যত বয়স হচ্ছে জন্মদিন ব্যাপারটা ভীষণ টায়ারিং হয়ে যাচ্ছে। আনন্দ পাওয়ার থেকে ঘুম বেশি পাচ্ছে! আর একদমই অকারণ উত্তেজনা হচ্ছে না। ভ্যাগিস 90-এর দশকে মোবাইল, ফেসবুক ছিল না, শুভেচ্ছার ঝড় ছিল না, থ্যাংক ইউ বলে চলার মোশন ছিল না। তখন প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে কেনা দুটো জামার থেকে রেখে দেওয়া একটা চান-টান সেরে পরে ধার জুড়ে বাটি সাজানো থালার সামনে বসে মায়ের হাত থেকে পায়েস খাওয়ার আয়েশ ছিল। বোনের পাতের চিংড়িগুলো বড় না আমার গুলো, সেসব মেপে নেওয়ার হিংসেপনা ছিল। এতগুলো বয়স পেরিয়ে এসে সব জন্মদিন তো তেমন মনে রেখে দেওয়ার মতন থাকে না। তবে মনে রয়ে গেছে 5 বছরের জন্মদিনের রানী গোলাপি ঘাগড়া, সেই ঘাগড়া পরে ছোটকাকুর চাঁপ দাড়ি আর সানগ্লাসে ছবি তোলা! আমার পাড়ায় প্রিয় বন্ধু ছিল প্রিয়াঙ্কা। তখন দুজনেই খুব ছোট। একসঙ্গে স্কুলে ভর্তির দিন ও এক ক্লাস উঁচুতে ভর্তি হয়েছিল বলে খুব কেঁদেছিলাম। সেই বন্ধুকে পাশে নিয়ে 5 বছরের জন্মদিনের এত্ত বড় কেক কাটা খুব ঝকঝকে এখনও। কোনও কোনও জন্মদিনে হুট করে দাদামণির হাজির হয়ে যাওয়াটা যেমন। আমার বাড়ি বাঙালিপন্থী। আমিও খানিক তেমনই ছিলাম। আমার জন্মদিনে কেক কাটার থেকে চিংড়ি, পমফ্রেট, পাঁঠার ঝোল, তিথি মেনে পায়েস গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। আমার মনেই পরে না আমি 5 বছরের জন্মদিনের পর কখনও বাড়িতে কেক কেটেছি বলে!
স্কুলে জন্মদিন অন্য ভালোলাগা নিয়ে আসত। জন্মদিনে প্রিয় বন্ধুকে উপহার দেওয়ার চলটা শুরু করেছিল মোম। মনে আছে ও রঙিন গোল গোল ক্লিপের প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়েছিল ক্লাস রুমে। আমি ক্লাস-এ ঢোকার আগে উইশ করার জন্য সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকার একটা ছবিও খুব পরিষ্কার দেখতে পাই। জন্মদিনে স্কুলে যেতে ভালো লাগতো। আমার দিন, আমার দিন ফিলিং-টা তখন থেকেই শুরু। মা বেশি করে টিফিন দিত সেদিন। কাছের জনদের সঙ্গে ভাগাভাগি হত। একটু বেশি গাল টেপা, জড়িয়ে ধরায় ভরে থাকতো সেইসব দিন।
নাইন-টেন থেকে স্কুলের সঙ্গে সঙ্গে পড়ার ব্যাচের বন্ধুদের প্রতিও টান বাড়ে খুব। ছোটখাটো ট্রিট, বাড়িতে নেমন্তন্ন আর পকেট মানি জমিয়ে প্রিয় বন্ধুদের দেওয়া পেন, গল্পের বই, কার্ড-এর গন্ধে ডুবে যেতাম জন্মদিনে। কিছু বন্ধুর সঙ্গে জন্মদিনে দেখা না হলে মনকেমনের পাহাড় জমতো, আবার তাদের বাড়িতে এসে দেওয়া আচমকা সারপ্রাইজ মনে লেগে থাকতো সমস্ত দিন। কলেজে পড়ার সময় থেকে আমার জন্মদিনে বিশ্বায়নের ছোঁয়া লাগে। ওই বন্ধুরা মিলে কেক কাটাটার শুরু তখন থেকেই। তারপর চা-লুচি-আলুরদম-ফুচকা বা মশলা দোসা। সবার পকেটমানি জমিয়ে দেওয়া উপহার, নদীর ধার, পা দুলিয়ে আড্ডা। জীবনে প্রেম আসার পর জন্মদিনগুলো বেশি স্পেশাল হতে শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে সোশ্যালও। ইউনিভার্সিটির গ্রুপের সঙ্গে গঙ্গার ধারে জেটির ওপর ঝোড়ো হাওয়ায় কেক কাটার আনন্দ আজও অমলিন। উড়িয়ে আনা ধুলোর এক ফোঁটাও ঝড় লাগাতে পারেনি সে ভালোলাগায়। আমরা ভিজেছি, দেদার আনন্দ করেছি। ফেসবুকে ঢুকে পরা এইসব সময় থেকেই। ছবি-ছাবা, আপডেট-এ ডুবতে শুরু হওয়ারও।
চাকরি করতে গিয়ে জন্মদিনের সংজ্ঞা বদলেছে অফিস বদলের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে। কেউ উইশ না করা নাইট শিফট থেকে ‘আজ অফিস কেন এসছিস’-এর চাপা ধমক মানুষ চিনিয়েছে, বড় হতে শিখিয়েছে। চাকরির সূত্রেই এমন বন্ধু এসেছে যাঁরা মন প্রাণ দিয়ে আমার দিনটাকে নিজের করে নিয়েছে। কিছু মানুষের কাছে এত প্যাম্পার্ড হয়েছি বুড়ো বয়সে এসে যে অফিসের সবাই জড়ো হয়ে কেক কাটার ফর্মালিটি সেখানে ফিকে হয়ে গেছে।
বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বাবা-মা, আমাদের হুল্লোড়ে বাড়ির সকলকে ছেড়ে জন্মদিন কাটানোর দুঃখ লেগে থাকে জন্মদিনের আনন্দের গায়ে। শাশুড়ি যত্ন করে রান্না করে খাওয়ায়, পায়েস বানায়। কিন্তু মাকে মিস করাটা চিন চিন করে। বর খুব মন ভালো করা সারপ্রাইজ-এর মোড়ক খোলে প্রতি বছর, আবদার, আলহাদ দুই বাড়ে। কিন্তু ছোটবেলার আমি-কে খুঁজে পাই না আর। ইনবক্স উপচে পড়া শুভেচ্ছার ভিড়ে পায়েসের হাঁড়ি চেঁচে সাফ করার ইচ্ছেগুলো ছটফট করে। এত থ্যাংক ইউ-এর ভিড়ে সবচেয়ে বেশি থ্যাংক ইউ টা যাদের বলার, তাদের আর আগের মতো করে পাওয়া হয়ে ওঠে না। আর আমি এসব সাত-পাঁচ ভাবনায় বড় হয়ে যাই আর একটু।