রাজবাড়িতে রাত কাটানোর খুব ইচ্ছে হয়েছিল। অনেক খুঁজে ওভারহাইপিড অপশনগুলো বাদ দিয়ে পেলাম কাশিমবাজার রাজবাড়ি। মুর্শিদাবাদে। ছবি দেখে মনেও ধরে গেল বেশ, কারণ, এখানে থাকা-খাওয়ার সঙ্গে উপরি পাওনা হিসেবে হাজারদুয়ারি, মতিঝিল-সহ আশপাশের জায়গাগুলো ঘুরে দেখা যাবে। অর্ক মানে আমার বর ল্যাদখোর হলেও বেড়াতে এসে শুধু শুয়ে-বসে থাকার প্ল্যান ঠিক পছন্দ করে না। রাজবাড়ির গেস্ট হাউসের নম্বর জোগাড় করে বুকিং সেরে ফেললাম তড়িঘড়ি। তবে কলকাতা ও সংলগ্ন রাজবাড়িগুলোর মতো এখানে বুকিং নিয়ে মারামারিটা এখনো নেই। পৌঁছে চেক আউটের সময় পেমেন্ট করা যাবে জেনে খুশি হলেও নিশ্চিন্ত হতে পারছিলাম না। কিন্তু ম্যানেজার মশাই নিজেই বারদুয়েক ফোন করে আশ্বস্ত করলেন।
অনেকদিন পর উইকেন্ড ট্রিপ। অর্ক আর আমার সঙ্গী দিদিভাই আর ছোট্ট বোনঝি নানু। বেরলাম শনিবার সকাল 6:36-এ। ভেবেছিলাম তাড়াতাড়ি স্টার্ট করব। তবে উইকেন্ড-এর ভাবা তো! ঘুমের ভিতর হারিয়ে যায়। বারাসাত-এ পৌঁছেই দাঁড়াতে হল লম্বা লরির লাইনের পিছনে। টুক টুক করে এগিয়ে সেই জ্যাম কাটাতে লেগে গেল প্রায় 45 মিনিট। তারপর NH34-এ উঠে হুহু করে গাড়ি ছুটিয়ে চলা শুরু। রানাঘাট-এ দাঁড়িয়ে একটু বিস্কুট, কোলড্রিঙ্ক নিয়ে নিলাম। টার্গেট ছিল 11 টার মধ্যে ঢুকব, তাই রাস্তায় বেশি দাঁড়াবার ভাবনা আগেই বাদ দিয়েছিলাম। শুধু কৃষ্ণনগর-এ পৌঁছে একটু সরভাজা, সরপুরিয়া না খেলে পাপ হয় তাই সে সুযোগ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করলাম না। তারপর আবার ছুটল গাড়ি। রোড ট্রিপ-এর মজা হল নানান ধরণের মানুষের দেখা পাওয়া যায়। পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী পাল্টে যেতে থাকা মানুষ, অনেক গাছপালা, রাস্তার পাশে নুয়ে পড়া কৃষ্ণচূড়া, নানা শেড-এর সবুজ মনটা ফুরফুরে করে দেয়।
রাস্তা বেশ ভালো, খানা-খন্দের দেখা প্রায় নেই বললেই চলে, বেশ কয়েকটা রেলগেট-এ আটকা না পড়লে মোটামুটি 5 ঘন্টার বেশি ড্রাইভ না। বারাসাত যদিও খানিকটা টাইম হাইজ্যাক করে নেবে সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই।
আমরা বহরমপুর পৌঁছে জিপিএস-এর ওপর আস্থা রেখে ও গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে দু-একজনকে জিগ্যেস করে পৌঁছলাম ছোট রাজবাড়ি ওরফে রূপকথা গেস্ট হাউজ। এই নামেই রাজবাড়ির কিছুটা অংশ গেস্ট-দের থাকার জন্য ভাড়া দেওয়া হয়। বাড়িটা দেখেই ড্রাইভের ক্লান্তি এক নিমেষে পালিয়ে গেল। সামনের সিঁড়ি বেয়ে ঢুকলাম নাচঘরের মধ্যে দিয়ে। উপর থেকে ঝুলছে নানান ধরণের ঝাড়বাতি। বিশাল লম্বাটে ঘর, দুদিকে বড় বড় আয়না, ওপর থেকে ঝোলানো পাখা, লম্বা ডাইনিং টেবিল, প্রচুর আসবাব, বিখ্যার শিল্পীদের পেন্টিং, মডেল-এ সাজানো এই নাচঘর। এই জায়গাটি ভিসিটর-দের জন্য খোলা থাকে বলে আসবাবপত্রগুলো প্লাস্টিক দিয়ে ঢাকা। নাচঘর পেরিয়ে আমরা বারান্দা সংলগ্ন সিঁড়ি দিয়ে নেমে ঢুকে পড়লাম ভিতরের দালানে। ওপরে খোলা আকাশ, মাঝে বাহারি থাম ও বসার জায়গা। এখান থেকে ডানদিকের অংশে হেঁটে গিয়ে আমাদের ঘরে যাওয়ার পথ। সেদিকেই এগনো গেল।
