লে-তে দু’রাত কাটিয়ে আমরা রওনা দিয়েছিলাম নুবরা ভ্যালি। প্রেমে পড়ে যাওয়ার মতো রাস্তা, বদলে যেতে থাকা আকাশ, রোদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রং বদলাতে থাকা মরুপাহাড়ের সঙ্গে উপরি পাওনা হয়েছিল ঝিরঝিরে বরফ। সেই সব গল্পের পাতা খুলছি এবার।
কিস্তি ২
1 সেপ্টেম্বর, 2017
লে-এর সাইট সিয়িং সেরে হোটেল ফিরে শরীরটা হালকা বিগড়েছিল। ওষুধের ওপর আছি। গলাটার 12 টা বাজিয়েছি। আজ আমরা নুবরা ভ্যালির দিকে যাব। ফুনগসুক এসেছে সকাল সকাল। ভারি মজার লোক। গল্প করতে করতে মনোরম পথের ওপর দিয়ে চলছে গাড়ি। প্রথমে খারদুঙ লা পাস হয়ে যাওয়া। এখানে নাকি অক্সিজেন-এর অভাব অবধারিত। পাকদন্ডী রাস্তা, বমি হতে পারার আশঙ্কা, হাই অলটিটিউ জনিত টেনশনে বেশ কিছু ওষুধ আগেই খেয়ে নিয়েছি। আজ ওয়েদার খারাপ। থেকে থেকে বৃষ্টি আসছে, যত ওপরে উঠছি ঠান্ডাও বাড়ছে। নীচে কোথাও সবুজ চাষ জমি, কোথাও পাথরভাঙ্গা রুক্ষতা। উপর থেকে কোনও কোনও বাঁকে ট্রাক বা গাড়ির চলে যাওয়া দেখে রোমাঞ্চ হচ্ছে।
কিছু কিছু পাহাড় চুড়োয় দেখছি বরফের নকশা। যত উঠছি বরফ হাতের কাছে মনে হচ্ছে। রাতে বরফ পড়েছে বলে ঠান্ডাও বেড়ে গেছে। বন্ধ গাড়ির মধ্যেও যেন কেঁপে উঠছি। কোনো পাহাড়ে বৃষ্টি আবার কোনোটায় উঠে মেঘ রোদ্দুরের খেলা দেখতে দেখতে অবশেষে এসে পৌঁছলাম খারদুঙ লা। গাড়ি থেকে নেমে বুঝলাম সবেমাত্র বৃষ্টি হয়ে গেছে। পাহাড়ের গায়ে ভেজা ভেজা বরফ। হাতে গ্লাভস, মাথায় টুপি, মাফলার, জ্যাকেট-এও ঠান্ডা যেন মানছে না। অর্ক বলেই দিয়েছিল এখানে গাড়ির বাইরে 5-10 মিনিট এর বেশি এক্কেবারে না। অক্সিজেন-এর অভাবে নানাধরনের সমস্যার আশঙ্কা ছিলই। সকলে নেমে খচখচ ছবি তুলে, একটু বরফ নিয়ে কেদ্দারী মেরে গাড়ির ভিতর সেঁধিয়ে গিয়েছিলাম। এইটুকু সময়েই আমাদের সঙ্গীদের মধ্যে একজন যদিও বরফে হড়কে পড়ে এসেছে! নিশ্বাস নিতে কষ্ট সত্যিই হয় এখানে। তবে আমি নিজের বা সঙ্গীদের মধ্যে কোনো পাগলামির লক্ষণ দেখিনি। সেটা হয়তো বেশিক্ষণ বাইরে ঘুরিনি বলেই।এখানে মানুষের বিশ্বাস ছোট ছোট পাথর একটার পর একটা সাজালে সেটা যদি ঠিক দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে যাত্রা শুভ হয়। অর্ক গাড়িতে ওঠার আগে অমন একটা তৈরি করেছিল। তা দেখে ফুনগসুক খুব খুশি। খারদুঙ লা থেকে গাড়ি অল্প এগোনোর পর আরও একটা বরফে ঢাকা পাহাড়ে ছবি তুলতে নামলাম আমরা। এখানেই প্রথম স্নো ফল দেখলাম। জীবনের প্রথম স্নো ফল। মনে হচ্ছিল খানিকক্ষণ ছুটে বেড়াই। ঝিরঝিরে বরফগুলো গায়ে পরে জল হয়ে যাচ্ছে। ভারী মজা। কিন্তু বরফ মাথায় নিলে জ্বর হয়ে ট্রিপ মাটি হয়ে যেতে পারে সেই ভয়েই তাড়াতাড়ি গাড়ির জানলা তুলে রওনা দিলাম।
