ট্রেন নিয়ে ছোট থেকেই আমার খুব উৎসাহ। সেই যে বাবা-কাকু-ঠাম্মার কোলে চড়ে ট্রেনের চলে যাওয়া দেখে হাত নাড়তে যেতাম লাইন ধারে, সেই তখন থেকেই। রেললাইনের কাছাকাছি যাদের বাড়ি, তাদের সকলের বাড়ির লোকেরই ছোটদের বিকেল হলেই ট্রেন দেখাতে নিয়ে যাওয়াটা একটা বয়স অবধি ভুলিয়ে রাখার উপায় ছিল। শ্রীরামপুরে আমাদের বাড়ির কাছেই ছিল রেললাইন। আমারও বহু সন্ধে ওই ট্রেন দেখার মোহে কেটে গেছে। ওই যে চোখের সামনে দিয়ে ট্রেনের চলে যাওয়াটা ওটার সঙ্গে বায়নাক্কা চলে যাওয়া, মনখারাপ চলে যাওয়াগুলো জুড়ে গেছে সময় সময়ে।
আমাদের ঘরটার জানলা দিয়ে সোজা তাকালে সরু গলি, সেই গলি বরাবর চোখ চলে গেলে ট্রেন দেখা যেত। বয়ঃসন্ধির আবোল-তাবোল সেই দিকে তাকিয়েই। দূরপাল্লার ট্রেন আসার পূর্বাভাস পাওয়া যেত খাট কেঁপে ওঠায়। কতবার সেই কম্পনকে ভূমিকম্প ভেবে নিজেই কেঁপে উঠেছি। কত ছুটির দুপুর ট্রেন গুনে কেটেছে। আশেপাশে বাড়ি বেড়ে ওঠার সাথে সাথে ঘর থেকে ট্রেন দেখতে পাওয়ার পথটা সরু হয়ে গেছে আরও। গাছ-পালার আড়াল থেকে একটা ঝলকে এসে ঠেকেছে। তখন সন্ধে হলে ছাদে চলে গেছি কুঁ-ঝিকঝিক-এর টানে।
ট্রেন দেখতে যেমন ভালো লেগেছে ট্রেনে চাপতেও। ছোট থাকতে পিসির বাড়ি, মামার বাড়ি মানেই ট্রেন। চাকরি করতে গিয়ে ট্রেনে চড়ে অফিস যাওয়ার আগে অব্দি গ্যালোপিন ট্রেনে চড়তে একদম ভালো লাগেনি কোথাও দাঁড়ায় না বলে। তার চেয়ে বরং ৪০ মিনিটের পথে জানলার ধারে বসার আনন্দ, গাছ-বাড়ি-সবুজ মাঠের সরে সরে যাওয়া দেখা, কত ধরণের মানুষ, কত রকম ফেরিওয়ালা, কত তাদের জিনিসপত্র, সে সবে ছিল অমোঘ আকর্ষণ। আর ছিল ঝালমুড়ির নারকেল, সবুজ কড়াই ভাজা, ডালমুট, চুলের ক্লিপ আর মিঠুনের মায়ের টক-ঝাল-মিষ্টি লজেন্স। ছোট থেকে বড় হওয়ার রুটিনে ট্রেনের মিঠুনের মা-দের মতো কয়েকজন ভীষণ মনে থেকে যায়। মিঠুনের মা-কে প্রথম দেখেছি মামারবাড়ি যাওয়ার পথে, হাওড়া কর্ডলাইনে। আলাদা করে মনে রাখার কারণ ট্রেনে উঠেই হাত-পা নেড়ে ওর ছেলে মিঠুনের নানান গল্প করতো, ভীষণ মজার সে সব গল্প। ওর কথার ছলে বিভোর হয়ে সবাই দেখতাম কোনও না কোনও লজেন্স-এর প্যাকেট কিনে ফেলছে। গাল টিপে আদর করতো, মায়ের সঙ্গে জুড়ে দিত সংসারের গল্প। ছোটবেলায় ওর প্রতি আমার এমন টান ছিল মামারবাড়ি যাওয়ার সময় ট্রেনে মিঠুনের মা না উঠলে আমার সারাদিন মনখারাপ থাকতো। তারপর যদি ফেরার সময় দেখা পাই তখন আর আমায় পায় কে! একগাল হেসে অরেঞ্জ, আনারস, কাঁচাআম, আদা সব তখন আমার মুঠোবন্দি।
