নুবরা থেকে অনেকেই লে ফিরে তারপর আবার প্যানগঙ যায়। আমাদের প্ল্যান ছিল সরাসরি নুবরা থেকে প্যানগঙ। একটু রিস্কি রাস্তা শুনেও এডভেঞ্চার-এর লোভ ছাড়িনি আমরা। লাদাখ বেড়ানোর এই পর্বে প্যানগঙ, চাঙ লা পাস, আর প্রচুর বরফ দেখার গল্প।
2 সেপ্টেম্বর, 2017
তাড়াতাড়ি বেরোনো তাই সকাল সকাল রেডি হয়েছি আমরা। সকালের আলোয় নুবরার পাহাড় ঘেরা রিসর্ট দারুন দেখাচ্ছে। আজ রোদ ঝলমল চারদিক। নীল আকাশে সাদা মেঘ, দাঁড়িয়ে থাকা সবুজ গাছের সারি চোখে আরাম দিচ্ছে। এসব দেখতে দেখতে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম প্যানগঙ-এর উদ্দেশে। নুবরার হোটেল টা এতটাই সুন্দর ছিল যে ছেড়ে আসতে রীতিমতো কষ্ট হচ্ছিল। বাহারি দোলনা, কাঠ কেটে বানানো বেঞ্চ, ফুল, পাহাড় সবই যেন পিছু ডাকছিল। আগে থেকেই জানা ছিল আজকের রাস্তা খুব আনপ্রেডিক্টেবল। মাঝে মাঝেই পাথর পরে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়, গাড়ির ওপরও পাথর গড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে। কত সময় লাগবে, পুরোটা আদৌ এ পথে যাওয়া যাবে কিনা কোনও কিছুতেই নিশ্চয়তা নেই।
মিনিট 15-20 যাওয়ার পরই রাস্তার মজা টের পেলাম। একটা জায়গায় এসে সামনে গুঁড়ি ফেলে রাস্তা আটকে দেওয়া হয়েছে। ফুনগসুক জানাল, আগের বার এ রাস্তা দিয়েই সে গিয়েছিল, কিন্তু এখন রাস্তা হাওয়া! তারাপর দেখা গেল একটু এগিয়ে ছোট্ট জলের স্রোত পেরিয়ে তৈরি হওয়া ছোট্ট রাস্তা একটা পাক নিয়ে আবার মূল রাস্তা ধরেছে। সেই প্রথম এ রাস্তার থ্রিল নেওয়া শুরু। তারপর যত এগিয়েছি তত সারপ্রাইজ পেয়েছি। যেই ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা তাক করছি এমন বাঁক এসে যাচ্ছে ইমেজ হয় নড়ে যাচ্ছে না হয় হারিয়ে যাচ্ছে। আর কেউ ছবি তুলতে গেলেই ফুনগসুক বলছে ‛আরে পেহলে দেখিয়ে পাতথার গির রাহা হ্যায় ইয়া নেহি!’ সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা কোলে গুটিয়ে রেখে নড়েচড়ে খাঁড়াই পাহাড়ে চোখ রাখছি। খানিকটা এভাবে ধূধূ পাহাড় ঘেরা চড়াই-উৎরাই-বাঁক পেরোনোর পর সুযোগ পেলাম গাড়ির সামনে বসার। এ যেন সব পেয়েছির দেশে পৌঁছে যাওয়া। গোটা ট্রিপ এ এই প্রথমবার ড্রাইভারের পাশের সিটটি আমার! চোখ ভরে দেখবো নাকি যা দেখছি তা ক্যামেরাবন্দি করার চেষ্টা করব তাই ভেবে পাচ্ছি না তখন। মনে হচ্ছে এটাই রিয়েল লাদাখ। কোথাও কোনও জনবসতি নেই, মাঝে মাঝে অনেক নিচে কোথাও মিলিটারি ক্যাম্প-এর মাথা উঁকি দিচ্ছে, কোথাও বা একটু সবুজ আবার কোথাও শান্তভাবে বয়ে যাচ্ছে নাম না জানা নদী। দুদিকে উঠে যাওয়া খাঁড়াই পাহাড়, রাস্তার পাশে গড়িয়ে এসে পরা টুকরো-টাকরা পাথর আর দিগন্ত ছুঁয়ে থাকা কালো পিচ রাস্তা। কখনো দেখছি সামনে সোজা পথ কখনো বা পেঁচানো বাঁকে আঁকা-বাঁকা পথের নকশা।