আজ লাদাখের সত্যিকার সৌন্দর্য দেখছিলাম পদে পদে। কি ভীষণ ভালো রাস্তা, যেদিকে তাকাই পাহাড়। কোথাও কার্ভ-এর ওপর সরু সরু রেখার মতো রাস্তা কোথাও হেয়ার পিন বাঁক বাইরে থেকে চোখ সরাতে দিচ্ছিল না। কোথাও আবার রাস্তার পাশে দিয়ে বয়ে গেছে খরস্রোতা নদী। এই মেঘ এই বৃষ্টি আবার এই রোদ, এমন মায়াজাল বোধহয় প্রকৃতির পক্ষে এখানেই বোনা সম্ভব। আমরা পাহাড়ের কোলে একটা ক্যাফে-তে খেতে এলাম, নাম টা খেয়াল করি নি। ছোট্ট জায়গা কিন্তু অনবদ্য ভিউ। মনে হল, এখানটায় দাঁড়িয়ে থেকে জীবন কাটিয়ে দিতে পারলেই বেশ হতো। ভিতরের বেশ ঘরোয়া পরিবেশ। ক্যাফের মালকিন ভদ্রমহিলার স্বামী সিয়াচেন-এ কাজ করতেন। তার একটা সার্টিফিকেট ঝোলানো আছে কাউন্টারের সামনে। দুটো লম্বা কানের ফারওয়াল কুকুর এদিক ওদিক ঘুরছে। এরম ঠান্ডায় ম্যাগি খেতে বড্ড ইচ্ছে করছিল আমাদের সবার। চিজ ম্যাগি, ভেজ ম্যাগি, এগ চিজ ম্যাগি, স্যুপ জমিয়ে খেলাম। পাহাড়ের গা ঘেঁষে বসে ধোঁয়া ওঠা ম্যাগি খেতে ভালো লাগে না এমন লোক খুব কমই পাওয়া যাবে।
এখান থেকে যখন বেরোলাম আবার ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হল। বৃষ্টি যে আমাদের পুরোপুরি পিছু ছাড়বে না তা বুঝে গিয়েছিলাম ততক্ষণে। আর একটু চলতে চলতে বুঝতে পারছিলাম অনেকটাই নীচে নেমে এসেছি। নুবরা লে থেকে বেশ খানিকটা নিচুতে তা জানাই ছিল। রাস্তায় এবার নিচের দিকে তাকালে গাছ দেখতে পাচ্ছি। পাহাড়ি রাস্তার পাশে শান্ত নদীর এঁকে-বেঁকে বয়ে চলা ছবির মতো লাগছে। আবার একটা পয়েন্ট এ দাঁড়াতেই হল। এতটাই সুন্দর গাড়ি থেকে দেখে প্রাণ ভরছিল না যেন আমাদের। নেমে দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল এ দৃশ্য কাউকে ছবি দেখিয়ে বা বর্ণনা দিয়ে বোঝানোর নয়। যে দৃশ্য চোখ ভরে দেখার, যত্ন করে মনের ভিতর রাখার।
এখান থেকে আরও খানিকক্ষণ আঁকা-বাঁকা রাস্তা পেরিয়ে চোখে পড়ল মরুমভূমির রেখা। আরো নীচে নামার পথে দেখলাম স্যান্ডডিউন। একই জায়গায় সবুজ গাছ, ধূসর পাহাড়, বহমান নদী আর মরুভূমির এমন সহাবস্থান দেখতে পাব তা আমার কল্পনারও অতীত ছিল। আর একটু এগিয়ে রাস্তার পাশে একটা ঝিলের জলে পাহাড়ের ছায়া পরা দেখে আমরা আর একবার দাঁড়ালাম। মনে হল যেন রূপকথার বইয়ের কোনো পাতায় গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়েছি সদলবলে। মুগ্ধ চোখে দেখে, কয়েকটা ছবি তুলে রওনা দিলাম আবার। এখানে আশপাশটা সবুজ। চাষের জমি আর গাছপালা আছে। এরপর