সিঁড়ি দিয়ে একটু উঠে গিয়ে লম্বা লন, উপর থেকে ঝুলছে বাহারি আলো। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে চোখ জুড়িয়ে গেল। সামনেই বসার জায়গা, নাচঘরে যেমন চেয়ার দেখেছিলাম তেমন চেয়ার, রাউন্ড টেবিল, গ্রামোফোন রেকর্ড, শো-কেস-এ সাজানো বেশ কিছু এন্টিক জিনিস। বসার ঘরের পর্দা সরিয়ে বেডরুম। আমরা 4 জন বলে এসি 4 বেডরুমই নিয়েছিলাম, দুটো পাশাপাশি কাঠের কাজ করা বেড, পুরোনো দিনের খাট হওয়ায় চারদিকে কাঠের বার আছে। গোটা ঘর কাঠের আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, দেরাজ দিয়ে সাজানো, বেডরুমের জানলা দিয়ে দেখা যায় বাগান, পুকুর ঘাট। শান্ত স্নিগ্ধ মনোরম পরিবেশ। বসার ঘরে এবং বেডরুম-এ আলাদা আলাদা এসি। আমাদের রুমের দাম জিএসটি নিয়ে মোটামুটি 6 হাজারের মধ্যে। ডবল এসি বেডগুলো 4 হাজারের কাছাকাছি। এসি না নিলে খরচ আরও কম। আনন্দের ব্যাপার এই উইকেন্ড-এ আমরাই একমাত্র গেস্ট, সুতরাং বিরক্ত হবার বা করার কোনও চাপ নেই।
আগে থেকেই ফোন-এ জানিয়ে দিয়েছিলাম লাঞ্চ-এ কী খাব। খাবার জায়গায় যাওয়ার আগে ঘুরে দেখলাম আশপাশটা। জানলাম 1740 খৃস্টাব্দে পেশায় ব্যবসায়ী দীনবন্ধু রায় ও তাঁর বাবা অযোধ্যা রাম রায় এই প্রাসাদোপম বাড়িটি তৈরি করেন। তখন মুর্শিদাবাদে রাজত্ব চলছে নবাব আলিবর্দি খাঁ-এর। দীনবন্ধু রায়ের পুত্র জগবন্ধু রায় মুর্শিদাবাদে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান হলেও বেশিদিন সে কাজ না করে অন্যত্র চলে যান। এই পরিবারের লোকজনের সাধারণ মানুষের প্রতি দয়াশীল মনোভাব দেখে পরিবারের সদস্য আশুতোষ নাথ রায়কে ব্রিটিশ সরকার রাজা উপাধি দেন। তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম এই বাড়িতে থাকলেও অতো বড় বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের ব্যায়বহন সম্ভব ছিল না তাই তাঁরা জমিদারি বন্ধ করে দেন। কিন্তু বাড়িটি ছিল। 90-এর দশকে উত্তরাধিকাররা বাড়ির মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেন। বাড়ির কিছুটা অংশ নিয়ে অতীত ঐতিহ্য বজায় রেখে পরিবারেরই উদ্যোগে ট্যুরিস্টদের থাকার জন্য চালু হয়েছে রূপকথা গেস্ট হাউস। এই পরিবারের পুত্রবধূ শ্রীমতী সুপ্রিয়া রায় সুগার এন্ড স্পাইস কনফেকশনারি চেনটি শুরু করেন, তিনি তাঁর এই উদ্যোগের জন্য ভারত সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছেন। এই গেস্ট হাউজের লাগোয়া সুগার এন্ড স্পাইস-এর একটি শপিং মল রয়েছে, এখানে মুর্শিদাবাদি সিল্ক, গরদের শাড়ি পাওয়া যায়। বর্তমানে বাড়ির সদস্যরা কলকাতাতে থাকলেও প্রতি বছর পুজোর সময় এখানে আসেন। পরিবারের লোকজনকে নিয়ে চন্ডীমণ্ডপে হয় পুজোর আয়োজন। পুজোর সময়ও এখানে থাকা যায়, পুজোর আনন্দে অংশ নেওয়া যায় রায় পরিবারের সঙ্গে।
