জীবনে প্রথম কিছু করার মধ্যে একটা অন্যরকম মজা আছে, মনে রেখে দেওয়ার মতোন রসদ আছে। যেমন প্রথম বৃষ্টিতে ভেজা, প্রথম শাড়ি পরা, প্রথম মার খাওয়া, প্রথম ঠোঁটে ঠোঁট এগুলো থেকে যায়, জমানো আনন্দের পুটলিতে। এরকমই একটা প্রথম কিছু করার জন্য পায়ের তলায় সর্ষেগুলো সুড়সুড়ি দিচ্ছিল সেই কবে থেকে। বিয়ের পর সোলো ট্রিপ-এর চোখপাকানোকে তুড়ি মেরে তাই বড়বেলার বান্ধবীর হাত ধরে বেরিয়ে পড়া। প্রথম একা একা হোটেল বুকিং, এয়ারপোর্ট, ফ্লাইট, গাড়ি, সাইকেল সবকিছু-স্বাধীনতা। আমার সঙ্গী সঙ্গীতাকে বড়বেলার বন্ধু বলার কারণ আছে। আমরা কলেজে একসঙ্গে পড়াশোনা করলেও আমাদের বন্ধুত্ব বেড়েছে কলেজ ছাড়ার পর আর আত্মিক যোগ হয়েছে তারও কিছু বছর পর সত্যি সত্যি বড় হয়ে গিয়ে। এহেন দুই বান্ধবীর অনর্গল ফোনে সুখ-দুঃখ যাপন, বছরে দু-এক বার দেখা পেয়ে মন উজাড় করে দেওয়ার অভ্যাসে আশ মিটছিল না মোটেই। তবে ইচ্ছে সময়ের হিসেব না মেলায় আটকে ছিল প্ল্যান। মার্চের এক কাজ হালকা থাকা দুপুরে একটি চাইনিজ ওয়েবসাইট দেখতে দেখতে আমরা দুজন দেশের দু-প্রান্তে (কলকাতা ও বেঙ্গালুরু) বসে ঠিক করি আমরা বেড়াতে যাওয়ার জন্য একইরকম দেখতে দুটি ড্রেস কিনছি। আর সেই ড্রেসদুটো অর্ডার দিয়ে আমরা দুজন চেন্নাই-এর ফ্লাইটের টিকিট কেটে ফেলি। এই ট্রিপের শুরুটা ঠিক সেখান থেকেই। এতে অবাক হবার খুব একটা কিছু নেই কারণ আমরা মেয়েরা জামাকাপড় আগে রেখে পরে বাকি সব ভাবি। যদিও এ যাত্রায় ওই অর্ডার দেওয়া জামাগুলো আমাদের ফেরত পাঠাতে হয়েছিল কোয়ালিটি ইস্যুতে। কিন্তু জামাদুটোর কাছে আমরা দুজনেই যে গ্রেটফুল, তা বলাই যায়।
এতো জায়গা থাকতে পন্ডিচেরি পছন্দ হওয়ার কারণ অনেক, সেই লিস্ট-এ যাচ্ছি না, যারা গেছেন তারা বুঝবেন। আমার এটা প্রথম বার হলেও সঙ্গীতার ঘোরা। ধরেই নিয়েছিলাম গাইডের কাজটা ওই করে দেবে। দুই বন্ধুর প্রথম একসঙ্গে ট্রিপ, সঙ্গে বড় হয়ে গেছি ফিলিং, টাকাপয়সার হিসেব না কষে নিপাট আনন্দে মন দিয়েছিলাম শুরু থেকেই।
22 জুন, শুক্রবার ভোর পাঁচটায় যখন এয়ারপোর্ট পৌঁছলাম ভয় করছিল একটু। ভয়ের চেয়ে যদিও টেনশন বলা টা ভালো। তারপর যখন চেন্নাই পৌঁছে সঙ্গীতাকে জড়িয়ে ধরলাম ‘finally we did it’ ফিলিং-টা এল। এয়ারপোর্ট-এ নিতে আসা চেন্নাইয়া ড্রাইভার স্যার-এর সাহায্যে সাউথ ইন্ডিয়ান ব্রেকফাস্ট আর জুস সঙ্গে নিয়ে শুরু হল লং ড্রাইভ। ইস্ট কোস্ট রোড ধরে গেলে সমুদ্রের দেখা মেলে। গুগল ম্যাপ, গল্প আর সমুদ্রের খোঁজ করতে করতে পন্ডিচেরির কাছাকাছি পৌঁছে দেখলাম আমাদের পাশ দিয়ে সমুদ্রও চলেছে সঙ্গে। প্রমেনাডের রাস্তায় উঠে প্রাণ জুড়লো। পৌঁছে যাওয়ার আনন্দ। চেক-ইন করেই চড়তে বেরোতে হবে। লেস হিবিসকাস-এ ঢুকে মনে হল বাড়ি ছেড়ে আর এক বাড়িতে থাকতে এলাম দু’দিনের জন্য। গেস্ট হাউজের মালিক ভাস্করণ খুবই আন্তরিক। আশেপাশে কোথায় যেতে পারি সেই নিয়ে গল্প করতে করতে নিজের ফ্যামিলি ও বাড়ির গল্পও করলেন অনেক। খাওয়া-দাওয়া ও মেইনটেনেন্স-এর দায়িত্বে থাকা আম্মাদের মিস্টি হাসি মুখ মন জয় করে নিল নিমেষেই। খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, সূক্ষ কাঠের কাজের সাবেকি আসবাব, বাহারি টবে নানান সবুজ, কাঁসা-পিতলের বাসনপত্রে সাজানো এই মনোরম বাড়িটাতেই সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু আমাদের বাকেট উপচে পড়ছে এমনিতেই, তাই সাজগোজ পাল্টে দুজনে বেরিয়ে পড়লাম আধঘণ্টার মধ্যেই।
রাস্তায় পা দিয়ে প্রথম দেখা ঝরা ফুলের সঙ্গে। তারপর একে একে বগেনভেলিয়া, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, অমলতাস ও নাম না জানা রঙিন ফুলের দল মাথা দুলিয়ে আপ্যায়ন করল। রঙিন বাড়ি, বিশাল দরজা, আলো-ছায়ার খেলা, সোজা চলে যাওয়া ফাঁকা রাস্তা বার বার পা থামিয়ে দিচ্ছিল। প্রায় সব বাড়িতেই নানা রঙের বগেনভেলিয়া দেখে আমার খিদে তখন ফুসমন্তর। মনে হচ্ছে গাছতলায় দাঁড়িয়েই এ জীবনটা কেটে যেতে পারে নিশ্চিন্তে। টনক ফিরল সঙ্গীতার প্রমেনাডের দিকে ছুটে যাওয়ার উচ্ছাসে। রক বিচে দাঁড়িয়ে রোদের নীচে দাঁড়িয়ে জলের চিকচিক দেখলাম কয়েক মিনিট। রোদের মধ্যে সমুদ্রকে পিছনে রেখে সেলফির বৃথা চেষ্টা ছেড়ে অটোয় উঠলাম। পেট আর শান্ত থাকতে পারছে না তখন। অটো চড়ে থিন ক্রাস্ট পিৎজা খেতে যাওয়ার পথেই ঠিক হল সাইকেল না নিলে চলবে না। পিৎজা খেয়ে সাইকেল সন্ধানী দুই বন্ধু দেখা পেল লেডি বার্ড-এর। 100 টাকা এক দিনের সাইকেলে চেপে ছোটবেলা এসে দাঁড়ালো সামনে। তখন আমাদের পায় কে! হোয়াইট টাউন চষে বেড়ালাম মহানন্দে। কত বৃষ্টিভেজা, রেনকোট ভাগ করে পরা, কাঠফাটা রোদ্দুরে কলেজ থেকে ফেরা, আকাশ দেখা মনে করিয়ে দেওয়া সাইকেল এত বছর পর আবার…। সাইকেল ছিল বলেই ক্যাফে হপিং জমে গেল আমাদের। এখানে লাঞ্চ, ওখানে ড্রিংকস, সেখানে ডেজার্ট করে বেড়ালাম দুটোয়। পন্ডিচেরির ক্যাফে মানেই মন ভালো করে দেওয়া ডেকর, বসে থাকতে ইচ্ছে হওয়া পরিবেশ। কোথাও প্যাস্টেল গ্রিনের ওপর বাহারি পাতার নকশায় আলোআঁধারি আবার কোথাও টুকটুকে গোলাপি রঙের আলো ঝলমল দরজা-জানালা মন ভরিয়ে দিল। আমরা ঘোরাঘুরি সেরে লেস হিবিসকাস-এ ফিরলাম প্রায় 5 টায়।