এভাবে চলতে চলতে এক জায়গায় এসে দেখলাম রাস্তার ওপর দিয়ে জলের ধারা নেমে যাচ্ছে নিচের খাতে। নদী বা নদীর মতো এরকম কিছু এর আগেও দুবার পেরিয়েছি কিন্তু এটা একটু বেশিই গভীর। তাই গাড়ি গেল দাঁড়িয়ে। একই পথে আসা অন্য আরেকটি গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ঠিক হল পাথর ফেলে গভীরতা একটু কমিয়ে গাড়ি জল পর করবে। তার জন্য গাড়ি থেকে যাত্রীদের নেমে নদী পার হতে হবে। এতে গাড়ির ভার হালকা হবে। অগত্যা নামতে হল। আমাদের ফুনগসুক জলে নেমে পাথর ফেলতে লেগে গেল। দুরু দুরু বুকে গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এসে ভেজা পাথরে টিপে টিপে পা রেখে পার হলাম নদী। একটু বেসামাল হলেই খাদে পড়ে যাবার আশঙ্কা। ওপারে গিয়ে যে বিশ্বজয় করার অনুভূতি হল তা বলতে দ্বিধা নেই। তারপর গাড়ি হেলেদুলে পেরিয়ে যাওয়ার পর সে আমাদের কী হুল্লোড়! জল-যুদ্ধে জিতে যাওয়ার আনন্দ বুকে নিয়ে চলতে শুরু করলাম আবার। দুদিকে পাহাড় এখন একটু দূরে, রাস্তার পাশে নুড়ি-পাথরে ভরা চওড়া সমতল অংশ। এরকমভাবে খানিকটা চলার পর আবার আগের মতোই আঁকা-বাঁকা খাঁড়াই পথ। এক এক সময় দুদিকে খাঁড়া পাহাড়ের মাঝে সরু রাস্তা কোথায় পৌঁছেছে বুঝতে পারছি না! বাঁক ঘোরার আগে অদ্ভুত শিহরণ হচ্ছে। ধূ-ধূ প্রান্তর ছাড়িয়ে খাঁড়াই দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের গায়ে কখনো এক চিলতে মেখ নেমে এসে খেলা করে যাচ্ছে। আকাশের নীল, পাহাড়ের ধূসর, হঠাৎ দেখা সবুজ কিংবা পাহাড়ের গা ঘেঁষে নেমে আসা খরস্রোতার সফেন মনের ক্যানভাসে তখন রং ঢালছে ইচ্ছেমতোন। খাঁড়াই রাস্তার পাশে স্বচ্ছ সবুজ জলের নদীর বয়ে চলা দেখতে দেখতে হঠাৎই বাঁক ঘুরে নেমে এলাম একটু নীচে, সেখানে দুদিকে বাঁধানো পাঁচিল ঘেরা পথের পাশে ঝাউগাছ। বুঝলাম এবার শেষ হল এডভেঞ্চার পথ। এখানেই একটা হোটেলে ম্যাগি, থুকপা, আর পাহাড়ি এক ধরণের ভাত খেলাম সকলে। তারপর আবার সকলের গাড়িতে উঠে প্যানগঙের পথে। এবার রাস্তা সোজা চলে গেছে, চড়াই উৎরাই নেই। এই জায়গাটাতেই লে থেকে আসা রাস্তাও প্যানগঙ-এর পথ ধরে।
উচ্চতার নিরিখে অনেকটা নেমে এসেছি। এদিক সেদিক ঘাস জমি, স্বচ্ছ জলের নদীর রেখা, পশুদের চড়ে বেড়ানো চোখে পড়ছে। আস্তে আস্তে মেঘও করছে। বলেছিলাম না বৃষ্টি পিছু ছাড়বে না! এদিকটায় পাহাড়ি প্রাণী মারমট-দের দেখা মেলে। কিন্তু বৃষ্টির জন্য তারা সব গর্তে সেঁধিয়ে গেছে। কয়েকটা টুক করে মুখ বাড়িয়েই আবার ঢুকে যাচ্ছে চোখের পলক পড়তেই। আরও কয়েকটা বাঁক ঘুরে দূরে পাহাড়ের ফাঁকে দেখা দেওয়া শুরু করল নীল জলের রেখা। বুঝতে পারলাম বহু প্রতীক্ষিত প্যানগঙ এবার হাতের কাছেই। যত এগোচ্ছি জলের রেখা চওড়া হচ্ছে, একবার বাঁদিকে তো একবার ডানদিকে সেই মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে হঠাৎই আমাদের গাড়ির বাঁ পাশ জুড়ে এসে পড়ল লেক, প্যানগঙ লেক। লম্বা চলে গেছে দূরে, শেষ দেখা যায় না। লেকের পাশ দিয়ে একটু এসেই গাড়ি থামল ভিউ পয়েন্ট-এ। এখানে সুন্দর একটা কার্ভ তৈরি হয়েছে। থ্রি ইডিয়েটস এর সেই বিখ্যাত এন্ডিং সিকোয়েন্স স্যুট হয়েছে এখানে। এ জায়গাটা সেই সুবাদে খানিক কমার্শিয়াল করে ফেলেছে কিছু স্থানীয় লোকজন। এখানে থ্রি ইডিয়েটস-এর প্রপ ব্যবহার করে ছবি তোলার ব্যবসা শুরু হয়েছে। এমন পরিবেশে ওই প্রপ গুলো বেখাপ্পা লাগলেও এটাই কিছু মানুষের রুজি-রুটি ভেবে তখন গাড়ির ভিতরেই মনকে সান্তনা দিচ্ছি। বৃষ্টি নেমেছে। থামার অপেক্ষায় বসে আছি। 5 মিনিট দেখে নেমে পড়লাম দড়জা ঠেলে। কি প্রচন্ড হাওয়ায় রীতিমতো কাঁপছি। আমরা জ্যাকেট গ্লাভস সব পরে নেমেছি এদিকে আমাদের ড্রাইভার পাতলা উইন্ডচিটারেই ফিট। প্যানগঙকে দেখে ওই ঠাণ্ডাতেও ঘোর লেগে গেল। এর আগে প্যানগঙ-এর ঘন নীল রঙের ছবি দেখেছি, কিন্তু সামনে এসে দেখছি জলের রঙ মেঘের রঙের মতো ঘোলাটে। আকাশ নীল হলে তবে না জল নীল হবে! কনকনে হাওয়ার চোটে পুরো কার্ভ-টা যেতে পারলাম না, কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসলাম গাড়িতে। এখান থেকে আরও কয়েক মাইল গিয়ে জলের ধারে আমাদের টেন্ট। আর দেরি না করে রওনা দিলাম সেদিকেই। যেতে যেতে বৃষ্টি থেমে গেল কিন্তু মেঘ সরল না সেভাবে।
গাড়ি থেকে নেমে আমরা লেকের দিক থেকে পর পর তিনটি টেন্ট-এ নিজেদের ব্যাগপত্তর ঢুকিয়ে দিলাম। টেন্ট গুলো বেশ সুন্দর, ভিতরে লেপ কম্বল দেওয়া খাট, ছোট টেবিল, নিজস্ব টয়লেটে কমোড বেসিন সবই আছে। বরফ পড়া শুরু হলে এরা বালিশ-বিছানা, টেবিল, চেয়ার গুটিয়ে নিয়ে চলে যায়। শুধু দাঁড়িয়ে থাকে সিমেন্ট-এ বাঁধানো বেসিন কমোড-সহ বাথরুম। টেন্ট-এ ঢুকে একটু মুখ হাত ধুতে ধুতেই বাইরে হালকা রোদ উঠল। আমরা বেরিয়ে পড়লাম মুহূর্ত নষ্ট না করে। জলের কাছাকাছি উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো হাওয়া। আর তেমনই ঠান্ডা। আকাশে একপাশে রোদ আর একপাশে মেঘ। নীল মেঘের দিকে জলও নীল। লেকের ধার বরাবর কোনও পাহাড় হলদেটে কোনওটায় আবার গাঢ় বেগুনি রঙের আভা… আর প্যানগঙের