দূরপাল্লার ট্রেনে ছিল দ্বিগুণ মজা। সাইড বার্থ সবচেয়ে প্রিয়। নতুন নামের স্টেশন, নতুন মুখ, পাশ দিয়ে হুশ করে অন্য ট্রেনের ছুটে যাওয়া, গল্পের বই, দুলুনিতে পড়ে যাওয়ার ভয়ে না ঘুমিয়ে ঘাপটি মেরে থাকা সবই এক একটা মনে রাখার মতন অভিজ্ঞতা। সকাল হলে নিউজপেপার, ডিম্ সেদ্ধ, লেবু চা, দিলখুশ, আলুরদম কেনা-বেচার হৈচৈ দেখে এনার্জি পেতাম। বাড়ির সবাই মিলে কামরা জুড়ে পিকনিক বসে যেত তখন, টিফিন কৌটো থেকে বেরনো লুচি আলুরদম মিষ্টি বা লেবু চিঁড়ে ছিল অমৃত। স্লিপার ক্লাসে যাওয়ার দিনগুলোয় বাবা স্টেশনে জল ভরতে নামলে ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার পর বাবাকে যতক্ষণ না দেখতে পেতাম পেটের ভিতর গুড়গুড় করতো। আর সবসময় ট্রেন থেকে নামার সময় কিছু না কিছু হারিয়ে যাওয়ার ভয় তাড়া করতো। প্রথম একা একা যখন ট্রেন-এ চড়ে দূরে গেলাম হারিয়ে যাওয়া বা হারাবার ভয়গুলো হারিয়ে গেল আচমকাই।
চাকরি করার সময় যদিও ট্রেন নানান মানুষ ও হকার দেখার আনন্দকে ছাপিয়ে বন্ধুত্বের আনন্দ দিয়েছিল। অফিসের সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে ঠিক করা থাকতো ট্রেন, কথা হয়ে যেত ট্রেন প্লাটফর্মে ঢোকার আগেই। একসঙ্গে পড়ি কি মরি করে ওঠা, পুরো পথ গল্পের তুফান, সে উচ্ছাসই আলাদা। কোনও কোনও দিন অফিসের লেট মার্ককে উপেক্ষা করে বন্ধুত্বের অপেক্ষাও ছিল। ফেরার সময় আলাদা হলেও হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া উপরি পাওনা ছিল, তখন রোজ বলেও কথা ফুরোত না আমাদের।
এখন আর ট্রেনে চাপা হয় না তেমন। বেড়াতে গেলেও সময় বাঁচাতে প্লেনই ভরসা। আগে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে সবার আগে উঠে পড়া বা নেমে পড়ার যে দুঃসাহস ছিল, এখন তা ম্লান। লোকাল ট্রেনে উঠলেও ফোনের দিকে চোখ থাকে বেশি। অভ্যাস চলে যাওয়ায় ট্রেনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ছোট ছোট ভালোলাগাগুলো কমে এসেছে। কিন্তু কয়েক মাস আগে একদিন শ্রীরামপুর থেকে ফেরার সময় ট্রেনে মিঠুনের মায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, সেই গলা, সেই প্যাকেট ভর্তি ছোটবেলা। জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল কত ঝাপসা স্মৃতি, কত কথা। নিজের অজান্তেই চিক চিক করে উঠল চোখের কোণ। আমার আমিটার অনেকটা এই লোকাল ট্রেনে ফেলে গেছি সেইটা যেন বুঝতে পারলাম। বোকার মতো জিগেস করলাম, “তোমার মিঠুন কেমন আছে? ছোটবেলার মতোই আছে নাকি আমাদের মতো বড় হয়ে গেছে?” একগাল হেসে জবাব দিল, “তুইও তো ছোটই আছিস, কোথায় আর বড় হয়েছিস!”