২০১৮-এর শেষ সপ্তাহটা বেড়ানোর জন্য রাখা ছিল সেই কবে থেকে। নানান প্ল্যান, ক্যান্সলেশন, ভুল সিদ্ধান্ত, সব ঠিক হয়ে যাবে-র স্বান্তনা পেরিয়ে অবশেষে দুজনে মিলে জম্পেশ একটা প্ল্যান করেছিলাম। সেই প্ল্যানেরই অন্যতম পার্ট দার্জিলিং থেকে রেন্ট-এ বাইক নিয়ে Auks Farm, সেখানে চাঁদের আলো মাখা রোম্যান্টিসিজম, পাহাড়ের কোলে ঘুম ভাঙা সূর্যের লাল, আর মন ভালো করে দেওয়া রাস্তা ধরে ‘পথ যদি না শেষ হয়’, যাকে বলে শীতের ছুটি জমজমাটি।
হানিমুন-এর পর এই প্রথম আবার শুধু দুজনে বেরিয়ে পড়া। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং গিয়ে পৌঁছেছিলাম 23 ডিসেম্বর সকালে। উঠতে উঠতে কার্শিয়াং থেকেই দেখা ঝকঝকে নীল আকাশে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ দেখে উত্তেজনা তখন টগবগ। দার্জিলিং স্টেশন থেকে স্লিপিং বুদ্ধার দেখা পেয়ে প্রাণে খুশির তুফান। সে দিনটা ম্যালে হেঁটে, পাহাড় দেখে, জমিয়ে খেয়ে, Joey’s -এ বসে কাটিয়ে দিয়েছিলাম পালিয়ে যাওয়ার প্রিয় জায়গায়। বাইক যেখান থেকে রেন্ট নেওয়ার সেখানে আগে থেকেই এডভান্স করে কথা বলা ছিল। পরদিন সকাল সকাল যাতে বেরোতে পারি পেপারওয়ার্কস সেরে নিতে সন্ধের দিকে হাজির হয়েছিলাম Adventures unlimited-এর অফিসে। ম্যাল থেকে আস্তাবলের রাস্তার দিকে গিয়ে সোজা খাঁড়াই রাস্তায় উঠে খানিকটা হাঁটার পর ছোট্ট রেস্টুরেন্ট সোনাম কিচেন, তার পাশেই অফিস। সেখানে গিয়েই আলাপ হল হাসিখুশি অমিত-এর সঙ্গে। মালিক বাইরে থাকায় এখন দায়িত্বে সে-ই। অমিত আমাদের নিয়ে গেল আরও খানিক এগিয়ে গ্যাটিস ক্যাফে-তে। একেবারে মোটর সাইকেল, মিউজিক আর এডভেঞ্চার লাভারদের কথা মাথায় রেখে ক্যাফের ডেকর। বাইরের দিকের জানলা খুলে দিলে সবুজ ভ্যালি, জানলা ঠেলে দেখলাম রাত নামা দার্জিলিংয়ের মাথায় পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। এই ক্যাফেটাও এদেরই। এখানেই বাইকগুলো থাকে। নতুন মডেল-এর হিমালায়নকে দেখে আমাদের দুজনেরই বেজায় আনন্দ। এই বাইকটা আমার খুব পছন্দের, লাদাখেও চড়েছি। কথাবার্তা বলে পরদিন দশটা নাগাদ বেরনোর কথা ঠিক করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম গ্যটিস থেকে। কুক ছুটিতে থাকায় সেখানে ইচ্ছে থাকলেও খাবার জুটল না। হোটেলেই রাতের খাবার সেরে নিলাম।