জলে সেই সব রং মিলে যাচ্ছে কালার প্যালেট-এর মতো। পুরো লেক জুড়ে ছবিতে দেখার মতো ঘন নীল জল দেখতে পাচ্ছি না বটে কিন্তু এমন রংমিলান্তি এতটাই মায়াবী ওই উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হাওয়াতেও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। পাহাড়গুলোর ওপর মেঘের ছায়া, জলে আবার ছায়ার ছায়া, এমন দৃশ্য দেখতে দেখতে সবার মধ্যেও একা হয়ে যাওয়া যায় সহজেই।
অর্ক ক্যামেরা নিয়ে অন্যদিকে ছিল, আমরা হলোফিল জ্যাকেটের তলায় পরা সোয়েটারেও না আটকাতে পারা ঠান্ডা আগলে মাথায় টুপি মাফলার জড়িয়ে হাঁটছি পার ধরে। এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা। ট্যুরিস্ট এদিকে কম। আমাদের টেন্ট ও আশেপাশের দুটো টেন্ট-এ কিছু লোকজন রয়েছেন। তবে এদিকটায় এখন শুধু আমরাই। দূরের টেন্টগুলো জমে থাকা বরফের মতো দেখতে লাগছে এখান থেকে। পাহাড়ের রং মাফিক বদলে যাচ্ছে জলের রং। ফটো তুলছি কিন্তু চোখে যা দেখছি তেমন সুন্দর হচ্ছে না। হঠাৎ একটা পাখি কোত্থেকে উড়ে এসে সাঁতরাতে শুরু করল। যেই তাঁর ফটো তুলতে যাই অমনি মাথা ডুবিয়ে দেয় জলে। হাল ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম একপাশে তৈরি হওয়া কার্ভ-এ। এদিক থেকে ওপাশটা দেখতে বেশ লাগছে। জলের মধ্যে তৈরি হওয়া সরু নুড়ির রাস্তা বেয়ে যেতে কি আনন্দ তখন। অর্কও তখন ক্যামেরা নিয়ে এসে গেছে এদিকটায়। ছবি তুলতে তুলতে রোদ কমে এল। আস্তে আস্তে ঠান্ডা আরও বাড়ছে, সন্ধে নামছে প্যানগঙের জলে। ঝির ঝির করে আবার একটু বৃষ্টি নামল। আমরা হাওয়ার ঠেলা সামলে গুটিগুটি উঠে এলাম তাঁবুর কাছে। কেয়ারটেকার একটি ছেলে ডেকে নিয়ে গেল চায়ের জন্য। টেন্টগুলো ছাড়িয়ে একটা কমন বসার জায়গা কাম ডাইনিং রুম আছে, ওখানেই খেতে যেতে হয়। ওই প্রচন্ড ঠান্ডায় ধোঁয়া ওঠা চা-ও ঢক ঢক করে খেয়ে নিতে পারি মনে হচ্ছে। চা খেয়ে আমরা একটা রুমে সবাই জড়ো হলাম। এখানে খাওয়া-দাওয়া সারতে হবে 8 টার মধ্যে। আমরা তাই গল্পের ফাঁকে ঠিক করলাম ঠান্ডা এড়াতে একবারে খেয়েদেয়েই বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর আশ্রয় নেওয়া হবে।
খেতে গিয়ে দেখি এই প্রতন্ত্য অঞ্চলেও দারুন আয়োজন। আমিষ নেই কিন্তু ভাত, রুটি, ডাল, তরকারি, ভাজি, এমনকি ডেজার্ট-এ সীমাইয়ের পায়েসও আছে। আমাদের আশাও ছিল না এতকিছু পাবো, মহানন্দে পেটপুজো সেরে নিলাম আমরা। খেয়ে বেরিয়ে টেন্ট অবধি হেঁটে যেতে কেঁপে গেলাম। এত ঠান্ডা হাওয়া জমে যাব মনে হচ্ছে। ঘরে এসে গানের আসর বসল। মৌসুমী দি’র গলায় ওই নিবিড় অন্ধকারে সবকিছুই যেন আরো শান্ত হয়ে গেল। গানে গল্পে ওই ঠান্ডাতেও জীবনের সার্থকতা খুঁজে পেলাম যেন সবাই। প্রথম একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া এই ছ’টা মানুষ একে অপরের খুব কাছের মানুষ হয়ে গেল যেন এই নির্জনতায়।
