রোজকার মতো মোবাইলে বেজে ওঠা সাতটার এলার্ম-টা ঘুমচোখে বন্ধ করতে গিয়ে যেটুকু দেখতে পেলাম তাতেই 10টা অব্দি বিছানা আঁকড়ে থাকার রসদ ছিল। কিন্তু ঝমঝম ঘুমপাড়ানি হাতছানি থাকলেও উইক ডে-তে বিছানা না ছাড়ার স্বাধীনতা কি আর আমাদের থাকতে আছে। ডেডলাইন, কন কল, ব্রিফ-এর ফলো-আপয়ের গুঁতোয় চোখ রগড়ানো কন্টিনিউ করতে করতে উঠে বসতেই হয়। এইসব দিনে এখনও খিচুড়ি পায়, ডিম ভরা ইলিশের পিস-এর দিকে ভালোবেসে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সেইতো রোজকার গরম দুধ, কলা, মুসলি… ফিজিক্যাল ফিটনেস দেখতে গিয়ে মনের ফিটনেস-এর দফারফা।
রাস্তায় বেরিয়ে ডুবজল পা, হেভিওয়েট পথচারীর ধাক্কায় বেঁকে যাওয়া ছাতা, ছিটকে লাগা কাদার সঙ্গে যে বিরক্তিটা মিশে থাকে সেটা এমন দিনে কাজ করতে ইচ্ছে না করার, জল মাড়িয়ে গিয়ে যদি কেউ কফিশপের কাঁচের দরজার ওপার থেকে বৃষ্টি দেখার স্বাধীনতা দিত, বা ছোটবেলার মতো টিউশনিতে একথালায় সবাই মিলে তেলেভাজা মুড়ির বিকেল দিত, স্কুলের মাঠে দৌড় দিত, কিংবা বাইকে করে বহুদূর ভিজে যাওয়া দিত, মোটেই খারাপ লাগতো না। তবে বর্ষা এলে এইসব মনে পড়ে যাওয়াগুলো ছাতার আড়ালেও ভিজিয়ে দেয়।
এই তো সেদিনও, মুসলধারায় লাল পাড় সাদা শাড়ির নীচে কেডস পরে ছপছপ জলে স্কুলে যাওয়ার জন্য ভিড় বাস, ভিজে যাওয়া শাড়ির কুঁচি-আঁচলকে থোড়াই কেয়ার করে বইবোঝাই ব্যাগ বাঁচানোর ব্যর্থ চেষ্টা ছিল, রেনি ডে হলে মন খারাপ ছিল। আর এখন একটা রেনি ডে-এর জন্য হাপিত্যেস আগলাই। স্কুলের মাঠে হুড়োহুড়ি খেলায় হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ার আনন্দ ছিল তখন, প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে জানলার গরাদ ধরে প্রাণের কথা ছিল, দিদিমণির চাউনি এড়িয়ে রাস্তার দিকে অন্যমনস্ক চোখ ছিল, বইয়ের নীচে গল্পের বই ছিল, কে কতটা ভিজল তাই নিয়ে হল্লা ছিল, মিয়ানো ফুচকা ছিল।
বৃষ্টিদিনে টিউশন পড়তে যাওয়া মিস হতো না মোটেই। কোমরে কায়দায় ওড়না ঝুলিয়ে বৃষ্টি মাথায় ঠিক পৌঁছে যেতাম আড্ডার লোভে। কোনো আলসেমি তখন ছুঁতোই না আমাদের। জমা জলে এক হাতে ছাতা ধরে সাবধানী প্যাডেল বা বন্ধুর সাইকেলের রড-এ চেপে ব্যাগ-ছাতার ব্যালেন্স, সেইসব স্কিল কোথায় যে হারিয়ে গেল। যেমন হারিয়ে গেল অঝোর বৃষ্টিতে আড়াল না খুঁজে ভিজে সপসপ বাড়ি ফিরে নিজেকে রেবেল ভাবার আনন্দ, মায়ের বকুনিকে ইগনোর করে ছাদে গিয়ে আর এক রাউন্ড। এখন আর ভিজে যাওয়ার সময়টুকুই নেই আমাদের।
কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে তখন বৃষ্টি এলেই ক্লাস বাঙ্ক করে সিনেমা, গঙ্গার ঘাট, কুড়িয়ে পাওয়া কৃষ্ণচূড়ার ডাল, আধফাটা টক আম, ছাতার নীচে হাতে-হাত, ঝিলপাড়ে আটকে পড়া দুস্টুমি। কেমন করে সকাল থেকে সন্ধে হতো খেয়াল থাকতো না। তারপর কলকাতার হাওয়া লেগে পাল্টে যেতে থাকা আমি’র বৃষ্টিদিনে ছবি তুলতে যাওয়ার রোম্যান্স, প্রিন্সেস ঘাট, বাসন্তীর বাইকরাইড কিংবা ভিজে ভিজে বেলঘড়িয়া এক্সপ্রেসওয়ের দামালপনা-চায়ের কাপে দু-চার ফোঁটা উপরি পাওয়া জল, সবে চিনতে থাকা রাস্তাঘাট, নতুন জুতোর ভিজে যাওয়ারা সে সবের সাক্ষী।
এই বড় হয়ে যাওয়াটা বড় নচ্ছার। সময় আর উপায়ের অভাবে আমাদের এখন বৃষ্টি মানে জল ঠেঙিয়ে অফিস, ছাতার মিছিল, কাদালাগা জিন্স, কিউবিকলে বিকল হতে বসা মন নিয়ে কাজ, কাচা জামা-কাপড় না শুকোনোর টেনশন, ফেরার পথে ট্রাফিক জ্যাম, সহযাত্রীর ভেজা ছাতার অবাঞ্চিত জল, বর্ষার জুতোর বেক্ষাপা আওয়াজ, বাড়ির নীচে জমা জল…
একটা টাইমমেশিন পেলে ভালো হতো কিনা জানি না, কিন্তু উইক-এর মাঝে একটা রেনি ডে-তে কোথাও হারিয়ে যেতে পারা, দেশে-বিদেশে ছিটকে যাওয়া বন্ধুগুলোর সঙ্গে একটা বিকেল কিংবা ভাইবোনদের নিয়ে মায়ের রান্না খিচুড়ি ডিম ভাজার জমাটি দুপুর পেলে বেশ লাগতো, বর্ষামঙ্গল জমে যেত।