Beijing থেকে আমাদের গন্তব্য ছিল Zhangjiajie. পাহাড় ঘেরা শীত শহর Zhangjiajie, উত্তর পশ্চিম চীনের Hunan province-এ। এখানে মেঘ বৃষ্টির খেলা চলে প্রায় সারা বছরই। ওখানকার লোকজন ছোট শহর বললেও দেখে বোঝার উপায় নেই এ শহর আদৌ ছোট! এয়ারপোর্ট, ট্রেন স্টেশন, হাইরাইজ বিল্ডিং, ২৪ ঘণ্টা খোলা দোকানপাট, ক্যাব সার্ভিস, বড় বড় রেস্টুরেন্ট, কফি শপ সবই আছে। তবে যা দেখতে Zhangjiajie যাওয়া তা এ জায়গার অন্যতম আকর্ষণ Wulingyuan Scenic Area-এ Zhangjiajie National Forest Park-এর সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা লম্বা স্যান্ডস্টোন পাহাড়, যাকে অনেকেই AVATAR Mountain হিসেবে চেনে। এ ছাড়াও Tianmen Mountain, Grand Canyon, স্ট্যালাকটাইট স্ট্যালাগমাইট কেভ, জঙ্গল, ঝর্ণা নিয়ে এ জায়গা খুবই জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পট। তবে যাওয়ার ব্যবস্থা সব জায়গা থেকে ফ্লাইট-এ ছাড়া সরাসরি না থাকায় আর চীনের মূল শহরগুলি থেকে বেশ দূর হওয়ায় অনেকেই Zhangjiajie-কে বেড়ানোর তালিকা থেকে বাদ দেন।
আমাদের চীন যাওয়ার মূল লক্ষ্যই ছিল এ জায়গায় যাওয়া, তাই এখানে প্ল্যান ছিল ৪ দিনের। আগে থেকেই রিসার্চ করে পড়াশোনা করে নিয়েছিলাম কী কী দেখব, কবে কোথায় যাব। অনেকেই Zhangjiajie শহরে থেকেই সব কিছু দেখেন। সব জায়গার বাসই সেখান থেকে উপলব্ধ। কিন্তু আমরা প্রথম দুদিন থেকেছিলাম Wulingyuan-এ, National Park একদম কাছে। বাকি দুদিন Zhangjiajie শহরে। Beijing থেকে Zhangjiajie সরাসরি যাওয়ার ট্রেন নেই। Bejing থেকে ওভারনাইট ট্রেন-এ আমরা গিয়েছিলাম Changsha. Changsha থেকে বাস। Changsha-এ অনেকগুলি রেল স্টেশন। আমাদের ট্রেন যেখানে নামিয়েছিল সেখান থেকে মেট্রো ধরে বাস স্টেশন যেতে হয়। বাস স্টেশন থেকে সকাল ৭ টা থেকে সন্ধ্যে ৭ টা অবধি প্রতি এক দেড় ঘণ্টা অন্তর Jhangjiaie-এর বাস আছে, সন্ধে ৬ টা অবধি। Wulingyuan যাওয়ার বাস দুটি। Wulingyuan-এর বাস সরাসরি না পেলে Zhagjiajie গিয়ে সেখান থেকে সহজেই Wulingyuan-এর বাস পাওয়া যায়। Beijing-এ অনেক ধরণের ট্রেন। G, T, Z, D ইত্যাদি ক্যাটাগরির ট্রেন। G ট্রেন হয় স্পিড, রাতে চলে না। আমরা গিয়েছিলাম Z ট্রেন-এর সেকেন্ড ক্লাস-এর সফট স্লিপার-এ। দেখে অনেকেরই এ দেশের ফ্রাস্ট ক্লাস কূপ মনে হতে পারে। ঝকঝকে পরিষ্কার চারদিক। ট্রেন নির্ধারিত সময়ে ছাড়ে, গন্তব্যে পৌঁছয় সঠিক সময়ে। Beijing থেকে Changsha পর্যন্ত ১৪ ঘণ্টার জার্নি খুব আনন্দেই কেটে গিয়েছিল। Changsha স্টেশন থেকে বেরিয়ে subway ধরার জন্য কোনদিকে যাব তা নিয়ে কিছুটা ধন্দে ছিলাম, কিন্তু এক সুহৃদয় স্থানীয় ব্যক্তি আমাদের খুবই সাহায্য করেছিলেন। শুধু Subway line দেখিয়ে দেওয়াই না তিনি আমাদের নির্ধারিত স্টেশনে নামিয়ে বাস স্টেশন অবধি দিয়ে এসেছিলেন। বাস স্টেশন যখন পৌঁছেছিলাম তখন প্রায় পৌনে ১২ টা। Wulingyuan-এর বাস বেলা আড়াইটে। বাস স্টেশনে অনেক খাবারের দোকান, সার দিয়ে বসার জায়গা। সময় কাটানো তেমন কঠিন ব্যাপার না। বাস ঠিক সময়েই ছেড়ে দিয়েছিল।