6 টার মধ্যে অরবিন্দ আশ্রম যাবার কথা তাই তড়িঘড়ি ফোনে চার্জ দিয়ে রেডি হয়ে নিলাম দু’জন। আশ্রমের ভিতরটা খুব শান্ত। তখন বন্ধ হতে আর 15 মিনিট বাকি। আমাদের ছটফট মনে শান্তি রাখার জায়গাও নেই তখন। পার্ক করা সাইকেল ডাকছে। আশ্রম ঘুরে অরোশিখা থেকে ধুপ ও সুগন্ধি কিনে অলি-গলি ঘুরে চলে গেলাম প্রমেনাডের কাছে। রাস্তায় এক মন্দিরে দেখা মিলল হাতির। প্রমেনাডে যানবাহন বিকেলের পর বন্ধ। পার্ক করে পায়ে হেঁটে গিয়ে বিচের ধারে পছন্দের জায়গা খুঁজে বসলাম। সামনে আছড়ে পড়ছে বিশাল ঢেউ। দূরে পাথরে ধাক্কা মেরে নোনা জলের দু-এক ফোঁটা ছিটকে আসছে মুখে। ঢেউ গুনতে গুনতে চলছে প্রাণের কথা। এরমক বসে থেকে কখন আটটা বেজেছে খেয়াল হয়নি। ঝিরঝিরে বৃষ্টি নামতে টনক নড়ল। রাতের খাবারের কথা ভুলে গেলে চলবে না তাই উঠে পড়লাম। এই ট্রিপ টায় সঙ্গীতা গুগল ম্যাপ দেখে দেখে অর্ধেক চাপ কমিয়ে দিয়েছিল। আমি ঐদিকটায় বেশ কাঁচা। আমরা ম্যাপ দেখে দেখে পৌঁছে গেলাম বাকেট লিস্টে থাকা একটা রেস্টুরেন্ট-এ। ক্যান্ডেল লাইটে ককটেল সহযোগে ডিনার সেরে আবার চলল সাইকেল টহল। নিয়মের তোয়াক্কা না করে প্রমেনাড দাপিয়ে এ প্রান্ত ও প্রান্ত করলাম। হাওয়াটা নেশা লেগে যাবার মতোন, আর নিজেদের শাসন করার কেউ নেই। অন্ধকারে ফাঁকা রাস্তায় গুনগুন গান আসছে গলায়। একটা অন্য ভুবন থেকে গেস্ট হাউজে ফিরলাম সাড়ে 10 টায়। শরীরে তখন ক্লান্তি, বিছানার হাতছানি উপেক্ষা করা দায়। 6 টায় এলার্ম দিয়ে স্বপ্নে ডুব দিলাম।
ঘুম ভেঙে ঘরের লাগোয়া প্রাইভেট গার্ডেন টার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ লাগছিল। তখনও রোদ আসেনি তেমন। টবে লাগানো বাহারি গাছগুলো সকালের আলোয় আরও বেশি সবুজ লাগছে। তখন প্রায় সাড়ে ছ’টা। আমরা তাড়াতাড়ি ব্রাশ করে বেরিয়ে পড়লাম সাইকেলে চড়ে। রাস্তাঘাট ফাঁকা। হোয়াইট টাউনের অলি-গলিতে ফুলের দল রাস্তা সাজিয়ে দিয়েছে। হাওয়ায় দুলছে বাড়ি আলো করে থাকা কাগজ ফুল, রাস্তার মোড়ের কৃষ্ণচূড়া। সকালে প্রমেনাডে গাড়ি-ঘোড়ায় নিষেধ নেই। এখানে প্রায় সব টুরিস্টরাই সকাল সকাল হাঁটতে বেরিয়ে পড়েছে। আমরা খানিকক্ষণ সাইকেল চালিয়ে সমুদ্র দেখতে দেখতে কফি খেতে গেলাম। বিচের ধারে ক্যাফে, খাবারের স্বাদে তাক লাগাতে না পারলেও লোকেশনের জন্য এখানে লোক আসেই। ঢেউ ভাঙা দেখতে দেখতে ক্যাপুচিনো, জীবনটা রোজ এরকম হলে কেমন হতো তাই নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা চলতে চলতে প্রায় সাড়ে আটটা বেজে গেল।