রাত 11 টার পর এখানে আলো থাকে না। আবার সন্ধে নামলে আলো জ্বলে ওঠে। আড্ডা দিতে দিতে প্রায় পৌনে 11 টা, আলোটা নিভে গেল। আমরা গুটি গুটি যে যার তাঁবুতে ঢুকে যাওয়ার তোড়জোড় করছি আবার আলো জ্বলে উঠল। আরও কিছুক্ষণ থেকে আমরা টেন্ট এ চলে এলাম। অর্কর মাথা ধরছিল। ঠান্ডার চোটে আমরা যা পরেছিলাম সব সমেতই লেপের ভেতর ঢুকে পড়লাম। এত ঠান্ডা পায়ে মোজা, মাথায় টুপি কিছুতেই বাধ মানছে না। ঘুটঘুটে অন্ধকার তাঁবুতে ঘুমের চেষ্টা করছি। মাঝে মাঝেই ঘুম ভাঙছে, বাইরে ঝুপ ঝুপ শব্দ হয়েই চলেছে। হয়তো বৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু বেরিয়ে দেখার দুঃসাহস নেই। অর্ক মাঝরাতে উঠে হনুমান টুপি মাথায় গলিয়ে নিয়েছে। অনবরত অদ্ভুত শব্দের চোটে ঘুম বাবাজি পালিয়েছে। চেয়ে চেয়ে দেখছি তাঁবুর প্রিন্টেড কাপড়ের ছাদ, দেওয়াল।
3 সেপ্টেম্বর, 2017
ভোরের দিকে একটু চোখ লেগেছিল, উঠলাম যখন মোবাইলে 7 টা। অর্ক গভীর ঘুমে। আমি তাঁবুর চেন খুলে বাইরে বেরোলাম। বেরিয়ে যা দেখলাম তা আমার লাদাখ ভ্রমণের সেরা বিস্ময়। আকাশটা ঘন নীল, তাঁবুর কাছাকাছি পাহাড়গুলো দুধ সাদা। কাল রাতেই এরা ধূসর ছিল, রাতভর বৃষ্টির কারণ এবার বুঝলাম, ওপরে বরফ পড়েছে। সাদা পাহাড়ের উপর সকালের আলো চিক চিক করছে। এক রাত্তিরে চারপাশের ভোল পাল্টে গেছে। মহানন্দে অর্ককে একবার ডাক দিয়ে নেমে গেলাম লেকের কাছে। এদিকেও পাহাড়গুলোর মাথা সাদা হয়ে আছে, জল আকাশের মতোই ঘন নীল, সাদা মেঘ সেখানে ছায়া ফেলেছে। হাওয়ায় লেকের জলের ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাড়ে। দু-একটা পাখি সাঁতার কাটছে। ছলাৎ ছলাৎ শব্দ সুরের মতো লাগছে। মনে হচ্ছে এখান থেকে আর কোথাও যাব না। পারে হাঁটু গেড়ে বসে কনকনে ঠান্ডা জলে হাত দিয়ে তখন দারুন মজা। ঝলমলে আলোয় পতপত করে উড়তে থাকা রঙিন পতাকা, সারি সারি টেন্ট, বরফে ঢাকা পাহাড় লেকের পাড় থেকে দারুন দেখাচ্ছে। এই লাদখটাই তো স্বপ্নে দেখা ছিল, বাস্তব আর স্বপ্ন তখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। রাতে ঘুম না হওয়ার ক্লান্তি উবে যাচ্ছে সকালের স্নিগ্ধতায়।
খিদে ছিল না তেমন। ঠান্ডা আমাদের সকলকেই কাবু করেছে নানা ভাবে। ডাইনিং এরিয়ায় গিয়ে পুরী সবজি খেয়ে নিলাম। এখানে এসে আমরা সুইকেস খুলিই নি, তাই গোছানোর ঝামেলা নেই। কিন্তু বেরোতে তো হবেই। বরফ পড়েছে ওপরে তাই রাস্তার পরিস্থিতি জানা নেই।