পাহাড়, রাস্তা, নদী, দেখতে দেখতে, সন্ধে নামা দেখতে দেখতে, আলোয় সাজানো রাস্তা দেখতে দেখতে সন্ধে সাড়ে ৭ টা নাগাদ পৌঁছে গিয়েছিলাম Wulinguyan. আমাদের হোটেল বুক করা ছিল Booking.com থেকে। হোটেল-এর মালিক Richard নিজেই গাড়ি নিয়ে চলে এসেছিল আমাদের নিতে। Wulinguyan সাজানো-গোছানো ছোট্ট শহর। পাহাড়ের গা ঘেঁষে আমাদের Qing Man Hotel. হোটেল না বলে গেস্ট হাউজ বলা ভাল। মালিক Richard নিজের ফ্যামিলি নিয়ে থাকে নিচের ফ্লোর-এ। উপরের দুটো ফ্লোর-এ গেস্ট রুম। Richard-এর সঙ্গে ইন্ডিয়া থেকেই WeChat-এ আলাপ করা ছিল। খুবই হেল্পফুল, অতিথিবৎসল। National Forest, Grand Canyon-এর টিকিট কেটে দেওয়া থেকে শুরু করে কিভাবে এতো বড় ফরেস্ট পার্ক-এ একদিনে ঘুরবো তার প্ল্যান ছকে দেওয়া, কোথায় খাব, কিভাবে ঘুরলে সুবিধে হবে সব ব্যাপারেই Richard আমাদের সাহায্য করেছিল ভীষণ।
National Forest Park-এর ১ নম্বর গেট-এর কাছেই Qing Man Hotel. আশেপাশে বেশ কিছু ভাল রেস্টুরেন্ট আছে। মাংস, ভাত, ভেজ সবই পাওয়া যায়। পরদিন সকাল সকাল উঠে National Forest Park যাওয়া। আমরা খাওয়া-দাওয়া সেরে তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়েছিলাম। রাত থেকেই শুরু হয়েছিল বৃষ্টি। মনে আশঙ্কা নিয়েই ঘুমাতে গিয়েছিলাম। সাতসকালে উঠে দেখি রেইনি ডে। এ জায়গায় মেঘ বৃষ্টির খেলা চলতে থাকে বেশিরভাগ সময়ই। তাই বৃষ্টি হতে পারে এ আশঙ্কা ছিলই। কিন্তু বারান্দায় গিয়ে বাইরের রূপ দেখে মনে হল এ বৃষ্টি থামার না। টিকিট কাটাই ছিল তাই ৮ টার পর দুজনে বেরিয়ে পড়লাম ছাতা মাথায়।
National Forest Park – Wulingyuan Scenic Area
National Forest Park একটি Unesco World Heritage sight. টিকিট মাথাপিছু ২৩৮ Yuan (২৩৮০ টাকা), টিকিট বৈধ ৪ দিনের জন্য। ঢোকার সময় ফিঙ্গার প্রিন্ট এর সঙ্গে টিকিট সিঙ্ক হয়ে যায়, টিকিট পাঞ্চ করে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিলেই গেট খুলে যায়। ভিতরে ফ্রি বাস সার্ভিস আছে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার। আমরা হেঁটে হেঁটে যখন পার্ক-এর এন্ট্রান্স-এ পৌঁছলাম তখন খুব হাওয়া দিচ্ছে। পাহাড়ের গা ঘেঁষে নেমে আসছে মেঘ। চীনা টুরিস্টদের ভিড় এখানেও। এই পার্কের মধ্যেই রয়েছে পৃথিবীর দ্রুততম ও উচ্চতম Bailong Elivator. হেঁটে ওঠা-নামা ছাড়া এলিভেটর বা Cable Car-এ ওঠানামার ব্যবস্থা রয়েছে। Elivator ও Cable car-এর টিকিট আলাদা করে কাটতে হয়। হেঁটে ওঠা-নামে সময় ও স্ট্রেংথ দুটোই বেশি লাগায় আমাদের প্ল্যান ছিল Cable Car-এ উঠে Elivator-এ নামা।