পরদিন সকালে বাঙালির টাইম মতো আমাদের দশটাও এগারোটা হল। আর পাহাড়িরা এমনিই লেড ব্যাক। ব্রেকফাস্ট সেরে সব বুঝে নিতে আরও খানিক সময় গেল। আমাদের সঙ্গের সুটকেস জমা রইল Adventure unlimited-এর দপ্তরে। আমরা রুকস্যাকটা হিমালায়ন-এর সঙ্গে কষে বেঁধে চড়ে বসলাম। তারপর এই চড়াই তো এই উৎরাই। একটু একটু ভয় আর কনকনে ঠান্ডা হওয়া সম্বল করে চলতে লাগলাম পিলিয়ন হয়ে। বাইকে বসে 360 ভিউটা আমার সবচেয়ে প্রিয়। সামনে রাস্তা, পিছনে পাহাড়, ডানপাশে গ্রিন ভ্যালি কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখব ভাবতে ভাবতেই অনেকটা পথ পেরিয়ে যাওয়া যায়। পিছনে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে রেখে আমরা জোড়বাংলো পৌঁছে তাকদা-র দিকে যাওয়ার রাস্তা ধরলাম। এ রাস্তায় কিছু কিছু জায়গা খুব মসৃণ হলেও, কোথাও কোথাও অল্পস্বল্প গর্ত, পিচ্ছিল জকয়গা আছে। তবে রাস্তায় যেতে যেতে দৃশ্য ভারি সুন্দর, একদিকে ভ্যালি, একদিকে সবুজ পাহাড় আবার কখনও দুদিকেই সারি সারি পাইন। অর্ক তখন পাহাড়ি রাস্তায় ছুটে চলার আনন্দে টগবগ করছে, হাতে বেঁধে নিয়েছে go pro. আর আমি মন ভরে আকাশ দেখছি, জঙ্গল দেখছি। এভাবে চলতে চলতে একে একে পার হলাম 3 মাইল, 6 মাইল। তারপর ঢুকে পড়লাম তাকদার জঙ্গলে। জঙ্গলের ভিতর কোথাও কোথাও এতই বেশি গাছ যে দিনের বেলাও সন্ধে নেমেছে মনে হচ্ছে। পাইনের সারি দেখতে দেখতে খানিক্ষণ চলার পর তাকদা ফরেস্ট বাংলো পেরিয়ে অর্কিড স্যানচুয়ারি পৌঁছে গেলাম। পরদিন দেখতে আসার প্ল্যান ছিলই তাই তখন আর নামলাম না। গাছপালা ঘেরা তাকদা মন ভরাবেই। বেশ কিছু হোম স্টে, গেস্ট হাউজ আছে এখানে। তাকদা পেরিয়ে ঢুকে পড়লাম তিনচুলে-র রাস্তায়। এখানেও জঙ্গল আছে, তবে অতো ঘন না। তিনচুলের রাস্তা বেশ খারাপ। এখানে ওখানে বোল্ডার, কোথাও পাকা রাস্তা তৈরি হচ্ছে। সাবধানে ছুটে চলল আমাদের বাইক। তাকদা, তিনচুলে এখন বাঙালিদের মধ্যে একটু নিরিবিলিতে সময় কাটানোর মতো জনপ্রিয় আস্তানা। রাস্তায় দেখা পেলাম বাঙালি ট্যুরিস্টদের। আঁকা-বাঁকা পথে চলতে চলতে মাঝে মাঝে ঠিক যাচ্ছি কিনা বোঝার জন্য রাস্তায় থাকা পুলিশ বা সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞেস করে নিচ্ছিলাম সোরেঙ-এর রাস্তা। এ ছাড়াও অমিত আমাদের ম্যাপ এঁকে দিয়েছিল। গুগল ম্যাপও খোলা ছিল। তবে তাকদার জঙ্গলে ভোডাফোনের নেটওয়ার্ক ছিল না একেবারেই। তিনচুলে থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউ পেয়ে আমরা একটু দাঁড়িয়েছিলাম। সবুজ পাহাড়ের পাশ দিয়ে তখন দেখা যাচ্ছে ঝকঝকে কাঞ্চনকে। মেঘের দল চড়ে বেড়াচ্ছে নীল আকাশে। দূরের পাহাড়ে ছোট ছোট বাড়ি ছবির মতোন। সেসব দেখে আবার চলতে শুরু করেছিলাম।