গাড়িতে উঠে পড়ার আগে আরও একবার চলে গেলাম প্যানগঙের পাড়ে। মন খারাপ লাগছে তখন ভীষণ। যতটা পারি যে দৃশ্য রেকর্ড করে রাখতে হবে মাথার ভিতর। আবার কবে যে আসতে পারব জানা নেই। সকলের ডাকাডাকিতে গাড়িতে উঠে পড়লাম। গতকাল যে ভিউপয়েন্ট-এ বৃষ্টির জন্য ঘুরে দেখা হয়নি সেখানে এসে গাড়ি দাঁড়াল। টপাটপ নেমে পড়লাম আমরা। সাধারণত যারা প্যানগঙে থাকে না, তারা এখান থেকে দেখেই ফিরে যায়। এখানে দারুন একটা কার্ভ আছে, হেঁটে চলে গিয়ে লেকটা দেখতে অপূর্ব লাগে, ছবি তোলার জন্য আদর্শ। ওখানটায় দাঁড়িয়ে আরও খানিকক্ষণ প্রানভরে দেখে নিলাম। ছবি তুলে গাড়িতে উঠলাম আবার। যত এগোতে লাগলাম ঘন নীল জল সরু হতে হতে রেখার মতো মিলিয়ে গেল।
এবার পাহাড়ি খাড়াই পথে ওঠার পালা। লে ফিরছি। আমরা চাঙ লা পাস হয়ে ফিরব। এটি লাদাখ-এর আরও একটি উচ্চতম পাস। লে শহরটার মধ্যে একটা হোমলি ব্যাপার আছে। আবার হিমালায়ন রেসিডেন্সিতে গিয়ে ঢুকব, ও জায়গাটা নিজের বাড়ির মতো লাগছে তখন। একটু আঁকাবাঁকা পথ উঠেই আবার ঝিরঝিরে বৃষ্টি। আর একটা বাঁক ঘুরেই দেখি চারপাশ বরফে ঢাকা। রাতে বরফ পড়ে সব সাদা হয়ে গেছে। সামনে মিলিটারি গাড়ি চলেছে। আমরা যাচ্ছি সাদা পথ দেখতে দেখতে। বেরোবার জন্য মন ছটফট করছে। আর একটু পরই শুরু হল আবার বরফ পড়া। তখন রাস্তায় দুদিকে ঠাসা বরফ। সামনের গাড়ি এগিয়ে গেছে অনেক। আশপাশ ফাঁকা দেখে আমরা নেমে পড়লাম। সে এক অন্যরকম আনন্দ। না দেখলে অনুভব করা যাবে না। ঝুরঝুরে বরফ গায়ে পরে জল হয়ে যাচ্ছে, মাথা ভিজে যাচ্ছে। আমাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। হাতে স্বর্গ পাওয়ার উচ্ছাস তখন। তবে বেশিক্ষণ এখানে পাগলামি করা যাবে না, ফুনগসুকের তাড়ায় তাই উঠে পড়লাম আবার। বরফের ওপর দিয়ে সাইকেল আরোহীর চলে যাওয়া, বাইক রাইডারদের দেখে রোমাঞ্চিত হলাম। বরফ পেরোতে পেরোতে পৌঁছে গেলাম চাঙ লা পাস। সেখানে প্রচুর বরফ। রাস্তায় পাশে, চালের ওপর পুরু বরফ। বাইকের চাকা আটকে যাচ্ছে বা স্লিপ করছে। এ সময় সাধারণত এতটা বরফ পড়ে না, তাই বিপাকে পড়েছেন অনেক বাইক আরোহীই। চাঙ লা পাস-এ নামার পরও বরফ পড়ছে। মোটা মোটা নানা আকারের বরফের দানা ঝরে পড়ছে আকাশ থেকে। আমাদের ড্রাইভারের এই ঠান্ডাতেও শীত করছে না। আমরা একটু হেঁটে বরফ ঘাঁটাঘাঁটি করে আবার যাত্রা শুরু করলাম। আঁকা-বাঁকা পথে বেশ অনেকক্ষণ বরফ পড়া দেখতে দেখতে গাড়ি চলছে। আমরা ভাবছি এই ট্রিপ টায় আমাদের পাহাড়, নদী, মরুভূমি দেখার পাশাপাশি রোদ, বৃষ্টি, বরফ দেখার অভিজ্ঞতাও হয়ে গেল। আসতে আসতে বরফ কমে যেতে লাগল। এবার আবার দূরে দেখা যাচ্ছে বরফ। আমরা সবুজ দেখতে পেলাম আবার। পাহাড়ের গায়ে আঁকা-বাঁকা রাস্তা, রঙিন পাহাড় আবার দেখা দিল। এই প্রথম কাছ থেকে এতো বরফ দেখে মনে হল সারাক্ষণ বরফ দেখে যেতে হয় যাদের তাদের আসলে আনন্দ হয় না, এমন সাদা হয়ে যাওয়া চারপাশ অল্প সময়ের জন্যই সুন্দর।
নেমে এসে দেখলাম আর বৃষ্টি নেই। দুপুরের আকাশে মেঘের খেলা চলছে। এদিকটায় সবুজ আছে। দূরে দেখা যাচ্ছে হেমিস ন্যাশনাল পার্ক, এখানে আমরা কাল আসব। আরও খানিকটা চলার পর একটা ভারী সুন্দর রাস্তায় ঢুকলাম। দুদিকে ঝাউ গাছের মতো গাছ, মাঝখান দিয়ে আলো ছায়ার রাস্তা চলে গেছে। খুব ভাল দেখাচ্ছে চারপাশটা। আমাদের তখন খিদে পেয়েছে ভীষণ। রেস্টুরেন্টে খেয়েই ফিরতে হবে যা সময় হয়েছে। আমরা ফুনগসুক ভাইয়ের ওপরই দায়িত্ব দিলাম রেস্টুরেন্ট খোঁজার। সে আমাদের নিয়ে গেল থিকসে-র ক্যাফে ক্লাউড-এ। বেত-কাঠের চেয়ার টেবিল, বাহারি ফুল গাছে সাজানো ওপেন-এয়ার ক্যাফে, বেশ ঝাঁ চকচকে। ফ্রি ওয়াই-ফাই এবং অর্ডার নেওয়ার পদ্ধতি ট্যাবলেট-এ। পশ জায়গায় খাবার-দাবারও পশ। কন্টিনেন্টাল ক্যাফে বলে কথা! বেকড ফিশ, গ্রিল্ড চিকেন, থাই কারি এসব দিয়ে এতদিন পর মন ভরে অন্যরকম খাবার খেলাম। বিলও দিলাম আকাশছোঁয়া। কিন্তু তখন আমরা দিলদরিয়া। বুকের মধ্যে সব পেয়েছি নিয়ে ঘুরছি।
খেয়ে-দেয়ে থিকসে মনেস্ট্রি-কে পাশে রেখে ছুটে চলল গাড়ি। আজই দেখে নেওয়া যেত কিন্তু কালকের দিনটা আছে হাতে তাই আর নামা হল না। সুন্দর রাস্তা দেখতে দেখতে আমরা ফিরে চললাম হোটেল-এ। হিমালায়ন রেসিডেন্সিতে এবার জায়গা হল নিচের তলায়। এ ঘরগুলোর সঙ্গে লাগোয়া বারান্দা আছে। বারান্দা থেকে সেই পাহাড়, আলো ছায়া দেখে চোখ জুড়োল। আমার সবাই স্নান সেরে আড্ডায় বসব ভেবেছিলাম কিন্তু ঘুমে চোখ জুড়ে এল। একচোট ঘুমের পর চায়ের সঙ্গে আড্ডা জমল। নানান গল্প, ছবি দেখা, ডাম চ্যারাত খেলায় রাত নেমে এল। ডিনার টেবিলে বসেও চলল স্মৃতিচারণ। যা দেখেছি তা তো ভোলার না। থেকে থেকেই ফিরে আসতে লাগল নীল জলে ঢেউ, বরফ ঢাকা পাহাড় চুড়ো, কাঁপুনি দেওয়া রাত, বরফে ভিজে যাওয়া সকাল…।
ক্রমশ….
আরো কিছু লেখা:
লাদাখ ভ্রমণের প্রথমাংশ জানার জন্য click করুন এখানে।
লাদাখ ভ্রমণের দ্বিতীয়াংশ জানার জন্য click করুন এখানে।
লাদাখ ভ্রমণের তৃতীয়াংশ জানার জন্য click করুন এখানে।
লাদাখ ভ্রমণের চতুর্থাংশ জানার জন্য click করুন এখানে।
লাদাখ ভ্রমণের পঞ্চমাংশ জানার জন্য click করুন এখানে।
Follow me on Facebook & Instagram.