ঢোকার গেট থেকে কেবল কার স্টেশন বা এলিভেটর দু-জায়গারই ফ্রি বাস আছে। কেবল কার স্টেশন-এর বাসে চড়ে পৌঁছতে সময় লাগলো মিনিট দশেক। কেবল কার যায় Tianzi Mountain (Helong Park) পয়েন্ট অবধি। আঁকা-বাঁকা রাস্তা জুড়ে পাহাড়ের গায়ে মেঘের খেলা। বাস থেকে নেমে একটু হেঁটে কেবল কার-এর টিকিট কাউন্টার। টিকিট আলাদা করে কাটতে হয়। ওঠা বা নামা একটা ট্রিপ ৭২ yuan. বোথ ওয়ে ও একেবারে কেটে নেওয়া যায়, তাতে কিছুটা সস্তা পরে। কিন্তু আমাদের যেহেতু এলিভেটর-এ নামার প্ল্যান আমরা একটা ট্রিপ এর টিকিট কেটে কেবেল কার-এ চড়ে বসলাম। একটা কার-এ ৬ জন বসতে পারে। কাঁচের দেওয়াল দিয়ে দেখা যাচ্ছে খাঁড়াই উঠে যাওয়া লাইম স্টোন-এর পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে ফোলিয়েজ। সবুজ, হলুদ, লাল পাতায় বাহারি সে সাজ। বাইরে বৃষ্টির জেরে ভিজে কেবল কার-এর দেওয়াল, কিন্তু তার মধ্যে দিয়ে দেখা পাহাড়ি সৌন্দর্য অসাধারণ বললেও কম বলা হয়। কেবল কার বেশ লম্বা পথ যায়। খানিক চলার পর দেখলাম পাহাড়গুলো পটাপট ঢুকে পড়ল মেঘ-এর ভিতর। আর কিছু দেখা যায় না তখন। তখনি আমরা পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। Tianzi Mountain সবচেয়ে উঁচু পয়েন্ট। সেখান থেকে ভারী সুন্দর দেখা যায় সার সার দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের মাথা। কিন্তু তখন মেঘ আর কুয়াশার চাদরে সব ঢাকা। কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় দাঁড়ানোর উপায় নেই। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানে। এক দুবার খানিকটা মেঘ সরে এক ঝলক বেরিয়েও পলক ফেলতেই ঢেকে গেল সব।
ঠিক করলাম অবতার পয়েন্ট-এ যাব। Tianzi Mountain পয়েন্ট থেকে আবার বাস। সে বাস পাহাড়ি রাস্তা ধরে নিয়ে চলল খানিক নিচে Avatar Hallelujah Mountain-এ। সুন্দর পাহাড়ি রাস্তায় গাছে গাছে হেমন্তের রং। বাসের সামনে বসে কুয়াশার চাদর ভেদ করে এগিয়ে যেতে যেতে আশপাশ দেখতে ভালোই লাগছে। কিন্তু প্রকৃতি ঠিকই করে রেখেছে মেঘ কুয়াশায় ঢেকে যাবে। তাই Avatar mountains-এ পৌঁছেও কিছু দেখতে পেলাম না। রিচার্ড বলেছিল অপেক্ষা করতে, করলাম। দু একবার মেঘ একটু সরেই ফের ঢেকে গেল। কুয়াশা ঘেরা পথে হেঁটে বেড়ালাম পাহাড়ের দেখা না পেয়ে। দার্জিলিং মনে পরে গেল বার বার।
এদিকে চাইনিজ টুরিস্টদের কোনও কমতি নেই। তারা এমন স্নিগ্ধ জায়গাতেও হল্লা করে চলেছে। খাওয়াদাওয়া সারলাম KFC তে। ফরেস্ট পার্ক-এর ভিতর ম্যাক ডোনাল্ড, কে এফ সি ছাড়াও অনেক লোকাল খাবার জায়গা আছে। ঘোরাঘুরিতে তখন বেলা ৩ টে ছাড়িয়েছে। আমরা ঠিক করলাম নিচে গিয়ে কিছু দেখা পাই কিনা দেখবো। হেঁটে হেঁটে চললাম এলিভেটর-এর দিকে। Avatar point থেকে বেশ খানিকটা হেঁটে যেতে হয় এলিভেটর পয়েন্ট। সেখানে টিকিট কেটে আরও ২ কিমি হেঁটে এলিভেটর-এ চড়া। এলিভেটর-এর টিকিট আলাদা, ৬৮ Yuan. আমরা টিকিট কেটে উঠে পড়লাম পৃথিবীর উচ্চতম ও দ্রুততম এলিভেটর-এ। এলিভেটর-এ অনেক লোক, তার মধ্যেও নামতে নামতে চোখে পড়ল পাহাড়ের গা, গায়ে সবুজ আগাছা। এলিভেটর থেকে বাইরে এসে সারাদিনের মন খারাপ হাওয়া হয়ে গেল!