তিনচুলে থেকে একটা রাস্তা নীচে নেমে গেছে সোরেঙ-এর দিকে। সে রাস্তা ধরে চারপাশ দেখতে দেখতে পৌঁছে গিয়েছিলাম Auks Farm-এর রাস্তায়। মালকিন সুস্মিতাকে ফোন করে বুঝে নিয়েছিলাম সামনের মাটি কাটা রাস্তা ধরে নীচে নেমে গেলেই পৌঁছে যাব। রাস্তা তৈরি হচ্ছে বলে বাজে ভাবে মাটি কাটা, তাই আমি পিছন থেকে নেমে পড়লাম। অর্ক বাইক চালিয়ে নেমে গেল নীচে। Auks Farm-এ ঢুকতেই সুস্মিতা এগিয়ে এসে ওয়েলকাম জানাল। ভিতরে ঢুকেই মন খুশি। ছোটবেলার গ্রিটিং কার্ড দেখে যে বাড়িটায় খুব যেতে ইচ্ছে করতো, সেটাই যেন সত্যি হয়ে চোখের সামনে এসে গেছে। পাহাড়ের গা ঘেঁষে লাল চালের সাদা বাড়ি, সামনে ঘাসের লন, রঙিন ফুল, সবুজ ব্যাকগ্রাউন্ডে নীল রঙা বসার জায়গা, পাথরের টেবিল, সামনে চোখজুড়ানো ভ্যালি। তখন মনে মনে প্রজাপতি হয়ে যাবার সময়। সুস্মিতাকে যে রুম-টা থাকার কথা বলে রেখেছিলাম সেটি সবে খালি হওয়ায় তখনও পরিষ্কার হয়নি। পাশের রুমটা আমাদের জন্য রেডি থাকায় সেটাতেই চেক ইন করলাম। তুলির টানে বানানো বাড়ি, পাশাপাশি দুটো ঘর, লাফিং আউল আর প্যারাডাইস প্যারট। রুমে ঢুকে বিছানা-বাথরুম দেখে আমি তখন বেশ নিশ্চিন্ত। একদম নিট এন্ড ক্লিন, সমস্ত মর্ডান জিনিসই আছে। রুমের বাইরে বাঁ পাশে ফুলের গাছ, অর্কিড। এদিকেই দু-পা নেমে গিয়ে বেত আর কাঠের ডাইনিং এরিয়া। এখানে খাওয়াদাওয়ার পাশাপাশি বসে বই পড়ার জন্য বুক সেল্ফ-এ মজুত আছে অনেক বই। আছে লুডো, চাইনিজ চেকার। দল বেঁধে গেলে সন্ধে নামার পর এক-দু রাউন্ড খেলতে মন্দ লাগবে না। তার পাশে কটেজ ডোডো, এখানে 4 জন থাকা যায়। আর একটু এগিয়ে গেলে আর একটা কটেজ, মোহো। এই ফার্ম-এ ক্রিসমাসের পরে পটারি ক্যাম্প-এর আয়োজন, সে সবেরই তোড়জোড় চলছে এই কটেজগুলো ফাঁকা থাকায়। গেস্ট আমরা দুজনই। তাই আমাদেরই রাজত্ব। এখানে আর একটা সুবিধে কনসেপ্ট হোম স্টে হলেও, ওনার-রা একই বাড়িতে থাকেন না। তাই প্রাইভেসিটা আছে।
আগে থেকেই সুস্মিতা জেনে নিয়েছিল আমরা লাঞ্চ করব কিনা। যতক্ষণে লাঞ্চ এল আমরা ঘুরে বেড়ালাম সামনের বসার জায়গা, বাঁধানো ছোট্ট পুকুরে মাছ, ফুলের গাছ, ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া চাষের জায়গায়। সামনের ভিউটার দিকে তাকিয়েই এখানে বসে কয়েক ঘণ্টা দিব্যি কেটে যেতে পারে। লাঞ্চ রেডি শুনে আমরা হাজির হয়ে গেলাম তৎক্ষণাৎ। টেবিলে ছোট বড় ক্যাসরোলে সাজানো খাবার। ভাত, ডাল, মিক্সড ভেজ, ফুলকপির তরকারি, আলুর দম, বিশেষ একটি পাতা দিয়ে বানানো নেপালি পর্ক কারী, চাটনি। সব খাবারই সুস্মিতার মায়ের হাতের রান্না, সব্জি এমনকি পর্কও চাষের। অন্যান্য খাবার সাধারণ ঘরোয়া হলেও এমন ভালো পর্ক কারী আগে সত্যিই খাইনি বলতেই পারি। পেটপুরে খেয়ে রুমে গেলাম।
