিয়ে ডেকোরেট করা ছিল, যেটা না থাকলেও চলতো। ম্যাশ পটাটোর জায়গায় রিসতো ব্যাপারটা বেশ ভালো। ফ্রেঞ্চ স্টাইল স্টেক সব মিলিয়ে মন ভরিয়েছিল। ককটেল-এর হালকা নেশায় ডুব দিয়ে ভিলা শান্তি থেকে বেরোলাম 10 টা নাগাদ।
পরদিন সকাল সকাল উঠে সমুদ্র দেখতে দেখতে কফিতে চুমুক দেওয়ার ইচ্ছে নিয়ে হাজির হলাম রক বিচের ওপর লে ক্যাফে-তে। এই ক্যাফে-টার খাবারে অতো বিশেষত্ব না থাকলেও শুধু ভিউ-এর জন্যই একবার ঢুঁ মারতে হয় পন্ডিচেরি গেলে। আমরা সোজাসাপ্টা দুটো ক্যাপুচিনো আর একটা আমন্ড কেক অর্ডার দিয়ে বসে পড়লাম ঢেউ আছড়ে পড়া দেখা যাচ্ছে এমন জায়গা দেখে। একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভাব আছে এই জায়গাটায়। এত সুন্দর ভিউ পেয়ে একটু যদি অন্যদিকগুলোতেও নজর দেওয়া হতো কদর বাড়ত লে ক্যাফে-এর। যদিও সকালে উঠে প্রথম কফিটা হতাশ করে নি। কফির সঙ্গে কেক খেতে খেতে সমুদ্রসফেন এমনিই মন ভরিয়ে দিচ্ছিল। টেস্ট-এর টুকরো ভুল-ভ্রান্তি এমন দৃশ্যের জন্যই এড়িয়ে যাওয়া যায়। প্রাণ ভরে ঢেউ ভাঙা দেখে আমরা ব্রেকফাস্ট-এর জন্য হোটেল-এ ফিরেছিলাম। হোটেল-এর ব্রেকফাস্ট নিয়ে আগেই বলেছি। নানান ফল থেকে শুরু করে হোমমেড ক্রস্যান্ট, জুস, পোহা, ধোসা, অমলেট দিয়ে পেটপুরে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়েছিলাম ডে-ট্যুরে। ঠিক ছিল লাঞ্চ হবে অরোভিল-এ।
অরোভিল পৌঁছনোর আগে চিপস, বিয়ারে গলা ভিজেছিল। ওখানে মাতৃমন্দির ঘুরে এসে ঢুকে পড়লাম তানতো-তে। তানতো-র পিৎজার কথা অনেকের কাছেই শুনেছি কিন্তু আগের দিন দুপুরেও পিৎজা খাওয়ায় আমরা ঠিক করলাম সি ফুড স্প্যাগেটি খাব। বেশ খানিক্ষণ অপেক্ষার পর স্কুইড, প্রণ, জুকিনি, অলিভ, বেলপেপার দেওয়া স্প্যাগেটি খেতে খারাপ লাগল না। চিজের ভাগ কম ছিল। আমরা বলায় আলাদা বাটিতে পারমেসান এল টেবিল-এ। চিজ মিশিয়ে টেস্ট বাড়ল। কিন্তু তানতো ওভারহাইপড লাগল। অরোভিল-এ একটা স্মুদি বার আছে জেনে এসেছিলাম। সেখানে ঢুঁ মেরে দেখলাম বেশিরভাগই হেলথি স্মুদি। আমরা পন্ডি গিয়ে হেল্থ খাবো না ঠিক করেই গিয়েছিলাম, মেনু দেখে বেছে নিলাম ডার্ক চকলেট-এর সঙ্গে বিভিন্ন নাট মেশানো একটা স্মুদি। কেভেন্টার-এর মতো কাঁচের বোতলে স্মুদি নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়েছিলাম। হেলথি স্মুদি ভালো হলেও না খেলে চলবে না এমন নয়। গেস্ট হাউজ ফিরেই তৈরি হয়েছিলাম ডিনার-এর জন্য।