আমরা বড় বড় দালান দেখে নাচঘরের ভিতর দিয়ে গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছলাম উপরের ডাইনিং হল-এ। ডাইনিং হলের জানলা দিয়ে নিচে তাকালে দেখা যায় লম্বা দালানদুটো। এখানেই আছে ট্যুরিস্টদের থাকার আরও 3-4টি ঘর। আমিষ-নিরামিষ মিলিয়ে খাবার আয়োজন ছিল অসাধারণ। মাছ বা চিকেন মিল নিলে দাম মাথাপিছু 300, মটন হলে 400। নিরামিষ বা ডিম 200 টাকা। স্যালাড, ভাত, ডাল, বেগুন ভাজা, পাঁচমিশালি তরকারি, মাছ, মটন, আমের চাটনি আর চিনিপাতা মিষ্টি দই, লোভে পরে বেশ বেশিই খেয়ে ফেললাম। রান্না ঘরোয়া এবং বেশ সুস্বাদু। স্থানীয় দুই মহিলাই রান্না করেন। আর বাড়ির কেয়ারটেকার ছেলেটি খুব যত্ন করে খাওয়ায়।
ওর থেকেই জেনে নিলাম হাজারদুয়ারি দেখতে হলে 2-2.30-এর মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে, কারণ বিকেল 5 টায় বন্ধ। বাকি দর্শনীয় জায়গাগুলোও একই দিকে পড়বে। আমরা খেয়ে রুমে এসে ল্যাদ খাবার ইচ্ছে প্রশমন করে তৈরি হয়ে নিলাম বেরোনোর জন্য।
রাজবাড়ি থেকে ডানদিক নিলে রেলগেট পেরিয়ে হাজারদুয়ারি যাওয়ার রাস্তা। এখানকার গ্রাম্য লোকেদের সবই কাছে মনে হয়, তাই রাজবাড়ি থেকে 5 কিলোমিটার দূরত্ব শুনে বেরিয়েও গুগল ম্যাপ-এ দেখলাম প্রায় 10 কিমি যেতে হবে আমাদের। 20 মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম হাজারদুয়ারি। তখন চড়া রোদ। যাওয়ার পথে দেখলাম ওয়াসিফ মনজিল। গাড়ি পার্ক করে বেশ খানিকটা হেঁটে যেতে হয় টিকিট কাটতে। টিকিট মাথাপিছু 20 টাকা। ক্যামেরা, মোবাইল নিয়ে ঢোকা নিষেধ তাই সব জমা দিয়ে গাইড-এর সঙ্গে এগলাম। হাজারদুয়ারির ইতিহাস আমাদের অনেকেরই জানা। তাই বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না। বাইরে ঘড়িঘর, ইমামবাড়া, মদিনা দেখে আমরা হাজারদুয়ারির ভিতরের মিউজিয়ামে ঢুকে পড়লাম। ভিতরের বিভিন্ন ঘরে যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র, কামান, সৈনিকের পোশাক, তৎকালীন পরাধীন নবাব ও ব্রিটিশ শাসকের বিশাল সব অয়েল পেন্টিং, গল্পে শোনা সেই বিখ্যাত আয়না ও ওষুধ দিয়ে সংরক্ষিত কুমির, হাতির দাঁতের সামগ্রী, নবাবী সিংহাসন, নবাবপুত্রকে রানী ভিক্টরিয়ার উপহার দেওয়া বিশাল ঝাড়লণ্ঠন, বন্দিদের বিচারকক্ষ দেখে বেরিয়ে এলাম। বাইরে তখনও রোদ আছে, তাপ খানিকটা কমেছে। একটু বসে গল্প জমল।