আবার খানিকটা ওপরে উঠতে হল ডিসকিত মনেস্ট্রি যাওয়ার জন্য। যাওয়ার বাঁকগুলোর আকাশে পাহাড়ের খাঁজ দিয়ে মেঘ সূর্যের খেলা দেখলাম প্রাণ ভরে। পাহাড়ের গা ঘেঁষে মনেস্ট্রি, যেমনটা হয় আর কি। মনেস্ট্রির চূড়োর মূর্তি অনেক দূর থেকে আগেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল। ঠিক যেমন যতই উপরে ওঠো লে থেকে শান্তি স্তূপাটা দেখতে পাওয়া যায়। মনেস্ট্রি পৌঁছে মূর্তির উচ্চতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা হল। এখান থেকেও বড় সুন্দর ভিউ। নীচে সবুজ গালিচা, উপরে পাহাড়, পাহাড়ের খাঁজ দিয়ে দূরের বরফ ঢাকা পাহাড়ের চূড়ো। চোখ বন্ধ করতে ইচ্ছে করবে না এমন জায়গায় এলে। স্তূপা প্রদক্ষিণ করে ঘুরে এলাম মনেস্ট্রির ভিতরে। একদম শান্ত। মোজা পরে পা টিপে টিপে হাঁটলেও শব্দ শোনা যায়। আমার এমনিই ধম্ম কম্মে মন নেই। কিন্তু এরকম নিস্তব্ধতা আমার বেশ লাগে। মনেস্ট্রি থেকে বেরিয়ে আরও একটু সময় কাটিয়ে চললাম নুবরার হোটেলের পথে। আলো পরার আগে হুন্ডার-এ যেতে হবে। উটের পিঠে চড়া, আলো ছায়ার ছবি তোলা, বাকেট লিস্ট-এর অনেক কিছু এখনো বাকি।
ডিসকিট থেকে হোটেলটা বেশ খানিকটা দূরে, হুন্ডার-এর দিকে। অনেক হোটেল ছাড়িয়ে ভিতর দিকে যেতে হল। কিন্তু পৌঁছে যা দেখলাম তার জন্য আরো কয়েক মাইলও নির্দ্বিধায় চলে যেতে পারতাম। হিমালায়ন ইকো রিসর্ট-পাহাড়ে ঘেরা ছোট ছোট কটেজ। কাঠের ঘর থেকে বেরিয়েই চোখ জুড়িয়ে যায়, চোখ মেললেই পাহাড়, বাহারি ফুল, নানান ধরণের গাঁদা, আপেল, উইলো গাছ, দোলনা, কাঠের ঘেরা বসার জায়গা-এখানে এক রাত্তিতে থোড়াই মন ভরে! চেক-ইন করে বাইরে বসে একটু চা খেয়েই বেরিয়ে পড়লাম মরুভূমির উদ্দেশ্যে।
নুবরা ভ্যালি এসে যখন গাড়ি থেকে নামলাম তখন সেখানে বেশ লোকজন আছে। এই প্রথম অন্য জায়গাগুলোর থেকে বেশি ট্যুরিস্ট দেখলাম। সাঁকো দিয়ে নদী পেরিয়েই বালি আর উটের বিষ্ঠা। সাবধানে পা ফেলে পৌঁছলাম উটের কাছে। বালির ওপর পা ফেলে ফেলে সওয়ারী নিয়ে এগিয়ে চলছে দু’কুঁজ ওয়ালা উট। উটের পায়ের ছাপে বদলে যাচ্ছে বালির নকশা। দূরে পাহাড়ের উপর মেঘের ছায়া। বালির ওপর রোদ পরে চিকচিক করছে। মেঘ, পাহাড়, উটের ছায়া পড়ছে এখান-ওখানে জমা জলে। রোদের সঙ্গে এখানে পাহাড়, বালির অদ্ভুত খেলা চলে সারাক্ষণ। জমা জলে আকাশের প্রতিচ্ছবি ধাঁধা লাগিয়ে দেবার মতো। যা দেখছিলাম ক্যামেরায় তা ধরা যায় না, চোখে দেখার মজাই আলাদা। অর্ক উটের পিঠে উঠবে না। আমরা বাকি ৫ জন আধ ঘন্টার জন্য উটের সঙ্গী হয়ে উঠে পড়লাম পিঠে। ওঠার সময়টা টেনশন হয়, তারপর দুটো কুঁজের