এক দাদার কাছে শুনেছিলাম এখানে কাছেই অরেঞ্জ ভিলা বলে একটা গেস্ট হাউজ আছে। সেখানে গেলে গাছে ঝুলে থাকা সারি সারি কমলালেবু দেখতে পাওয়া যাবে। সন্ধে নামতে দেরি আছে দেখে আর ল্যাদ না খেয়ে আমরা সুস্মিতার থেকে রাস্তা বুঝে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। মেইন রাস্তায় উঠে নিচের দিকে 2-3 কিমি নেমে গেলেই অরেঞ্জ ভিলা। এখানে না থাকলেও আলাদা টিকিট কেটে কমলালেবুর বাগান ঘুরে দেখা যায়। মাথাপিছু 30 টাকার টিকিট কেটে আমরা কেয়ারটেকার-এর সঙ্গে ঢুকে পড়লাম বাগানে। দুদিকে যতদূর চোখ যায় গাছে ঝুলে আছে নানান মাপের কমলা। কোথাও গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি দেওয়া সবুজ ভ্যালি। কোনও গাছের নুইয়ে পড়া ডাল মাথা ছুঁয়ে যাচ্ছে। হাত দিয়ে ধরে দেখছি গাছে ঝোলা টাটকা লেবু। হাতের কাছে এত কমলালেবু-এর আগে দেখা হয়নি। নেপালি কেয়ারটেকার লেবুর পাশাপাশি এলাচ, ধনেপাতা, পাহাড়ি ফুলের গাছ চেনাচ্ছে। নানান কথার ফাঁকে সে নিচু হয়ে বসে একটা গাছ থেকে 4 টে কমলালেবু পেরে আমার হাতে দিয়ে বলল রেখে দিতে। আমি আনন্দে ডগমগ হয়ে টপাটপ জ্যাকেটের পকেটে পুরে ফেল্লাম। এখান থেকে বেরিয়ে পাশে নীচে রাস্তা চলে গেছে, সেখানেই নির্মল জ্যাম, কোয়াশ-এর ফ্যাক্টরি। আমরা সেটাও ঘুরে এসে ওদের স্টোর থেকে জ্যাম, মারমালেড নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। একই রাস্তা ধরে আরও একটু নিচের দিকে নেমে পাহাড়ের গায়ে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামা দেখলাম। তারপর ফিরে এলাম ফার্ম-এ।
ফিরে আসতেই নেপালি কেয়ারটেকার আগুন পোহানোর ব্যবস্থা করার তোড়জোড় শুরু করল। ঘরের বাইরে, ডাইনিং-এর পাশে ফায়ার প্লেসের মতো জায়গা করা আছে। বসে আগুনের ওমে মদ সহযোগে আড্ডা ভালোই জমে। এইরকম জাগায় এসে বন্ধুদের মনে পড়ে যায় খুব। শুধু দুজনে এই শীতে আড্ডা জমে কি! কিন্তু আমাদের সেই অভাব অনেকটাই মিটিয়ে দিল সুস্মিতা, ওর হাজব্যান্ড কল্যাণ ওরফে কে কে আর সুস্মিতার ভাই। নানান গল্পে রাত নামতে লাগল। হঠাৎ দেখলাম পাহাড়ের ঢাল বেয়ে চাঁদ উঠেছে। আগুন, অন্ধকার, নীল আকাশ, ঝলমলে চাঁদ- সময় এখানে থেমে গেলে যেন বেশ হতো। এমন মায়াবি রাত আমার জীবনে আগে এসেছে কিনা মনেই করতে পারলাম না। ওই মায়ায়, নেশায় ডুবে যেতে যেতে ডিনার টাইম হয়ে গেল। রাতের ডিনারে ছিল চাপাটি, ভাত, ডাল, সবজি, নেপালি কায়দায় চিকেন। সঙ্গে সুস্মিতা হেজেলনাট চকলেটও খাওয়ালো। দার্জিলিংয়ের চেয়ে ঠান্ডাটাও কম হওয়ায় লেপের আদরে ঘুম হয়েছিল দারুন।
পরদিন উঠেছিলাম বেলা করেই। যদিও এইদিন আমাদের কাছেপিঠের জায়গাগুলো ঘুরে দেখার প্ল্যান কিন্তু বড়দিনে বেলা বড় এই অজুহাতে ল্যাদ জাপটে ছিলাম বেশ খানিক্ষণ। উঠে বাইরেটা বসে কফির চুমুকে সকাল দেখতে বেশ লাগছিল। দূরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গল্প করছিলাম দুজনে। সেসব সেরে তৈরি হতে আরও খানিক সময় গেল। সুস্মিতার সঙ্গে দেখা হতেই ও বলে দিল আমাদের আমার বুক করা রুমটায় শিফট করে দিচ্ছে। পরদিন এমনিও আমাদের ভোর ভোর উঠে বেরোনো, তাই ওই রুম থেকে ভালো সানরাইজ দেখা যাবে ভেবেই খুশি হয়ে গেলাম। ব্রেকফাস্ট কমপ্লিমেন্টারি ছিল কিন্তু আমরা সেই টাইম তো ছাড়িয়েই গেছি। সাড়ে 11 টা নাগাদ তাই ব্রেকফাস্টের নামে পেয়ে গেলাম ফ্রায়েড রাইস আর দারুণ ড্রাই ফ্রায়েড চিলি পর্ক, সঙ্গে কফি। এই পর্কটা খেয়ে মনে হয়েছিল, আরও কিছুদিন থেকে গেলেই তো হয়। খাওয়া-দাওয়া সেরে বেরোতে বেরোতে ঘড়ি 12 টা ছুঁয়েছে। প্রথমেই তিনচুলের রাস্তা ধরে উঠে এলাম। তাকদা অর্কিড স্যানচুয়ারি দেখার জন্য বাইক চলল সেই পাইনের জঙ্গল দিয়ে। অর্কিড স্যানচুয়ারিটা খুব ইম্প্রেসিভ লাগল না। ওই যেমন নার্সারি হয় তেমন। খুব ভালো করে মেইনটেইন হয় বলেও মনে হল না।
এখান থেকে বেরিয়ে চললাম তিস্তা বাজারের রাস্তার দিকে। রংলি-রাঙ্গলিওট টি গার্ডেন-এর মধ্যে দিয়ে রাস্তা নেমে গেছে তিস্তা বাজারে। এখানে ম্যাপ একেবারে কাজ করছে না। তাই স্থানীয় লোকজনের কাছে রাস্তা বুঝে নিয়ে এগিয়ে চললাম। চা বাগানের ভিতর দিয়ে বাইকে এই প্রথম। চারপাশে তখন দারুন দৃশ্য। ঝকঝকে আকাশ, সবুজ পাহাড় আর চা-বাগানে ঢাকা ভ্যালি। আর আঁকা-বাঁকা রাস্তা ধরে আমাদের বাইক নেমে চলেছে অচেনায়। অনেকটা নামার পর হঠাৎই মনে হল, সবে তো দুপুর, তিস্তা বাজার নেমে গেলে তো বড় মাঙ্গওয়া হয়ে সোরেঙ-ই চলে যেতে হবে, তার চেয়ে বরং 6 মাইল গিয়ে লামহাটা-টাও ঘুরে আসি। যেমন ভাবা তেমন কাজ। আবার চা-বাগানকে পাশে রেখে ঘুরতে ঘুরতে ওপরে ওঠা হল। তাকদা থেকে লামহাটা যাওয়ার আরও একটা শর্টকাট রাস্তা থাকলেও সেটা বাইক চালানোর পক্ষে খুব একটা উপযোগী না হওয়ায় আমরা 6 মাইলের দিকেই এগোলাম। সেখান থেকে সোজা চলে গেছে পেশক রোড ধরে লামহাটা যাওয়ার ঝকঝকে, সাজানো রাস্তা। এ রাস্তাটা খুব মেন্টেন্ড, দুদিকে বাঁধানো, খানা-খন্দের বালাই নেই। দুদিকে গাছের সারি, ছায়া ছায়া পথ। দারুন লাগছিল এখানে বাইকে ছুটে যেতে। আকাশ তখন একটু একটু মেঘলা করছে, নীল ভাবটা কমে গেছে। নর্থ বেঙ্গল-এর পাহাড়ে এ ঘটনা তো হামেশাই হয়। রোদ কমে আসায় জঙ্গলের মধ্যে ঠান্ডাও বেশি লাগছে। আমরা আধাঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম লামহাটা ইকো ট্যুরিজিম পার্ক-এ। এটা একটা সাজানো পার্ক, সামনে নানান রকম বসার জায়গা, ভিউ পয়েন্ট, পিছনে দাঁড়িয়ে সারি সারি পাইন। আমার সাজানো গোছানো জায়গা অতো ভালো লাগে না, তবে ভিউপয়েন্ট-এ গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার মুখ দেখে ভালোই লাগল। এরপর হেঁটে উঠে গেলাম পিছনের পাইনের জঙ্গলের দিকে। এখানে দাঁড়িয়ে মেঘের আড়াল থেকে সূর্যের আলো পড়া দেখতে বেশ লাগছিল। তবে লামহাটা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা সুন্দরভাবে দেখা যাওয়ার জন্যই ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে এ জায়গাটাকে গুরুত্ব দেওয়াটা খুবই প্রাসঙ্গিক। আমারা আরও কিছুক্ষণ ঘুরে, ছবি তুলে বেরিয়ে এলাম পার্ক থেকে। বাইরে অনেকগুলো গুমটি দোকান। কফি, চা, ম্যাগি, মোমো যেমনটা চাই পাওয়া যায়। এই রাস্তাটা তিস্তা বাজারের দিকেই গেছে। এখান থেকে 16 কিমি। ঘুরে ফেরার থেকে এদিক দিয়ে ফেরাই ভালো। একে দূরত্ব কম, দুয়ে দারুন রাস্তা। তাই বেশি না ভেবে পেশক রোড-ই ধরেছিলাম।
তারপর সে রাস্তা দিয়ে যত এগিয়েছি ভালো লাগা বেড়েছে। পাহাড়ি মসৃণ রাস্তায় কখনো দুপাশে সবুজের নানা সেড, কখনো মেঘের ফাঁকে একফালি বেরিয়ে থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা, কখনও চা-বাগান, কখনও আবার নীচে বয়ে চলা তিস্তা চোখে আরাম দিয়েছে। এই পথ যেন না শেষ হয়, মনে হয়েছে বার বার। তিস্তা বাজার আর পাঁচটা বাজারের মতোই, দোকানপাট, ভিড়। এখান থেকে খাঁড়াই উঠে গেছে বড় মাঙ্গওয়ার পথ। রাস্তা এতটাই খাঁড়াই যে পিলিয়ন নিয়ে চালাতে খানিক কষ্টই হবে চালকের। আমার চালকটি যে চোস্ত সে ব্যাপারে সন্দেহ তো বহু আগেই ছেড়েছি, তাই নিশ্চিন্তে চারপাশ দেখতে দেখতে চললাম। তাকদা, তিনচুলের মতো এ পথেও বেশ কিছু হোম স্টে, গেস্ট হাউজ আছে। দু-একটা থিম বেসডও দেখলাম। এ রাস্তায় ধাপে ধাপে পাহাড়ি চাষ জমি চোখে পড়বে। তখন বিকেল ফুরোচ্ছে আস্তে আস্তে। পাহারগুলোয় নীলচে আভা। একটা বাঁক থেকে দূরে ঝাপসা কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা দিল। তখন রং লালচে। এইসব রং বদলানো দেখতে দেখতে আমরা ফিরে গেলাম Auks Farm. প্রকৃতির আলো তখন একেবারে কমে গেছে। দূরের ভ্যালিতে আলো জ্বলে উঠছে একে একে। আমরাও ফ্রেশ হয়ে নিয়ে রাতের আড্ডার জন্য তৈরি হয়ে নিলাম।