একে এটা শেষ রাত, তারওপর সকাল থেকে বিয়ার আর চিপস ছাড়া দারুণ কিছু পেটে পড়েনি। এমনিও এই রাতটায় রিল্যাক্স করে বুজ আর ডিনার-এর প্ল্যান ছিল। প্লেসও আগে থেকে ঠিক করা ছিল। প্রমেনাড-এর রুফটপ-এ বে অফ বুদ্ধা। খোলা আকাশ, উঁচু থেকে সমুদ্রের ঢেউ-এর আছড়ে পড়া দেখতে দেখতে একটা বিয়ার-এই নেশা হয়ে যায়। পছন্দের জায়গা নিয়ে মেয়েলি বায়নাক্কা করে বসার পর টেবিলে এল গ্রিল স্কুইড তুক মেরিক-পেপার কর্ন, সি সল্ট ও লেমন ফ্লেভার মেশানো স্কুইড স্টার্টার। সঙ্গে বাডওয়াইসার। পন্ডিচেরিতে হার্ড ড্রিংকস সস্তা। হোটেল রেস্টুরেন্টে দাম প্রিন্টেড প্রাইজ থেকে 3 গুণ বেশি হলেও তেমন গায়ে লাগে না। ড্রিংকস-এর সঙ্গে টেবিলে এল চিজ ক্রাকার, স্যালাড, চিনে বাদাম আর প্রণ চিপস। প্রণ চিপস-টা অসাধারণ, কলকাতার মতো নয়, কিন্তু দারুণ খেতে। আমাদের মন বুঝে ওয়েটার-টিও প্রণ চিপস-এর বাটি খালি থাকতে দেয়নি একবারও। অনেকক্ষণ ধরে বিয়ার আর গল্পের রিপিটেশনের পর ডিনারে ইন্দোনেশীয় রাইস বোল নাসি গরেঙ (বিয়ারের গুণে ছবি তোলা বাদ পড়েছে) অর্ডার করলাম। তখন পেটে ক্ষিদে কম, মন ফুরফুরে হাওয়ায় বহুদূর। সি ফুড, চিকেন আর এগ পোচ দেওয়া, স্পাইসি সস-এ টস করা রাইস নাসি গরেঙ বেশ লেগেছিল।
রাত সাড়ে 10 টায় বে অফ বুদ্ধা থেকে বেরিয়ে সাইকেল নিয়ে চলে গিয়েছিলাম সমুদ্রের ধারে জি এম টি-তে ডেজার্ট খেতে। পন্ডিচেরির সেরা আইসক্রিম পার্লার Gelateria Montecatini Terme নিজের গোটা নামের চেয়ে শর্ট ফর্ম জি এম টি-তেই বেশি পরিচিত। উপচে পরা ভিড় ঠেলে গিয়ে দাঁড়ালাম কাউন্টারে। থরে থরে সাজানো নানান ফ্লেভার, ন্যাচারাল ফ্রুট থেকে চিজ, ক্রিম, কফি, চকোলেট সবই আছে। এতোগুলি থেকে বাছা কঠিন, তার মধ্যে ঠেলাঠেলি। দু চারটে টেস্ট করে দুজনের দুটো কোন-এ নিয়ে চলে গেলাম বিচের ধারে। আমারটা মিল্ক এন্ড বেরি আর সঙ্গীতার মিল্ক, আমন্ড ও আমন্ড সিরাপ দেওয়া ফ্লেভার। দাম মোটামুটি 40 থেকে 80-র মধ্যে। দাম হিসেবে পরিমাণ বেশি, প্রায় দু স্কুপ মতো থাকে একটা কোন-এ। দুজন রক বিচে পা ঝুলিয়ে বসলাম কোন হাতে করে। ঢেউয়ের দাপট দেখতে দেখতে গলে যাচ্ছিল আইসক্রিম। টেস্ট ভালো কিন্তু বড্ড বেশি ক্রিমি। অনেকক্ষণ খেতে খেতে শেষের দিকে আর ভালো লাগছিল না, সেটা যদিও পেট ভর্তি থাকার জন্যও হতে পারে। বিচে বসে খাওয়ার জন্য নিয়ে এলে কোন-এর চেয়ে কাপ-ই ভালো, নাহলে জামাকাপড়ে গলে পড়ার রিস্ক নিতেই হবে।
