বাঙালি মাত্রই খেতে ভালোবাসে। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। বরং আমাকে পরিবার ও বন্ধুমহলে ফুডি হয়েও রোগা থাকার জন্য অনেক জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হতে হয়। তা সেই ফুডি আমি এ রেস্তোরাঁ, সে রেস্তোরাঁয় খেয়ে বেড়াই এবং পরিচিত ফুড ব্লগার-দের ভালো খাবার জায়গার রিভিউ দিতে দেখলেই খুঁটি-নাটি প্রশ্ন করে হানা দি। কিন্তু আমার এই লেখাটা কোন রেস্তোরাঁর কোন খাবার ভালো বা খাওয়া উচিত তা নিয়ে একেবারেই না। বরং রেস্তোঁরা কী বুঝতে শেখার আগে আমার টেস্ট বাড-টা যে তৈরি করে দিয়েছে তাঁকে নিয়ে। মফস্সলের মেয়ে হওয়ায় এমনিতেই যুগের হাওয়া গায়ে লেট-এ লেগেছে। ওই পুজোর সময় একদিন শ্রীরামপুরের দু-চারটে রেস্তোরাঁর মধ্যে বাবা-মার সঙ্গে লাইন দিয়ে ঢুঁ মারা মানে স্বর্গ পাওয়া। তার ওপর আমাদের জেনারেশনের মায়েদের তো আবার ‛বাবা চার-পিস ময়দাগোলা চিকেনের দাম এতো!’ কিংবা ‛এর থেকে বাড়িতে রান্না করে খাওয়া ঢের ভালো’ তো আছেই। তখন সে সব শুনে রাগ হতো, এখন আফসোস হয়।
যখন ছোট ছিলাম, মানে খুব ছোট আর কি, মা আপেল সেদ্ধ খাওয়াতো। এতোই খারাপ ছিল, দীর্ঘদিন আপেল-এর প্রতি আমার ভক্তি আসেনি। ঠিক যেমন আসেনি কম্প্ল্যানের প্রতি। যদিও মায়ের ধারণা ওটা না খেলে আমার বাড়ন্ত বাচ্চা হওয়া আটকে যেত! কাঁটাওয়ালা মাছ, নিমপাতা, ডাঁটা, কুমড়ো অবশ্য আমার মা চেয়েও আমার খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি। এরকম অনেক খেতে না চাওয়া খাবারের দুঃখ ভুলিয়ে দিত রবিবারের সকালগুলো, পরীক্ষা শেষ হওয়া বিকেলগুলো। নিখুঁত ফুলে ওঠা লুচির সঙ্গে ছোট আলুর নিরামিষ আলুর দম বা কচুরির ভিতরে সমানভাবে বিছিয়ে থাকা করাইশুঁটির পুর কিংবা চিংড়ি ভর্তি পটলের দোলমা, বা ধোঁয়া ওঠা ভাতে মাটনের মতো খেতে লাগা চিকেন, আমার মা ছাড়া কেউ পারে না। আমি চাইও না পারুক।
মায়ের রান্নার কদর আমার চেয়ে বেশি আমার বন্ধুরা করেছে চিরকাল। আমার বরং হম্বি-তম্বি ছিল বেশি। এটা কেন না, ওটা তো বানানোই হয় না, রোজ এক খাবার খাব না, এইসব অভিযোগে অতিষ্ট করে মারতাম। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমার বিরক্তিতে মায়ের কিছু এসে যেত, বেশি কথা বললে সোজাসুজি উত্তর আসতো ‛না পছন্দ হলে খেতে হবে না’ বা ‘নিজে করে নে’। সে মুরুদ তো ছিল না, তাই সবই খেয়ে নিতাম ব্যাজার মুখে। যদিও মা যাই রান্না করতো ভালোই হতো, তখন না মনে হলেও এখন সেটা আরও বেশি করে মনে হয়। পাই না কিনা রোজ রোজ আর! একটা মানুষ সংসার সামলে, দু’ঘন্টার জার্নি করে স্কুল পড়িয়ে বাড়ি ফিরে কাপড় কাচা থেকে শুরু করে পঞ্চপদ রান্না করা, সব যে কিভাবে নির্বিবাদে করে যেত তখন বুঝিনি, এখন বুঝি।