সুস্মিতার ভাই বনফায়ার রেডি করে ফেলল ঝটপট। তারপর শুরু হল বারবিকিউ। আমরা সকাল থেকেই এই আড্ডাটা প্ল্যান করে রেখেছিলাম। টেবিলে পাঁপড় ভাজা, বাদামও এসে গেল। আর এগুলোর একপ্যানিমেন্টটা তো সঙ্গেই ছিল। জমে গেল বড়দিনের রাত। পলিটিক্স, কালচার, দার্জিলিং, কলকাতা ঘুরে ফিরে বয়ে চলল কথা। সুস্মিতার থেকে জানলাম পাখির নাম ছাড়াও Auks শব্দটা ওর বাবা, মা, ও এবং ওর ভাইয়ের নামের প্রথম অক্ষরগুলো জুড়লেও তৈরি হয়, বাবার মৃত্যুর পরে এই বাড়িটা যেন ওদের জুড়ে রেখেছে। কথায় কথায় মেঘের ফাঁক থেকে চাঁদ মুখ দেখাল আবার। রাত বাড়ল। আন্টি অর্থাৎ সুস্মিতার মায়ের সঙ্গে এইদিন ফিরেই আলাপ হয়েছিল। ভারি সরল, সব মায়েরা যেমন হয় তেমনই। এটাই আমাদের এখানে শেষ রাত। এইদিন আন্টি দু’রকম পর্ক, রুটি, ডাল, ভাত, ব্রকলি বেলপেপার দিয়ে ভেজ স্যতে, লঙ্কার আচার, আরও একটা ভেজ তরকারি বানিয়েছিলেন। সুস্মিতা, কে কে, আমি আর অর্ক একসঙ্গেই ডাইনিং এরিয়া-তে ডিনার করলাম আড্ডা শেষে। মনে হল গেস্ট থেকে বন্ধু হয়ে গেছি খুব সহজেই। খাওয়া-দাওয়া সেরে সবাইকে টাটা করে নিলাম দুজনেই। পরের দিন সাতসকালে বেরিয়ে পড়া, তাই সকলের সঙ্গে দেখা হবার চান্স কম।
তাড়াতাড়ি বেরনোর থাকলে আমার বার বার ঘুম ভেঙে যায়। এই ঘরটার জানলা দিয়ে সূর্যোদয় দেখা যায়। আমি বার বার চোখ খুলে পর্দা সরাচ্ছিলাম। সাড়ে 6 টা নাগাদ পর্দার আড়ালে লাল আভা দেখা গেল। তারপর কমলা রঙের গোল থালা মেঘের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সে এক মন ভরানো দৃশ্য। দূরে পাহাড়, সামনে গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যের উঁকি, মেঘগুলোয় নানা রং ঠিকরে পড়ছে। চলে যেতে হবে ভেবেই মন ভার তখন। দেরি করলে মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফুর ল্যান্ড রোভার পাওয়া যাবে না। রেডি হয়ে নিলাম তাড়াতাড়ি। ব্যাগে মালপত্তর ভরাই ছিল। হিমালায়ন-এর পিছনে বেঁধে নিয়ে যখন তৈরি হলাম তখন সাড়ে সাতটা। সুস্মিতা আর ওর ভাইয়ের স্ত্রী এলেন আমাদের সি অফ করতে। এতো সকালে ব্রেকফাস্ট পাওয়া চাপ, কফি, বিস্কুট খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম দার্জিলিংয়ের পথে। পিছনে পরে রইল পাহাড়ি ফুল, সিমেন্ট বাঁধানো বাহারি পুকুরের গোল্ড ফিস, গাছের ফাঁক থেকে মাথা তুলে থাকা সবুজ পাহাড়, উঁচুতে উঁকি দেওয়া ছোট্ট মনাস্ট্রি, সবুজ ঘাসে শুয়ে থাকার আরাম আর ছবির মতো ছোট্ট বাড়ি টা। আর সান্দাকফুর গল্প, রইল তোলা, পরে শোনাব।
Auks Farm
ভাড়া- 3500/দিন (ব্রেকফাস্ট কমপ্লিমেন্টারি)
খাবার খরচ- 400/মিল (পছন্দের খাবার আগে থেকে জানিয়ে দেওয়া ভাল)
দার্জিলিং থেকে দূরত্ব-41.5 কিমি
শিলিগুড়ি থেকে দূরত্ব-61.2 কিমি
বাইক রেন্ট- Adventures Unlimited India (visit- adventuresunlimited.in)