এরপর গন্তব্য মোতিঝিল। ওখানে সন্ধ্যের সময় লাইট এন্ড সাউন্ড শো হয়, সেটা দেখার পরিকল্পনা আগের থেকেই ছিল। বাইরে বেরিয়ে টাঙ্গাওয়ালাদের এদিক-ওদিক নিয়ে যাবার অনুরোধ এড়িয়ে উঠে পড়লাম গাড়িতে। মতিঝিল এখান থেকে 10মিনিট। রাস্তা জিগেস করে সহজেই পৌঁছে গেলাম। রাস্তায় নেমে চোখ পড়ল আম গাছের নীচে কাঁচা আম বিক্রেতার দিকে। ঝটপট আম খেয়ে টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম ভিতরে। ঢোকার টিকিট 20 টাকা করে, লাইট এন্ড সাউন্ড দেখলে ভিতরে ঢুকে আলাদাভাবে সেই টিকিট কাটতে হয়। এখানে গত কয়েক বছরে বিউটিফিকেশন হয়েছে। অনেকটা কলকাতার ইকোপার্কের মতো সাজানো। ভিতরে কলমের আম বাগান, নানা রঙের গোলাপে ভরা গোলাপ বাগান, লাইন দিয়ে সূর্যমুখীর সারি, বাচ্চাদের খেলার পার্ক, জায়গায় জায়গায় টুরিস্টদের বসার জন্য সুদৃশ্য নানা নামের সিটিং এরিয়া ও ট্যুরিস্ট-দের জন্য ভিতরে থাকার ব্যবস্থাও রয়েছে। এখানে সবচেয়ে ভালো লাগলো মতিঝিলে ফুটে থাকা রাশি রাশি পদ্ম। এত পদ্মফুল আগে কখনো এভাবে দেখা হয়নি। তখন প্রায় সন্ধ্যে 6.15। লাইট এন্ড সাউন্ড গরমকালে শুরু হয় 6.30 টায়। ওদিকটায় হেঁটে যেতে বেশ খানিকটা সময় লাগবে। তাই আমরা হেঁটে চারপাশ দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম টিকিট কাউন্টারে। টিকিট কেটে লাইন দিয়ে ঢুকে মনের মতো জায়গা পেয়ে বসলাম। 6.30-এ টাইম হলেও ভিড় জমে আর অন্ধকার নেমে শো শুরু হতে হতে প্রায় 7 টা বাজলো। সিরাজের সঙ্গে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনি, স্বয়ং মুর্শিদাবাদ-এর জবানিতে। শো দেখে আমরা গল্ফ কার্ট-এ চড়ে ঝিলের পাশ দিয়ে পৌঁছে গেলাম মতিঝিল-এর মেন গেট-এ। সেখান থেকে বেরিয়ে রাজবাড়ি ফেরার আগে সিল্ক শাড়ির সন্ধানে একটু খাগড়া বাজারের দিকে যাবার প্ল্যান ছিল। কিন্তু গাড়ি নিয়ে সে রাস্তায় ঢুকে খুবই অসুবিধায় পড়তে হল। গুগল তখন সরু গলি পেলেও সেখান দিয়ে ফেরার রাস্তা দেখাচ্ছে, আর রাস্তার লোকজন ডান-দিক বাঁদিক করে আরও গুলিয়ে দিচ্ছে। কী কুক্ষণেই যে লোভী মাথায় শাড়ির কথা এসেছিল! গুগল ততক্ষণে পুরো ঘেঁটে গেছে, এক ঘণ্টা ঘুরপাক খেয়ে অবশেষে কিছু সহৃদয় মানুষের সাহায্যে রাস্তা বুঝে ফেরা গেল।
ফিরলাম প্রায় 9 টায়। মূল দরজা দিয়ে না ঢুকে এবার ডানপাশ দিয়ে ঢুকলাম। এখান দিয়ে আমাদের থাকার ঘরটা একেবারেই কাছে। ঘরের সামনে ঝাড়বাতি জ্বলছে, পিলারগুলোয় জ্বলা আলো এক অন্যরকম আবহ তৈরি করেছে। আমাদের প্ল্যান ছিলই ফটোগ্রাফার (মানে অর্ক) যখন সঙ্গে আছে সর্বোতভাবে তার সুযোগ নেওয়ার। পছন্দের লোকেশন পেয়ে দেখলাম ফটোগ্রাফারটিই উৎসাহী হয়ে ফটো তুলতে লাগল। ছবি-টবি তুলে ঘরেই সেরে নিলাম ডিনার। রুটি, আলুভাজা, সবজি, চিকেন, পাঁপড় ভাজা আর কালোজাম। আর একটা ভালো খবর, এখানে মদ্যপান করতে চাইলে ঘরে কেউ আটকাতে আসবে না। খানিকক্ষণ আড্ডা দিয়ে আমরা সবাই বিছানা নিলাম। সকাল থেকে খুব হেকটিক গেছে আর রবিবার সকাল সকাল উঠে এই বাড়ির ট্যুর টাও বাকি আছে।
