শান্তিনিকেতন বেড়ানোর ব্যাপারে বাঙালিকে খুব একটা ইনফো দেওয়ার কিছু বাকি নেই, মোটামুটি অনেকেই রাস্তাঘাট, হাট বাজার চষে ফেলেছে। আমি তাই বেড়ানোর গপ্পো লিখছি না। তার চেয়ে থাকা-খাওয়ার গল্প-তে এমনিই বাঙালির ইন্টারেস্ট বেশি। এবার শান্তিনিকেতনের প্ল্যানটা ভীষণরকম আনসার্টেন ছিল। বেসরকারি বিজ্ঞাপনী চাকুরেজীবীর উইকেন্ড-এ কাজ করতে হবার চান্স থাকলে যেমন হয় আর কি! তা হোটেল বুকিং, ক্যান্সলেশন, লেট ডিসিশন, ট্রেন-এ নন এসি সিট মিলিয়ে খিচুড়ি পাকিয়েছিলাম বেশ। শেষমেষ যখন সাহস করে ‘যেতে পারি’ বললাম ততক্ষণে পছন্দের থাকার জায়গাটি হাতছাড়া। “বেলাশেষে” ছবির শ্যুটিং-এ দেখানো হওয়ার ফলে শ্যামবাটির দুটি বাড়ি বেশ লাইমলাইটে এসেছে কিছু বছর হল। আমার আগের অফিস কলিগরা সেখানে গিয়ে হুজ্জুতি করে আসার ছবি দেখিয়ে লোভ বাড়িয়ে রেখেছিল। তক্কে তক্কে ছিলাম গেলে ওখানে থাকতেই হবে। কিন্তু সেই “গীতবিতান” আর “সঞ্চয়ন” পাশাপাশি দুটো বাড়িই হাতছাড়া খবর পেয়ে মন ভাঙল। যাকে বুকিং-এর জন্য ফোন করেছিলাম উপায় বাতলালেন তিনিই। হাটের মাঝের “রাম-শ্যাম” বা “শকুন্তলা”-র কমার্শিয়াল ভিড়ভাট্টায় থাকার ইচ্ছে ছিল না মোটেই। তাই আমাদের পছন্দমাফিক উনি ব্যবস্থা করে দিলেন “বেলাশেষে”-র বাড়ির পাশেই “মাটির বাড়ি”-তে থাকার। আর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হল “বেলাশেষে”-র বাড়ি থেকেই।
যতই বার বার যাওয়া হোক, শান্তিনিকেতনে শনিবারের হাট মিস করা পাপ। তাই আমরাও এক শনিবারের সকালে ট্রেন-এ চড়ে বসলাম। ট্রেন তখন সবে ছেড়েছে, সকাল 9 টা বাজার আগেই “গীতবিতান”-এর কেয়ারটেকার মাধব দার ফোন। বাজার যাচ্ছেন, জেনে নিতে চান কি খাব। সহযাত্রীদের মতামত নিয়ে মেনু ঠিক হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। বাঙালির ট্রেন যাত্রায় চা, ঝালমুড়ি না থাকলে গা ও মন দুই ম্যাজম্যাজ করে। বাউল গানের তালে সেসব চলল কয়েক রাউন্ড। সঙ্গে বাচ্চা থাকায় চিপস, জেমস-ও জুটে গেল ভাগ্যে। গিয়ে শ্যামবাটি অবধি পৌঁছতে বাজল সাড়ে ১২ টা। তখন আবার পেট-এ আগুন। মাধবীলতায় ঢাকা সবুজ লোহার গেট ঠেলে ঢুকলাম বাগানঘেরা মাটির বাড়ি-তে। ঢুকেই মন ভালো হয়ে গেল সাজানো বাগান, নিকনো উঠোন, সরু শিকল দেওয়া দরজা, দেওয়ালে মাটির প্রলেপ, দাওয়ায় নীচু খাটিয়া দেখে। ভিতরে ঢুকে একদিকে দুটো ঘর, অন্যদিকে রান্নাঘর। বাথরুম এটাচ না হলেও দুটো ঘরের