মাঝে ঠিকমতো সেট হয়ে গেলে আর ভয় নেই। একটু চলার পর বেশ নড়তে নড়তে ছবি তুলতে শুরু করে দিলাম। মরুভূমির ওপর দিয়ে যেতে যেতে সূর্যের রূপবদল দেখছি। কিভাবে যে আধ ঘন্টা কেটে গিয়েছিল খেয়ালই হয়নি। উটের পিঠ থেকে নেমে গেলাম স্যান্ডডিউন দেখতে। অর্ক একা একা ঘুরছিল সেখানেই। সবাই দাঁড়িয়ে গল্প করতে করতেই সূর্য চুপ করে ডুবে গেল। পাহাড়ের ওপর মেঘের ছায়া মিলিয়ে গেল, লালচে আভা, ছায়া সব কেমন নিমেষে বদলে গেল অন্ধকারে।
সেই দুপুরের ম্যাগির পর সেরকম কিছু পেটে পড়েনি। খিদে পেয়ে গিয়েছিল ভীষণ। পাশে একটা ছোট ক্যাফে থাকলেও সেরকম পছন্দ না হওয়ায় রওনা দিলাম হোটেল-এর পথেই। অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হোটেল-এ ছুটল গাড়ি। ফিরে দেখলাম এক বিশাল বিদেশি টুরিস্ট গ্রুপের বার-বি-কিউ পার্টি হচ্ছে। তা তাদের খাওয়া দাওয়া শেষ হলে তবে আমরা খেতে যেতে পারব। এখানে ফোনে নেটওয়ার্ক নেই। কিন্তু হোটেলের বয়-দের ফোন থেকে বাড়িতে খবর দেওয়ার উপায় আছে। এই সময়টা আমরা একে একে সেই কাজটা সেরে ফেললাম।
রুমে এসে খিদে মেটাতে স্নিকার খেতে হল। ডিনার সারলাম গরম গরম ভাত ডাল পনীর চিকেন পাঁপড় দিয়ে। এত নির্জন প্রত্যন্ত জায়গাতেও এমন আয়োজন দেখে মনে ভরে গেল। রুমের বাইরে অর্ক তারাদের ছবি তুললো বেশ কিছুক্ষণ। আমি তখন ঠান্ডায় জবুথবু। লে-তে ঠান্ডা বেশি থাকলেও তেমন শীত লাগছিল না রুমের ভিতর। ওখানের হোটেল টায় টেম্পারেচার কন্ট্রোল গ্লাস উইন্ডো ছিল। কিন্তু এখানে আমি কেঁপে মরছি। নুবরা লে থেকে নিচু, কিন্তু ঠান্ডা আমার অনেক বেশি লাগছিল। পাহাড়ি জায়গায় ডিনার কমপ্লিট হয়ে যায় 9টার মধ্যে। কলকতাবাসীদের তো ঘুম আসতে আসতে রাত 12 টা বাজেই। তাই রোজকার মতো একটা রুমে এক হয়ে আমাদের আড্ডা চলল আজও। হুন্ডার-এর অদ্ভুত মায়াবী সৌন্দর্য অনেকক্ষণ আমাদের আলোচনায় ফিরে ফিরে এল। উটের পিঠে ওঠা নিয়ে হাসি ঠাট্টার মধ্যে বেড়ে চলল রাত। বাড়তে লাগল শীতও। আজই যদি এমন হয় প্যানগঙ-এ কি অপেক্ষা করছে সেই ভাবতে ভাবতেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিজেদের রুমে ফিরে সোয়েটার পরেই লেপের তলায় সেঁধিয়ে গেলাম।
ক্রমশ…
আরো কিছু লেখা:
লাদাখ ভ্রমণের প্রথমাংশ জানার জন্য click করুন এখানে।
লাদাখ ভ্রমণের দ্বিতীয়াংশ জানার জন্য click করুন এখানে।
লাদাখ ভ্রমণের তৃতীয়াংশ জানার জন্য click করুন এখানে।
লাদাখ ভ্রমণের চতুর্থাংশ জানার জন্য click করুন এখানে।
লাদাখ ভ্রমণের পঞ্চমাংশ জানার জন্য click করুন এখানে।
Follow me on Facebook & Instagram.
[…] ক্রমশ… […]