রবিবার উঠতে উঠতে 7:30 হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে রেডি হয়ে নিলাম আমরা। সকালের রোদে বাড়িটা কি অপূর্ব দেখাচ্ছে। খানিক পরেই ফিরতে হবে সেইটা মানতে ইচ্ছে করছিল না মোটেই। আমরা গেলাম বাইরের বাগানের দিকে। পুকুরটা মজে গেলেও বাঁধানো পাড়টায় গাছের ছায়ায় বসতে বেশ লাগে। আর একটু ডানদিকে গেলে বিশাল নাগকেশর গাছ, থোকা থোকা কুঁড়ি আর ফুলে ভরে আছে, চারপাশটা ফুলের গন্ধে ম ম। আমাদের কেয়ারটেকার এখান থেকে নিয়ে গেল গোবিন্দ মন্দিরে। দরজা দিয়ে ঢুকে ভিতরে নাটমন্দির, ভোগের ঘর, দালান ও গর্ভগৃহ। এখান থেকে এগলাম চন্ডীমণ্ডপের দিকে। ঢোকার আগে অনেকে মিলে বসে ঠাকুরের ভোগ খাবার জায়গা। এই চন্ডীমণ্ডপেই দুর্গাপুজো হয়। ওপর থেকে ঝুলছে নানা মাপের নানা ধরণের ঝাড়লণ্ঠন। উপরের কাঁচের জানলা দিয়ে আসছে মিঠে রোদ্দুর। সুসজ্জিত থামে লাগানো সাবেকি আলো, কয়েক ধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাঁধানো মণ্ডপ। মণ্ডপের দুপাশে ওপর থেকে ঝুলছে দুটো রঙিন কাঁচের তোতাপাখি। ধুলোর হাত থেকে বাঁচাতে ঝাড়বাতি ও থামগুলো প্লাস্টিকে ঢাকা থাকে, খোলা হয় পুজোর সময়।
গোটা বাড়িটিতে এত দিকে এত জায়গা যে এখানে হারিয়ে যাওয়াটা খুব সোজা। চন্ডীমণ্ডপ থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম ব্রেকফাস্ট করতে। ঘড়ি বলছে 10 টা। চেক আউট টাইম 10 টা হলেও লোকজন না থাকায় কোনও তাড়াহুড়ো ছিল না। কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট-এ ছিল গরম গরম লুচি, কালো জিরে, কাঁচা লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে চচ্চড়ি, ডিম সেদ্ধ, কলা, চা/কফি। এমন সাবেকি পরিবেশে রবিবাসরীয় ব্রেকফাস্ট হিসেবে লুচি, চচ্চড়িটা জমে গেল।
আমাদের এখানে আসা থেকেই রাস্তায় সারি সারি গাছ ভর্তি আম দেখে ভীষণ আম পাড়া এবং আম বাগান ঘোরার ইচ্ছে হয়েছিল। রাস্তাঘাটে গাছে হাত দিলে জরিমানা দিতে হবে তাই আমরা কেয়ারটেকারকে বলে রেখেছিলাম আম বাগানে নিয়ে যেতে। খাওয়া-দাওয়ার পর যাওয়া হল পাশেই রাজবাড়ির নিজস্ব আমবাগানে। প্রচুর আম গাছ। আড়াইশো বিঘা জমির ওপর এই বাগান। সব গাছে নানা সাইজের আম ঝুলছে। কোনো কোনো গাছে উঁচুতে আম, কোনোটায় আবার আমসমেত ডাল মাটিতেই নুইয়ে পড়েছে। বাগানটা রাজবাড়ির হলেও এখন ইজারাদারদের দেওয়া আছে। তাই আম পাড়ার জন্য ইজারাদারদের অনুমতি প্রয়োজন। এখানে পাকা আমের সময় বাগানে গিয়ে আম পেড়ে সেই আম কেনা যায়। কিন্তু এখন আমে পাক ধরেনি। তাও আমরা ছোট্ট বোনঝিটি থাকায় সহজেই অনুমতি পেয়ে গেলাম। খুব টক হবে জেনে যদিও 3-4টের বেশি পারলাম না। ঐ কটা আম ওরা আমাদের উপহার হিসেবেই দিল, সঙ্গে দিল আরও দুটি পাকা আম। মহানন্দে আমরা আম নিয়ে ফিরলাম রাজবাড়িতে।
ঘড়ি তখন বলছে প্রায় 12 টা। এরপর বিল মিটিয়ে বাড়ি ফেরার পালা। খুব থেকে যাবার ইচ্ছে হলেও, গাড়ির কাছে লাগেজ নিয়ে এসে দাঁড়াতেই হল। সঙ্গে নিলাম দালান জোড়া রোদ, গাছের ছায়ার আরাম, জামায় লেগে থাকা ধুলো, আর আগলে রাখার মতোন ভালোলাগা। খুব শিগগির ফিরবো কথা দিয়ে গাড়ি ছুটলো বাড়ির পথে।