দেখতে পেলাম সোজা সোজা থাম-এর মতো পাহাড় উপরের দিকে উঠে গিয়ে মেঘের মধ্যে হারিয়ে গেছে। এবড়ো খেবড়ো পাহাড়ের গায়ে ঘন সবুজ। পাহাড়ের মাথাগুলোর ওই শূন্যে হারিয়ে যাওয়া, গাছের ফাঁক দিকে নিরুদ্দেশের দিকে চেয়ে থাকা, ভিজে যাওয়া পাতাদের চিকচিক তখন অসাধারণ। সন্ধে নামা অবধি নীচে ঘুরে ঘুরে পাহাড় দেখলাম। এলিভেটর থেকে নেমে একটা বাসে চড়ে চলে যাওয়া যায় একটা ছোট্ট স্ট্রিম এর দিকে। সেদিকটা ঘুরে নিয়ে সেদিনের মতো বেরিয়ে পড়লাম বাসে চড়ে। অন্ধকার পাহাড়ি রাস্তা ধরে বাস পৌঁছে দিল বেরনোর গেট অবধি। বেরিয়ে ফ্রেশ হয়ে রিচার্ড-এর সাজেস্ট করা রেস্টুরেন্টে জমিয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন Glass Bridge. আবহাওয়া তখনও খেলাপ করছে!
Glass Bridge ও Grand Canyon
Glass Bridge ও Grand Canyon-এর টিকিট রিচার্ড-ই কেটে রেখেছিল। online এ কাটা টিকিট-এর মেসেজ টিকিট কাউন্টারে দেখালেই হাতে টিকিট দিয়ে দেবে। কম্বাইন্ড টিকিট ছিল জনপ্রতি 219 Yuan. বড় ক্যামেরা নিয়ে ঢোকার পারমিশন লাগে, আমরা কোনও ক্যামেরা না নিয়েই বেরোলাম হোটেল থেকে। আমরা চেকআউট করে মালপত্র রেখে বেরিয়েছিলাম । ফিরে আমাদের জানজাজি যাওয়া, রাতের হোটেল সেখানেই। হোটেল থেকে একটু হেঁটেই বাসষ্ট্যান্ড। বৃষ্টি বন্ধ হলেও আকাশ মেঘলা। বাসস্ট্যান্ড এ ঢুকে লোককে বলতেই Glass Bridge এর বাস দেখিয়ে দিল। আমরা চড়ে বসার খানিকক্ষণ পর ছাড়ল বাস। দুপাশে পাহাড়, পাহাড়ি নদী, গাছপালা দেখতে দেখতে মিনিট 40 পর গিয়ে পৌঁছলাম গন্তব্যে। সু কভার পরে ঢুকে পড়লাম। এই প্রথম কোথাও ভিড় কম পেলাম! Glass Bridge নিয়ে exciment এর পাশাপাশি ভয়ও ছিল। কাঁচের ব্রিজ, আদৌ যেতে পারব কিনা ওপর দিয়ে হেঁটে সেসব ভাবনা ঘুরছিল মাথায়। গিয়ে বুঝলাম Youtube এর কল্যাণে যা সব ভিডিও দেখেছি তার মতো ভয়াবহ কিছুই না এ ব্রিজ। অর্কর খানিক অস্বস্তি হলেও আমি দিব্যি হেঁটে চলে বেড়াতে পারছি দেখে নিজের খানিক গর্ববোধ হল বৈকি! ব্রিজ পুরোটা কাঁচের হলেও দুধারে ও মাঝে মাঝে পার্টিশন গুলোয় ট্রান্সপারেন্ট কাঁচ নয়। সুতরাং নিচের দিকে তাকিয়ে খাত দেখতে না চাইলেও দিব্যি হেঁটে যাওয়া যাবে। Canyon এর সৌন্দর্য ব্রিজের ওপর থেকে বেশ। দূরে ঝর্ণা, নিচে খাত। ব্রিজে কিছুটা সময় কাটিয়ে আমরা Canyon এর দিকে নামার রাস্তা ধরে এগোলাম।