আমাদের ব্রেকফাস্ট গেস্ট হাউজ-এই। ঠিক করলাম প্রমেনাডে আর একটা রাউন্ড দিয়ে ফেরা হবে। আমরা জানতাম রক বিচে নামা যায় না সমুদ্রে, কিন্তু সাইকেল চড়ে যেতে যেতে চোখে পরে গেল নামার জায়গা। সঙ্গে সঙ্গে ছুট। সঙ্গীতা সমুদ্র পাগল, পারলে ওখানেই স্নান সেরে নেয়। আমার আবার দূর থেকেই পছন্দ, খানিক ভয় থেকেই বলা যায়। সেই সমুদ্রে ভেজা-ভেজি করে বালি মাখা পায়ে আমরা ফিরলাম। ব্রেকফাস্ট এ অঢেল আয়োজন। গোটা আনারস, পাকা পেঁপে, সবেদার জুস, হোম মেড ক্রস্যান্ট, ব্রেড, ডিম, পোহা খেয়ে শেষ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। খাওয়াটা তাড়াতাড়ি সারতেও হতো। দশটায় বেরোনোর কথা প্যারাডাইস বিচের উদ্দেশ্যে। গাড়ি এসে সাড়ে ন’টা থেকে ওয়েটিং। আমরা রেডি হয়ে বেরোলাম সাড়ে দশটায়।
পন্ডিচেরির রাস্তা খুব পরিষ্কার। হোয়াইট টাউন থেকে বেরিয়েও রং এবং ফুলের দেখা মেলে। প্যারাডাইস বিচ যাবার জন্য আগে সংলগ্ন পার্কে ঢোকার টিকিট কাটতে হয়। সাজানো গোছানো এই পার্কে পন্ডিচেরির থিম মাথায় রেখে হলুদের আধিক্য। পার্কের ভিতর ঢুকে বোট-এর টিকিট। বোট-এ করে বিচে নিয়ে যাওয়া-নিয়ে আসার ব্যবস্থা আছে। ভাড়া নেওয়া যায় নিজস্ব স্পিড বোট-ও। আমরা শেয়ার বোট-এ উঠে গরম হাওয়া খেতে খেতে পৌঁছলাম প্যারাডাইস বিচ-এ। এখানে পৌঁছে গোয়া মনে পড়তে বাধ্য। বালি দিয়ে হেঁটে যাওয়া, স্যাক, ছাতা, ভলিবল সবই আছে। কিন্তু বছর দুয়েক হল মদ্যপান-এর ব্যবস্থাটা বাদ পড়েছে। অগত্যা খানিক সমুদ্রযাপন করে ফেরার বোট-এ উঠে পড়লাম। প্যারাডাইস থেকে আমাদের সোজা অরোভিল যাবার প্ল্যান। আমাদের ড্রাইভারটি বড়ই ভালো, নিজে উদ্যোগ নিয়ে নিয়ে গেল আরিকামেদু। দক্ষিণ ভারতের আর্কিওলজিক্যাল সাইটের তালিকাভুক্ত এই জায়গাটি সুদূর অতীতে বন্দর ছিল, এখন শুধুই ধ্বংসস্তূপ আর স্থানীয় মানুষদের মদের আড্ডা। আমরা বেশিক্ষণ না থেকে গাড়িতে উঠে চললাম অরোভিল। অরোভিল-এ ঢুকে আলাদা একটা এলাকায় এলাম তা বোঝা যায়- সরু রাস্তা, দুদিকে গাছ, ছোট ছোট বাড়ি, বিদেশি স্টাইলের ক্যাফে, বিদেশিদের আধিক্য। স্টপে পৌঁছে এন্ট্রি পাস নিয়ে কিলোমিটার খানেক হেঁটে পৌঁছতে হয় মাতৃমন্দির। গম্বুজের ভিতরে ঢোকার অনুমুতি মেলে আগে থেকে বুকিং করা থাকলে। আমাদের তেমন কোনো প্ল্যান না থাকায় শুধু নিঝুম জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটার অভিজ্ঞতা নিতে ঘুরে দেখে এলাম। চড়া রোদে আর না হেঁটে ফিরলাম বাসে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর যাত্রীদের নিয়ে যাওয়া-নিয়ে আসার বাস আছে। তবে হেঁটে যাওয়ার রাস্তাটার একটা মায়া আছে, রোদের মধ্যেও আরাম আছে।