মায়ের সঙ্গে আমার খিদের একটা অদ্ভুত যোগ ছিল। আমার মা আমার মনে মনে কিছু খেতে ইচ্ছে হলে দিব্বি বুঝে যেত, চাইতে লাগতো না। যেমন, ওপরের ঘরে বসে মন দিয়ে পড়ার চেষ্টা করছি, মনটা প্রচণ্ড ডালপুরী ডালপুরী করছে। যতই ইকোনমিক্স-এর ইকুয়েশন মনে রাখার চেষ্টা করছি চোখের সামনে ছড়িয়ে পড়ছে ডালপুরী ভেঙে বেরিয়ে আসা ডাল। হঠাৎই তখন ডিনার টাইমের বেশ কিছু আগেই খাবার ডাক এল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেখি কড়াইতে গরম তেলে ভাসছে ফুলে ওঠা ডালপুরী। আমার আনন্দ আর দেখে কে তখন, মা কে বললে স্বীকারই করতো না আমি ভাবছিলাম বলেই মা বুঝে গেছে। এরকম একবার না, বহুবার হয়েছে। ‘মায়েরা সব বোঝে’-এর এরকম বাস্তব প্রতিফলন খাওয়া ছাড়া জীবনের অন্য ক্ষেত্রেও হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
স্কুল বা কলেজ জীবনে টিফিনটা জীবনের একটা অন্যতম পার্ট ছিল। ওই টাইমটায় অন্য সেকশন বা অন্য ডিপার্টমেন্ট-এর প্রিয় বন্ধুরা কৌটো নিয়ে জমায়েত হতো। তখন বার্থ ডে ট্রিট মানে মায়ের বানিয়ে দেওয়া দু-টিফিন কৌটো চাউমিন, ঘুগনি-পরোটা কিংবা লুচি আলুর দম। আমাদের সময় সংস্কার ছিল বইয়ের সঙ্গে আমিষ না নেওয়ার, যেদিন প্রথম ইলেভেন-এ মিথ ভেঙে এগ চাউমিন নিয়ে গেলাম, সঙ্কোচকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে নিজেকে বলেছিলাম, মা দিলে কোনও দোষ হয় না। যদিও আমি খাবার ভাগ করে নেওয়ার ব্যাপারে ভীষণ হিংসুটে, বিশেষ করে যখন সেটা মায়ের বানানো স্পেশাল কিছু হয়। কলেজে বা ইউনিভার্সিটি-তে যেদিন টিফিনে লুচি-আলুরদম থাকতো নিজের দলের লোকজনকে নিয়ে চলে যেতাম কোনও ফাঁকা ক্লাসরুম বা পিছনের বাগানে। মাংস ফেলে রেখে চলতো সেই নিরামিষ অমৃত খাওয়া। এখন এতটা বড় হয়ে গিয়ে সেই হিংসেপনা আমার বেড়েছে বই কমেনি। যেদিন অফিস ফেরতো বাপেরবাড়ি যাই, অফিসের বন্ধুরা জানে পরদিন এ মেয়ে হাটের মাঝে খাবে না। মাস গেলে একবার দুবার পাওয়া কিনা, খুব নিজের করে রাখতে ইচ্ছে হয়। নিজের বানানো টিফিনে আর যাই থাকুক আদর থাকে না।
মায়ের সঙ্গে যদিও আমার সম্পর্ক কোনোদিনই খুব আদুরে বা গলা জড়িয়ে মন খারাপ ভাগ করে নেওয়া টাইপের ছিল না। বরং আমি অনেককিছুই এড়িয়ে যেতাম। বেশি কথা বলতাম না, অকারণে ঝগড়া করতাম। মায়ের দিক থেকেও ভালোবাসার থেকে বকুনির প্রকাশই ছিল বেশি। কিন্তু যেই বাড়িটা বদল হয়ে গেল বুঝলাম আমার পুরোনো সবকিছু ওই মহিলার কাছে রয়ে গেল। বুঝলাম সম্পর্কটা এক রাত্তিরে লং ডিস্টেন্স হয়ে গেছে। আমার সিগন্যাল এখন আর সব সময় কানেক্ট হবার না। বিয়ের আগে আমায় কখনোই বাড়ি ছেড়ে থাকতে হয়নি, তাই ছেড়ে থাকার দুঃখের চেয়ে প্রাথমিকভাবে আগ্রহই বেশি ছিল। কিন্তু পরে বুঝেছি ছেড়ে যাওয়া মানে পিছুটানগুলো একটু একটু করে বাদ যাওয়া। ভিতরের যোগাযোগের সুতোগুলো আলগা হওয়া। বুঝেছি মা আগে আমায় যতই ‛না পোষালে খেতে হবে না’ বলুক, আমাদের বাড়ি থেকে চিংড়ি, মাটন, ভেটকি, পমফ্রেট-এর চল কমে গেছে আমার চলে যাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। মা আর ডাল-এর ফোড়ন বেছে ফেলে দেয় না আমার মুখে লাগতে পারে বলে! আর মাছের কাঁটা বেছে রাখে না আমি তাড়াহুড়ো করে খেয়ে বেরোব বলে!