আগেও বলেছি চীনে সব জায়গাতেই প্রচুর হাঁটা। Grand Canyon পৌঁছতে আমরা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলাম কখনো পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে, কখনো বা পাহাড়ের গা ঘেঁষে। খাঁড়াই সিঁড়ি কোথাও, কোথাও সোজা পাটাতনের রাস্তা খানিকটা, তারপর আবার সিঁড়ি। মাঝে একখানা লিফট পড়ল। সেটা পাহাড়ের মাঝের অংশ কেটে বানানো। সেটায় চড়ে হাইস্পিড-এ খানিকটা নীচে চলে এসে একেবারে প্রকৃতির কোলে। কখনো পাশে গাছপালা দেখতে দেখতে, কখনো ঝর্ণার বয়ে চলা দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম।
Grand Canyon দেখার জন্য সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলে পুরো রাস্তাটা হেঁটে তারপর শেষ পর্বে বোট এ চড়ে বেরনোর গেট-এ পৌঁছতে হয়। ঘণ্টাখানেকের এই হাঁটা পথ ভারী সুন্দর। পাহাড়ের গা বেয়ে ঝরে পড়া জল, লাইম স্টোন-এর কেভ, নাম না জানা রঙিন পাতার গাছ, স্বচ্ছ নীল জল চোখ জুড়ানো। বোট-এ পৌঁছতে যখন খানিকটা পথ বাকি আরও, ঝির ঝির করে বৃষ্টি নামল। টারকইজ রঙের জলে বৃষ্টির ঝরে পড়া দেখতে দেখতে বোট-এ উঠে পড়লাম। তারপর মিনিট দশেক-এর জলবিহার। সবজে নীল জল, পাহাড়ের গায়ে সবুজ, দূরে সার দিয়ে দাঁড়ানো নৌকা, সাথে টুপটাপ বৃষ্টি, মনের ফ্রেমে অজস্র ছবি পুরে পৌঁছে গেলাম এক্সিট-এ। বেড়িয়ে একটু এগিয়ে দাঁড়িয়ে বাস। এ বাস সোজা Wulinguan বাসস্টেশন-এ নামাবে। তবে ফিরতি পথেই পরবে Yellow Dragon Cave. হাতে খানিকটা সময় আছে দেখে ঠিক করলাম karst formation-এ তৈরি প্রাকৃতিক এই গুহা দেখে নি।
Yellow Dragon Cave/ Huanglong Cave
বাস থেকে মাঝপথে নেমে সোজা চলে গেলাম টিকিট কাউন্টার। টিকিট মাথাপিছু 96 Yuan। টিকিট নিয়ে বেশ কিছুটা হেঁটে যাওয়ার পর প্রবেশ পথ। ঢুকে পড়লাম দুজনে। এখানেও প্রচুর গাইড-সহ চাইনিজ টুরিস্ট-এর ভিড়। 120 একর জায়গায় বিস্তৃত এই গুহা-এ নানাধরণের karst formation-এর পাশাপাশি রয়েছে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া নদী, ঝর্ণা, লেক। আলাদা আলাদা চেম্বার-এ আলাদা ধরণের স্ট্রাকচার। এক এক জায়গায় ছাদ এত উঁচু তাক লেগে যায়। এত বিশাল Karst cave এর আগে কখনও দেখা হয়নি আমার।
কেভ-এর মধ্যে অন্যতম আকর্ষণ বোট রাইড। নদীর ওপর দিয়ে বোট এক পয়েন্ট থেকে আর এক পয়েন্ট-এ পৌঁছে দেয়। আলাদা করে টিকিট লাগে না এর জন্য। কিন্তু খারাপ লাগে এটা দেখে যে শুধু ট্যুরিস্ট টানার জন্য এই প্রাকৃতিক গুহার অনেক কিছুই নষ্ট করে কৃত্রিম জিনিসপত্র করা হয়েছে। গুহার গা চেঁচে ফেলা হয়েছে বহু জায়গায়, তৈরি হয়েছে সিমেন্ট পাথরের বাঁধানো সিঁড়ি, রঙিন আলোয় ভরিয়ে ফেলা হয়েছে চারদিক। এই কেভ মোটামুটি ঘুরে দেখতে 1 থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। আমরা 1 ঘণ্টার মধ্যেই বেরিয়ে পড়েছিলাম। এখান থেকে বাস পেতে একটু অপেক্ষা করতে হয়। আমাদের হাতে সময় কম থাকায় আমরা ট্যাক্সি নিয়ে চলে এসেছিলাম হোটেল। সেখান থেকে লাগেজ নিয়ে বাসস্ট্যান্ড-এ পৌঁছেই পেয়ে গিয়েছিলাম Zhangjiajie-এর বাস।