আমরা অরোভিল-এ লাঞ্চ সেরে চললাম সিরিনিটি বিচ। ছোট্ট বিচ। এই বিচটায় প্রচুর জেলেদের নৌকা। বালির পাড় খাঁড়া ভাবে নেমেছে জলের দিকে, তাই ঢেউয়ের দাপট বেশি। এমনিতেও পন্ডিচেরিতে সমুদ্র উত্তাল। এই জল পা ছোঁয় তো ওই কোমর অব্দি ভিজিয়ে দেয়। এক একবার তো ঢেউ দূরে রেখে আসা জুতোকেও ছুঁয়ে আসছে। আমরা দুজনেই জামাকাপড় ভিজিয়ে হুল্লোড় করতে করতে গাড়িতে উঠলাম। আচমকা ঢেউয়ের ধাক্কায় ভিজে যাওয়া সারাদিনের গরম ভুলিয়ে দিল।
গেস্ট হাউসে গাড়ি এসে নামালো প্রায় পৌনে পাঁচটায়। একটু রিল্যাক্স করে শেষ রাতটা কাটানোর জম্পেশ প্ল্যান। পার্টি লুকে সাইকেল নিয়ে সাড়ে সাতটা নাগাদ বেরোলাম আমরা। ডিনার-এর জায়গা কলকাতা আর বেঙ্গালুরুতে বসে আলোচনাতেই ঠিক করা ছিল। সাইকেল পার্ক করে পৌঁছে গিয়েছিলাম প্রমেনাড-এর রুফটপ-এ। খাবার টেবিলে বসে কাঁচের ওপারে দেখা যায় আওয়াজ করে আছড়ে পড়ছে ঢেউ। হালকা হওয়ায় গল্প করতে করতে ভিজে যাচ্ছিল মন। কথা ফুরোচ্ছিল না আমাদের। খাওয়া-দাওয়া সেরে আমরা জিলাতোর কোণ হাতে নিয়ে চলে গিয়েছিলাম রক বিচের ধারে। হাতে গলে পড়া আইসক্রিম, নেশা লাগা চোখ, চেয়ে থাকা বহুদূর। ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতে ইচ্ছে না করলেও মন বলছিল ‛অদ্যই শেষ রজনী’। শেষ রাতের আলোগুলো গায়ে মেখে, মন কেমনগুলো ঢেউয়ে ভাসিয়ে, ভালোলাগার ঝিনুকগুলো আগলাতে আগলাতে রাত 11 টা ছাড়িয়েছে। শুনশান রাস্তা দিয়ে দ্রুত প্যাডেল-এ ফিরলাম গেস্ট হাউজে। মনে তখন রাত পেরোলেই ট্রিপ ফুরোনোর দুঃখ, কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই।
ফেরার দিন উঠলাম একটু দেরিতে। আজ এমনিও কতগুলো ক্যাফে ঘুরে টুকটাক খাওয়া আর সাইকেলদুটো জমা দেওয়া ছাড়া বিশেষ কিছু কাজ নেই। ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করতে গেলাম। ব্রেকফাস্ট এরিয়াটাও নিচের তলার মতো নানান আসবাব ও ভিন্টেজ জিনিসপত্রে সাজানো। একপাশে বারান্দা আর অন্যপাশে দুদিকে দুটো রুম-এর মাঝে একটা ছোট্ট গাছপালা ও শো-পিস-এ সাজানো খোলা জায়গা। একফালি রোদ খোলা জায়গাটার রঙিন কাঁচের জানলায় তেরছাভাবে পড়েছে। আলো-ছায়ায় ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে মাটিতে থাকা বুদ্ধমূর্তি ও গাছগুলো। শান্ত মনে চেয়ে আছি, এই দেখাটাতেই কী ভীষণ আরাম। আগের দিনের মতোই প্রচুর ফল, ডিম, জুস, ব্রেড, দোসা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা রুমে গেলাম।