এখন যখন নিজে রান্না করতে গিয়ে ভুলভাল হয়ে যায়, মনে পরে মায়ের ‛শ্বশুরবাড়ি গেলে বুঝবি’ বা ‛কুটোটি নেড়ে উপকার করতে জানো না’! তেলের মধ্যে ফোড়ন দেওয়ার সময় মায়ের হাতে মিশে যাওয়া রসুন, হলুদের গন্ধ নাকে লাগে। যখন হঠাৎ পিঠে পার্বণ-এর কপি লিখতে লিখতে পাটিসাপটা বা রস বড়া খেতে ইচ্ছে করে, তখন মনে মনেই খেতে হয়। যদিও কলকাতায় থাকার সুবাদে ও ডেলিভারি app গুলোর কল্যাণে ঘরে বা অফিসে বসে এখন যা ইচ্ছে হচ্ছে অর্ডার করা যায়। পছন্দের কুইজিন বেছে সপ্তাহান্তে রেস্টুরেন্টে ঢুঁ মারা যায় সহজেই। কিন্তু মায়ের রান্নাটাই অর্ডারসীমার বাইরে চলে গেছে। একটা ফোন হয়তো বা কোনো কোনো দিন খুব খিদে পাওয়ার সময় ঠিক এসে যায়। প্রশ্ন আসে ‘কবে আসবি?’ জানি দিন বললেই হবে, মেনু রেডি থাকবে। কিন্তু মায়ের ওই পরিপাটি করে খাওয়ানোটা খুব অস্বস্তিতে ফেলে। যখনই যাই এক বাটি চিংড়ি, চিকেনের লেগ পিস কিংবা তেল ভাসা মাটন কষা, দু-তিন রকম মিষ্টি দিলে তো জন্মদিনের মতো ফিলিং হয়। অমনটা তো বছরের ওই একটা দিনেই ভালো লাগে, নাহলে তো নেমন্তন্ন মনে হয়। তবুও খাই আশ মিটিয়ে, মায়ের ঠোঁটের কোণে হাসি চোখ এড়ায় না মোটেই। এই মানুষটাকে আগে কখনোই কোনও রান্নার জন্য থ্যাংক ইউ বলা হয়নি, এখন ইচ্ছে করলেও বোকা বোকা লাগতে পারে ভেবে বলা হয় না।
মা রিটায়ার্ড হওয়ার পর একটা ইয়া মোটা ডাইরি দিয়ে এসেছি, মায়ের হাতের রান্না লেখার জন্য। বছর দুই পেরিয়ে গেলেও তিনি এক লাইনও লেখেননি। বার বার বললে উত্তর ‛আমি পরিমাণ বুঝে লিখতে পারি না’! আমি জানি না ওই ডাইরির পাতা কোনোদিন আদৌ মা ভরাবে কিনা, নারকেল বাটা দিয়ে বেগুন বা পুর ভরা উচ্ছে আমি কোনদিনও বানাতে শিখব কিনা, কিন্তু মায়ের বানানো খাবারের টেস্টগুলো মনে লেগে থাকবে চিরকাল, যেমনটা মায়ের না দেখানো ভালোবাসাটা প্রতিবার আমি চলে আসার সময় লেগে থাকে চোখের কোণে।