Wulingyuan থেকে Zhangjiaje যেতে সময় লাগে ঘণ্টাখানেক। আমাদের Zhangjiajie-এর হোটেল-ও বাস স্ট্যান্ড এর একদম কাছেই। Hotel California. এ দেশে বসে যখন হোটেল বুক করছিলাম নামটা দেখেই ইন্টারেস্ট পেয়েছিলাম। তারপর রিভিউ পড়ে বুকিং। হোটেল-এর owner এর সঙ্গে India থেকেই we chat এ কথা হয়েছিল। Zhangjiajie ট্রিপ নিয়ে উনিও ভাল সাজেশন দিয়েছিলেন। বৃষ্টি থামলেও আবহাওয়া তখনও মেঘলার দিকেই। আমাদের পরদিন Tianmen Mountain যাওয়ার প্ল্যান। কিন্তু রিচার্ড বলেছিল আবহাওয়া পরিষ্কার না হলে Tianmen গিয়ে কিছু দেখাই যাবে না। যে হোটেল-এ এসেও আশার কথা শুনলাম না। ঠিক হল যদি হোটেল থেকে বেরিয়ে Tianmen এর পাহাড় দেখা যায় তাহলে তখনই টিকিট কেটে চলে যাওয়া হবে। Hotel California-র রিসেপশনিস্ট মেয়েটি খুব হেল্পফুল। সে আমাদের স্থানীয় কোথায় খাওয়া যায়, কি করা যায় সে ব্যাপারে সাজেশন দেওয়া থেকে শুরু করে Tianmen না যেতে পারলে কিভাবে অন্য রুটে আর একদিন National Forest টাই ঘুরে নেওয়া যায় সে ব্যাপারে দারুণ প্ল্যান ছকে দিল।
Zhangjiajie সুন্দর সাজানো শহর। শহরের ওপর দিয়ে চলে পৃথিবীর দীর্ঘতম Cable Car. সেই Cable Car ই পৌঁছোয় Tianmen Mountain এ। হাঁটতে হাঁটতে সেই Cable Car এর যাতায়াত দেখা যায় সবসময়। আমরা আশপাশের রেস্টুরেন্ট দেখতে দেখতে একটা ছোট্ট সাজানো বেকারি খুঁজে পেয়ে ভারী খুশি হলাম। খাওয়াদাওয়া সারার পর সেখানে গিয়ে বসে কেক খেতে দারুণ লাগল। সুন্দর সাজানো বেকারি, দারুণ সব পেস্ট্রি, কুকিজ, ব্রেড। কয়েকটি মেয়ে মিলে সামলাচ্ছে। পরদিন রাস্তায় খাওয়ার জন্য তুলে নিলাম পছন্দের জিনিসপত্র। বেজিং-এর চেয়ে এ জায়গা সস্তা। ডিপার্টমেন্টাল স্টোর-এ পাওয়া যায় সবকিছুই।
পুরো চীন যাত্রায় এই একটি মাত্র হোটেল-এ রুম-এ Water Filter লাগানো ছিল। বাকি সব জায়গাতেই জল কিনে খেতে হয়েছে। রুম-এ গিয়ে আমরা ম্যাপ নিয়ে বসে ন্যাশনাল ফরেস্ট-এর নতুন রুট টা ভাল করে বুঝে নিলাম। Zhangjiajie থেকে সোজা বাস যায় ফরেস্ট-এর Tianzi Mountain Town-এ যাওয়ার গেট অবধি। সেই বাস সময় নেয় মোটামুটি ঘণ্টা দেড়েক। গেট থেকে আবার ফরেস্ট-এর ফ্রি বাস Tianzi mountain অব্দি। সেখান থেকে Avatar Hallelujah Mountain-এর বাস। আর নামার প্ল্যান পায়ে হেঁটে! সেটাই সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং পার্ট!