জন্য আলাদা আলাদা মুখোমুখি বাথরুম। তারপর নেমে গিয়ে আরও একটা বড় ঘর। সেই ঘরে লাগোয়া বাথরুম আছে। এই ঘরের পিছনটায় কেয়ারটেকার-এর সংসার। মাটি লেপা ডাইনিং এরিয়ায় গাছের গুঁড়ির ওপর পাথরের স্ল্যাব দিয়ে বানানো টেবিল। এর পাশে থেকেই সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে। ওপরটায় কাঠের মেঝে। অনেকখানি জায়গা। এখানে শীতের সন্ধেয় বেশ আসর জমানো যায়। পাশে গ্রিল-এর দরজা খুলে চলে যাওয়া যায় ছোট্ট ছাদে।
নীচে নেমে আমরা পছন্দমতো ঘর নিয়ে ঢুকে পড়লাম। আমরা ছাড়া আর কোনও বোর্ডার নেই। সুতরাং নিজের বাড়ি ভাবটা আরও বেশি। ঘরে কাঠের কাজ করা দরজা, মাটির প্রলেপ দেওয়া দেওয়াল, মেঝে। সাধারণ চাদর পাতা নিচু খাট। দেওয়ালে মাটির সঙ্গে লাগানো আয়না, তার চারপাশে মাটির আলপনা, কুলুঙ্গির মতো খোপ। জামাকাপড় মেলার জন্য কাঠের লাঠি দড়ি বেঁধে ঝোলানো ওপর থেকে। বেশ অন্যরকম আমেজ। এরমধ্যে দেওয়ালে লাগা এসি দেখতে বেখাপ্পা হলেও, এই গরমে দরকারি। মর্ডান সুযোগ-সুবিধা নিয়ে মাটির বাড়িতে থাকার এই অভিনব ব্যবস্থা মনে ধরল খুব।
একটু চারপাশ ঘুরে দেখতে দেখতে খাবার এসে গেল। ভাত, ডাল, ঝুড়ি আলুভাজা, তরকারি, ডিমের ডালনা, পাঁঠার ঝোল। সঙ্গে নুন আর লেবু। কব্জি ডুবিয়ে পেটপুরে খাওয়া জমল। মালতী-দির রান্না মন জিতে নিল সকলের। মাংসটা খেয়ে মনে হচ্ছিল আরও থাকলেও নেমে যেত সহজেই। দুপুরেই মালতী দির সঙ্গে কথা বলেই বিকেলের চাট-টা ঠিক করে নেওয়া হল। আমাদের মন বুঝে মালতী-দিই বলল “বিকেলে তবে চিকেন ফ্রাই করে দিচ্ছি ঝাল ঝাল করে আর রাতে কারি খেও”। সঙ্গে আলুভাজাও চেয়ে নিলাম। আমাদের তখন আর পায় কে! আনন্দে গদ গদ হয়ে আমরা তৈরি হয়ে নিলাম হাটে যাবার জন্য।
শান্তিনিকেতনের হাট নিয়ে কিছু বলব না নতুন করে কিন্তু এবার ভালো লাগল হাটে যাবার রাস্তাটা। এর আগে যতবার গেছি বিশ্বভারতী বা রতনপল্লীর দিকেই থাকা হয়েছে। এবারের আস্তানা থেকে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে 5-7 মিনিট পায়ে হেঁটেই সোজা হাটে চলে যাওয়া যায়। সোনাঝুড়ির জঙ্গল দিয়ে পায়ে হাঁটা রাস্তা ধরে আমরা চললাম। আলো-ছায়ার লুকোচুরি, হাওয়ায় পাতা নড়ার শব্দ, পাখিদের ডাক, মেঠো পথের ধুলো, ঝড়ে যাওয়া পাতার উড়ে যাওয়া, মেলা থেকে ভেসে আসা বাউলের সুর, মাদলের শব্দে ডুবে থাকতে ইচ্ছে করল অনেকক্ষণ। হাটে অনেক মানুষ, দর-দাম, কেনাকাটার হিড়িক। সেসবের মাঝেই দেখা পেলাম সাইকেলে চড়ে আসা চিনিপাতা দই-এর। বেশ লাগল তালপাতা কেটে বানানো চামচ ডুবিয়ে খেতে। মেলার নিমকি চা চেখে সন্ধে নামার সময় টক আমড়া মাখা মুঠোয় নিয়ে টোটোয় চড়ে আমরা ফিরলাম মাটির বাড়িতে।