ফেরার দিন সকালে গেস্ট হাউজে ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম ক্যাফে ডেজ আর্টস-এর উদ্দেশ্যে। আমাদের গেস্ট হাউজ থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বের এই ফ্রেঞ্চ ক্যাফে স্টোরটি আমরা শেষ দিনের জন্য তুলে রেখেছিলাম। এখানে যাব বলেই ব্রেকফাস্টটা হালকা করেছি। ক্যাফে ডেজ আর্টস পন্ডিচেরির অন্যতম আকর্ষণ। মোটামুটি এটাতে সকলেই ঢুঁ মারে। ভিতরে ঢুকে না খেলেও বাইরের হলুদ রঙা আর্ট দেওয়ালে পোজ দেওয়া ছবি প্রায় সবার আছে। আমরাও ব্যতিক্রম নই। ক্যাফে দেজ আর্টস একটা ফুলের বাগান ঘেরা বাড়ি। দরজা দিয়ে ঢুকেই রিক্সার ইনস্টলেশন মন কাড়তে বাধ্য। উপরের ছাদ থেকে ঝুলে পড়েছে ঝাঁকড়া ফুলের গাছ। ভিতরে প্যাস্টেল সবুজ চেয়ার, ডেরাজ, বই ঠাসা আকাশি আলমারি, কাঁচের ভিতর থেকে ঝুলে থাকা আলো, ফ্লোরাল কুশন, দূর থেকে উঁকি মারা রজনী স্যারের কাটআউট, ভিন্টেজ ডেকর, আনাচে-কানাচে গুঁজে দেওয়া লেজিনেস। আরাম করে বসে মেনু দেখে অর্ডার করলাম Croque Monsieur আর গ্রিন আইস টি। যতক্ষণে খাবার এল ঘুরে দেখে নিলাম স্টোর। ডিজাইনার ড্রেস, টি-শার্ট, চপ্পল, ইয়াররিং-সাজানো একটা গোটা ঘর। Croque Monsieur একধরণের হ্যাম এন্ড চিজ স্যান্ডউইচ। দুটো পাউরুটির ভিতর চিজ আর হ্যামের টুকরো ঠাসা, উপরেও চিজ দিয়ে মোড়া। সঙ্গে লেটুস ও সসের স্যালাড। এ জিনিস খেতে খারাপ হওয়ার চান্স নেই। তবে সঙ্গের আইস টি-টা মন ভরাতে পারেনি মোটেই। জলের মধ্যে বরফ গোলা, ঠিক করতে বলার পর আরও খারাপ হয়ে গেল ওদের ম্যানেজ দেওয়ার চেষ্টায়। আমাদের হাতে সময় ছিল না বেশি, খাওয়া শেষ করে বেড়িয়ে পড়েছিলাম নেক্সট স্টপ-এর উদ্দেশ্যে।
প্ল্যানিং ছিল সকালে যেখানে যেখানে যাব একটা করে হালকা কিছু খাব। ভিজিট করাটাই এখানে হাই পয়েন্ট। এদিকে পেটে বিন্দুমাত্র জায়গা নেই। কথা মতোই তবু পৌঁছলাম আর্টিকা ক্যাফে গ্যালারিতে। এই ক্যাফে-টায় ছেলেবেলার জলছবি, পাতা ঝরার বিকেল, অগোছালো বইয়ের তাক, যত্নে রাখা পোস্টকার্ড, গল্পের বইয়ের ছেঁড়া পাতা, মনকেমনের দুপুরের গন্ধ আছে। ঢোকার মুখে দুদিকে বাহারি গাছ, ফিকে আকাশি রঙের চেয়ার টেবিল খোলা আকাশের নিচে। আশেপাশে নিজের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গাছ থেকে ঝরে পড়া ফুল, রং বদলে যাওয়া পাতা, দেওয়ালে রং ফিকে হয়ে আসা পেন্টিং। এখানে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানো যায় নিজের সঙ্গে। তখন খুব রোদ, গা পুড়ে যাওয়া গরম। আমরা ভিতরটায় ঢুকে দাঁড়ালাম। এখানে দারুণ সুন্দর রঙিন আসিমেট্রিক শেপ-এর ডবল ডেকার টেবিল। যেন অর্ধেক টেবিলের নীচে থেকে বেরিয়ে আছে আরও অর্ধেকটা। টেবিলগুলোর দুদিকে লম্বা করে সাজানো আরাম চেয়ার। এই উঠোন জাতীয় জায়গাটা পেরিয়ে ভিতরে পর পর ঘর। দেওয়ালে সাদা রঙের ওপর গাঢ় নীল ওঠে গিয়ে অদ্ভুত টেক্সচার তৈরি হয়েছে। ঘরের মাঝে টেবিল সাজানো, কাজ করা দরজা। একদিকের ঘরে জামাকাপড়, পোস্টকার্ড, ঘর সাজানোর খুচরো জিনিসের এক্সিবিশন। পুরো জায়গাটায় একটা মায়া আছে। এখানে আমার বসে থাকতে ইচ্ছে করছিল অনেকক্ষণ। সময়ের অভাব আর সূর্যের দাপটে হয়নি। আর্টিকা তে খাইনি কিছুই, শুধু দেখার জন্যও এই ক্যাফেটা এ লেখায় জায়গা করে নেওয়ার দাবি রাখে।
শেষপাতে ডেজার্ট-টা মাস্ট বলেই চলে গিয়েছিলাম বেকার্স স্ট্রিট। শার্লক হোমসের বাড়ির সঙ্গে সাজগোজে কোনও মিল না থাকলেও লোগো-তে ওনার অবয়ব। ভিতরে তাকে তাকে সাজানো জিভে জল আনা কেক, পেস্ট্রি, পাই, টার্ট, ম্যাকরুন, বান, বেকস। চিজ কেক খেতে ইচ্ছে করছিল খুব। এখানে চিজ কেক বেকড। তাই অর্ডার করা হল। একদম ফ্রেশলি বেকড চিজ কেক বেশ লাগল। কিন্তু ক্রিম চিজ কেক-এর ইচ্ছে টা মন থেকে গেল না। আরও অনেককিছু খেতে ইচ্ছে করলেও পারলাম না।
হাতে সময় তখন একদম নেই। ফিরছিলাম গেস্ট হাউজের দিকে। গাড়ি এসে যাবার সময় হয়ে গেছে প্রায়। রাস্তাতেই চোখে পড়ে গেল জুকা ক্যাফে। এটার কথা জোমাটো-এ পড়েছি। ব্যাস লোভী মন দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল ভিতরে। ডেজার্ট এর লোভটা এই বয়সেও আর সামলাতে শিখলাম না। এখানেও নানান হোমমেড চকোলেট, ব্রাউনি, পেস্ট্রি, কেক-এর হাতছানি। কফি, মিল্কশেক-ও আছে। দেখতে পেলাম রেড ভেলভেট, ব্লু বেরি আর অরিও চিজ কেক পাশাপাশি বসে একই পেস-এ আমাদের ডাকছে। বেশি কিছু না ভেবে অরিও-টাকেই টেবিলে ডেকে নিলাম। ট্রিপ-এর লাস্ট খাওয়াটা জাস্ট জমে গেল। দারুণ টেস্ট-এর চিজ কেকের স্বাদের ভরসাতেই বেরোনোর সময় প্যাক করে নিলাম দুরকম ব্রাউনি, অরেঞ্জ ওয়ালনাট কেক।
চেন্নাই এয়ারপোর্টে যখন পৌঁছলাম জুকা-র প্যাকেট তখনও হাতে। পন্ডিচেরি ঘুরে স্টার্টার টু ডেজার্ট জমিয়ে খাওয়ার মতো তৃপ্তি। চেক-ইন করে একটা জায়গা দেখে বসে প্যাকেটটা খুললাম। আলাদা আলাদা ফ্লাইটে উঠে পড়ার আগে দুই বন্ধুতে একসঙ্গে কামড় দিলাম ভালোলাগায়।