আমরা সকালে উঠে দেখলাম Tianmen Mountain-এ কুয়াশার চাদর। টিকিট কেটে গিয়ে কিছু দেখতে পাব কিনা সত্যিই ধারণা নেই। তাই সে প্ল্যান বাতিলই করলাম। এদিকে Avatar Mountain-টা প্ৰথম দিন দেখতে পাইনি বলে মনে খুঁতখুঁত ছিলই, তাই সেদিকেই যাওয়া হবে সিদ্ধান্ত নিলাম। National Forest Park-এর টিকিট কাটার দিন থেকে 4 দিন ভ্যালিড থাকে তাই সেখানে গিয়ে আর টিকিট কাটার ঝামেলা নেই। আমরা বাস স্ট্যান্ড পৌঁছে চেপে বসলাম Tianzi যাওয়ার বাসে। বাস চলতে শুরু করল পাহাড়ি রাস্তা ধরে লোকালয়ের মধ্যে দিয়ে। দেখতে পেলাম Rural China-র ছবি। পাহাড়ে চাষবাস, বাসে অপেক্ষাকৃত নিচে থেকে অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বাস-এ ওঠা, কোলে বাচ্চা নিয়ে মায়ের রাস্তার ধার ধরে হেঁটে চলা, পাহাড়ের কোলে ছোট ছোট বাড়ি, গুমটি দোকান…..আমাদের দেশের মতোই গ্রামের ছবি, কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নের ছাপ স্পষ্ট। ঘণ্টাদেড়েক পর বাস আমাদের নামিয়ে দিল গন্তব্যে। কিছুটা হেঁটে গিয়ে আমরা গেট দিয়ে ঢুকে পড়লাম।
গেট এর ভিতরেই দাঁড়িয়ে ছিল বাস। ভর্তি হতে ছেড়ে দিল। বাসে যেতে যেতে জানলা দিয়ে দেখলাম মেঘের বুক চিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের মাথা, কোথাও আবছা, কোথাও কিছুটা স্পষ্ট। বৃষ্টি হচ্ছে না কিন্তু মেঘেদের রাজত্ব। বাস পাকদন্ডী বেয়ে উঠে যেখানে নামালো সেখানে শুধুই মেঘ আর কুয়াশা। কিছুই দেখা যায় না চারপাশে। বুঝলাম এখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। Avatar Mountain-এর বাস-এ উঠে পড়লাম। বাস থেকে নেমে হেঁটে গেলাম পয়েন্ট-এর দিকে। পাহাড়-এর গা-এর কিছু অংশ দেখা গেলেও তখন মেঘের ভিতরেই বেশিরভাগটা। এখানেই দেখা পেলাম এক বাঙালি টুরিস্ট দম্পতির সঙ্গে। চীনে গিয়ে বাঙালি খুঁজে পাওয়া বিশাল আনন্দের ব্যাপার। মেঘে ঢাকা পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়েই জমে উঠল আলাপ। আর ঠিক তখনই মেঘের চাদর সরিয়ে বেরিয়ে পড়তে লাগল পাহাড়ের সমস্ত শরীর। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠল Avatar Hallelujah Mountain, এ দৃশ্য দেখতে তো অতদূর থেকে আসা। পৃথিবীর প্রথম ন্যাচারাল ব্রিজটাও এখানেই। আমরা আগের দিন কিছু দেখতে না পাওয়ার দুঃখে ব্রিজের দিকটা যায়নি। এদিন ঘুরে এলাম। আমাদের প্ল্যান এনচানটিং টেরাস ঘুরে Yellow Whip Stream এর দিকে যাওয়া 2000 সিঁড়ি নেমে। আমরা Enchanting Terrace থেকে অসাধরণ ভিউ দেখলাম পাহাড়ের। সে দৃশ্য উপভোগ করার, লিখে বোঝানোর নয়।
আবহাওয়া পরিষ্কার হয়ে যাওয়ায় মন তখন চনমনে। ভিতরের KFC তে জমিয়ে খেলাম। আগেরদিন অনেক ট্যুর গাইড-কে ধরে জিগ্যেস করেছিলাম হেঁটে নামার রাস্তা কোথায়, কেউ সে পথ দেখায়নি। উল্টে বলেছে Elivator ছাড়া নামা যায় না। কিন্তু এদিন নিজেরাই চেষ্টা করে খুঁজে পেয়ে গেলাম হেঁটে নামার পথ। এতোই ছোট মার্কিং যে খুঁজে পেতে সমস্যা হতেই পারে। Elivator Point-এর একদম কাছেই। এ রাস্তা ধরেই বুঝলাম এখানে বিশেষ টুরিস্ট আসে না। অতো ঝকঝকে পরিস্কার নয় চারদিক। দুদিনের বৃষ্টির জেরে সিঁড়ি ভেজা এবং শ্যাওলাও আছে। যে রাস্তা কেবল কার, এলিভেটর