সুটকেস গোছানোই ছিল। রেডি হয়ে শেষ বারের মতোন সাইকেলবিহার শুরু হল আমাদের। প্রমেনাড দিয়ে সাইকেল চালিয়ে আমরা গুগল ম্যাপ দেখে এ গলি সে গলি ঘুরে পৌঁছে গেলাম মিশন স্ট্রিট-এর সেই সাইকেল গ্যারেজে। সাইকেলের মায়া কাটিয়ে রোদের জেরে হাঁটা পথও অটোর ভরসাতেই চললাম। পন্ডিচেরি গেছে কিন্তু ক্যাফে ডেজ আর্টস যায়নি এমন লোক খুব কম আছে। এমনিও বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকার পর এটা এই সপ্তাহেই আবার খুলেছে। তাই মিস করার উপায় ছিল না। বাইরে ছবি আঁকা হলুদ দেওয়াল, সাজানো রিকশায় নুয়ে পড়া বগেনভেলিয়া, প্যাস্টেল শেডের চেয়ার, নিচু টেবিল, বাহারি কুশন, ভিন্টেজ ফোন, বই ভর্তি রঙিন আলমারি, সিলিং থেকে ঝুলে থাকা নরম আলো- সবকিছুর মধ্যেই একটু করে আরাম ভরা। বসে থাকা যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কিন্তু সময় কম। বাকেট লিস্টে বাকি আরো কটা টাচ পয়েন্ট। পেট ভর্তি ব্রেকফাস্ট-এ। তাও পায়ে হাঁটা দূরত্বের আরও একটা ক্যাফে ও দুটো বেকারি ঘুরে নিলাম শুধু লোভে পরেই। চিজ কেক-এ মন ডুবিয়ে 1 টার কিছু আগে ফিরলাম গেস্ট হাউজে। গাড়ি এসে গেছে। মিনিট দশেকের মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম। ড্রাইভারকে বললাম প্রমেনাড রোড নিতে। শেষবারের মতো সমুদ্রের সঙ্গে দেখা করিয়ে গাড়ি টাটা করল পন্ডিকে। আমাদের পন্ডি ডায়েরি শেষ হল পাতা উপচে পরা ভালোলাগা আর আবার একসঙ্গে অন্য কোথাও পথ হাঁটার প্রমিস দিয়ে।
খুঁটি-নাটি তথ্য-
চেন্নাই থেকে পন্ডিচেরি ক্যাব- ১৬০০-২০০০-এর মধ্যে (ওয়ান ওয়ে)
লেস হিবিসকাস- ২ বেড রুম-এর ভাড়া দিন প্রতি ৩৩০০ (ট্যাক্স সহ), ব্রেকফাস্ট কমপ্লিমেন্টারি
(থাকার জন্য প্রমেনাড রোড বা হোয়াইট টাউন এলাকা বাছা ভালো)
সাইকেল রেন্ট- ১০০ টাকা/দিন প্রতি (একটা ID Proof জমা দিতে হয়)
সাইট সিয়িং-এর গাড়ি রেন্ট- প্রথম ৩ ঘণ্টা ৭০০ টাকা, পরবর্তী প্রতি ঘণ্টায় ১৫০ টাকা করে
প্যারাডাইস বিচ- পার্কে ঢোকা এবং বোট রাইড-এর টিকিট আলাদা
ঢোকার টিকিট- ১০ টাকা জন প্রতি (ক্যামেরার জন্য আলাদা টাকা লাগে)
বোট টিকিট- ২০০ টাকা জন প্রতি (যাওয়া-আসা নিয়ে)
অরোভিল-
মাতৃ মন্দির ভিউ পয়েন্ট- পাস বিনামূল্যে অরোভিল ভিসিটর সেন্টার থেকে পাওয়া যায়। পৌঁছে নিয়ে নেওয়া যায়।
সময়- সোম থেকে শনি- সকাল ৯ টা-বিকেল ৪ টা, রবিবার- সকাল ৯ টা থেকে দুপুর ১.৩০ টা
মাতৃমন্দিরের ভিতরে যাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট দিনের আগে নিজে উপস্থিত থেকে বুকিং করতে হয়।