অন্ধকারে ঝোলানো রঙিন আলোয় ভারি সুন্দর লাগছে তখন দাওয়াটা। গরম না থাকলে এখানেই আসর বসানো যেত। মালতী দির চিকেন ফ্রাই আর সামনের দোকান থেকে আনা চিপস, বাদাম, কটকটি ভাজা সহযোগে ঘরের মধ্যেই আমাদের আড্ডা জমল খুব। নানান কথায় আর খিদের চোটে মাংস তখন শেষ। হানা দিলাম মালতী দির কিচেন-এ, বেলাশেষে-র বাড়িতে। ওখানে তখন বাউল সহযোগে আড্ডা তুঙ্গে। দিদি জানাল চিকেন না থাকলেও পিয়াঁজি ভেজে দিতেই পারে। আমরা একবাক্যে রাজি। এই সময় যে কিছু দেবে বলেছে তাই তো অনেক! মালতী দি আর মাধব দা সহাস্যে বলল পরের বার ওদের কাছে থাকতেই তবে, মাটির উনুনে রান্না করে খাওয়াবে! একদিনের আলাপে ওদের এই সহজ-সরল আন্তরিকতা মন ছুঁয়ে গেল আমাদের। মাটির বাড়ির কেয়ারটেকারও আমাদের ডিনার খাওয়া, দাওয়ায় আড্ডা দেওয়া অব্দি জেগে বসে রইল। এক রাতের জন্য আসা, তারপর আবার ট্রেন-এর টাইম অনুযায়ী নিজেকে চালানো, রাত টা গল্পেই সাবাড় করে দেবার ইচ্ছে ছিল আমাদের। ঘন অন্ধকার, জঙ্গলটা কি ভীষণ মায়াবী। তাকিয়ে থাকতে থাকতে নেশা লেগে যায়! অনেকক্ষণ খাটিয়ায় আড্ডা দিয়ে যে যার ঘরে গেলাম। তখন কত রাত মনে নেই। চারদিক শান্ত। শুধু বাউলরা বাড়ি চলে যাবার পর এই পরিবেশে ‘শেপ অফ ইউ’ চালিয়ে রেখেছে কেউ!
ঘুম ভাঙল তাড়াতাড়ি। ফ্রেশ হয়ে চলে গেলাম ছাদে। এখন থেকে জঙ্গলটা অনেকটা দেখা যায়। চা-এ চুমুক দিতে দিতে তাকিয়ে থাকলাম। ইচ্ছে হল আরও একবার ঘুরে আসি ভিতর থেকে। বেরিয়ে পড়লাম। হাঁটলাম, ঘুরলাম। রবিবার সকালেও কয়েকজন বসেন হাটে। সেদিকেও একটু ঢুঁ মারলাম। তবে রোদ আর ট্রেন ধরার তাগিদে ফিরতে হল তাড়াতাড়িই। ভাত, ডাল, আলুভাজা, মাছের ঝাল, ডিমের কারি যে যার পছন্দমতো বলে রেখেছিলাম। ডিম কারি টা দারুণ আয়েশ করে খেলাম। আবারও মনে হল এমন রান্না খাবার জন্য নেক্সট উইকেন্ডেই আবার আসা যায়। এমন ঘরোয়া নিরিবিলি পরিবেশ, বাড়ির লোকের মতো যত্ন, গাছের ছায়া, বিশ্বভারতীর রাস্তা ধরে টোটো রাইড, সঙ্গে শনিবারের হাট আর হুল্লোড়, নাহ, যে যাই বলুক, শান্তিনিকেতন বার বার যাওয়া যায়।
পুনশ্চ- বড়ই পেটুক বলে সব খাবারের ছবি তোলার কথা খেয়াল হয়েছে খেতে শুরু করার পর। অগত্যা…।