তৈরির আগে ওঠা-নামার রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত হত। কিন্তু এখন ব্যবসায়িক খাতিরেই হোক বা অন্য কোনও কারণে এ রাস্তার খ্যাতি হারিয়েছে। আর ঠিক সে জন্যই এ রাস্তা সুন্দর, নিরিবিলি, যেমন পাহাড়ি জঙ্গল হওয়া উচিত ঠিক তেমন। প্রায় 2-3 ঘণ্টা এ রাস্তা ধরে আমরা নেমেছি। পাখির ডাক, পাহাড়ের গায়ে ঠাসা সবুজ, নাম না জানা নানান গাছ, ঝর্ণার বয়ে চলার শব্দ বার বার ওই অরণ্যের নৈসর্গিক সৌন্দর্যকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এ রাস্তায় এসেই বুঝতে পেরেছি কেন এ জায়গা Unesco world heritage sight. নিস্তব্ধতার শব্দ যে এত নিবিড় হতে পারে এই কয়েক ঘণ্টার পথ হাঁটা তা বুঝিয়ে দিয়েছে বার বার। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই Zhangjiajie তে কাটানো প্রতিটা দিনের মধ্যে এই দিনটা সবচেয়ে বেশি মনে রাখার মতো। Tianmen না যেতে পারার সব দুঃখ মিলিয়ে গিয়েছিল এই পথে।
পাহাড় জঙ্গল ঝর্ণা দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে তখন সন্ধে নামবো নামবো করছে। 2000 সিঁড়ির পরেও আরও অনেকটা পথ হাঁটা হয়েছে। ক্লান্ত শরীরে তবুও শেষ বারের মতো এই লাইমস্টোন পাহাড়কে ভালো করে দেখে নেওয়ার তাগিদ। তাও ফিরতে তো হয়ই। গেট দিয়ে বেরিয়ে আমরা Zhangjiajie যাওয়ার বাসে চড়ে বসেছিলাম। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই হোটেল। বাইরে খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়ে পড়েছিলাম তাড়াতাড়ি। পরদিন সকাল সকাল ট্রেন। আবার নতুন গন্তব্যে। সে গল্প পরের লেখায়।
টুক-টাক তথ্য-
যাতায়াত:
Beijing থেকে গেলে Changsha হয়ে যেতে হয় Zhangjiajie. ওভারনাইট ট্রেন ছাড়াও Bullet Train আছে Changsha পর্যন্ত। স্টেশন থেকে ট্যাক্সি বা মেট্রো-এ বাস স্টেশন, সেখান থেকে বাস।
ট্রেন ভাড়া- 2nd class- ₹4000-6000/জনপ্রতি
বাস ভাড়া- ₹1000-1200/জনপ্রতি
Sanghai থেকে সরাসরি Zhangjiajie-এর ট্রেন আছে।
সমস্ত বড় শহর থেকে ফ্লাইট-এ যাওয়া যায় Zhangjiajie.
শহরের মধ্যে ঘোরার জন্য প্রচুর বাস সার্ভিস আছে।
ভাড়া- ₹100-150/জনপ্রতি
থাকা:
Wulingyuan-এ National Forest Park -এর গেটগুলোর কাছে বেশ কিছু হোটেল রয়েছে। ভালো লোকেশন-এ প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধা-সহ হোটেল-এ রুম ভাড়া শুরু 1500/রাত থেকে।
Zhangjiajie তে থাকলে স্টেশন বা বাস স্টেশন-এর কাছে থাকা ভাল। এখানেও ভালো লোকেশন-এ প্রয়োজনীয় সব সুযোগ-সুবিধা-সহ হোটেল-এর ভাড়া শুরু 1400-1500/রাত থেকে।
Booking.com -এ হোটেল/হোম স্টে-এর অনেক অপশন আছে।
খাওয়া-দাওয়া:
ডিপার্টমেন্টাল স্টোর অনেক রাত অবধি/24 ঘণ্টাই খোলা থাকে। প্রয়োজনীয় সব কিছুই এখানে পাওয়া যাবে। সকাল সকাল ঘোরার জন্য বেরিয়ে পড়তে হয় তাই ফল, ব্রেড, কেক নিয়ে রাখা ভালো। লাঞ্চ, ডিনার বা ব্রেকফাস্ট-এর জন্য প্রচুর ছোট-বড় রেস্টুরেন্ট রাস্তা জুড়ে। লোকাল খাবার বেশ ভালো। Hunan Hotpot খুব জনপ্রিয় খাবার।খাওয়ার খরচ- ₹800-1200/দুজনের জন্য (মিল প্রতি)।
চীন ভ্রমণের প্রথমাংশ জানার জন্য click করুন এখানে।
চীন ভ্রমণের তৃতীয়াংশ জানার জন্য click করুন এখানে।