নতুন বছর আসে, আর পুরনো স্মৃতিরা ফুরোয় একটু একটু করে। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের সব কিছু কি থোড়াই মনে থাকে! আজকাল আবার পার্বণের সংখ্যা এদেশ-বিদেশ মিলিয়ে তেরো ছাড়িয়ে গেছে। তবু উৎসব প্রিয় বঙ্গসন্তান হয়ে কিছু বিশেষ পার্বণের আমেজ বুকে নিয়ে বাঁচতে তো বেশ লাগে। এই যেমন বৈশাখ আসার আগে যদি একটা মিনি দুর্গাপুজো টাইপ কিছু আসে জীবনে, বসন্ত একটু বাতাস পায়। শুধু এক-দুদিনের রং মাখায় কি স্বাদ মেটে! আমাদের মানে শ্রীরামপুরের চাতরা অঞ্চলে বড় হয়ে ওঠা ছেলেপুলেদের কিন্তু সে স্বাদ ছিল। সে যতই এনুয়াল পরীক্ষার গুঁতো থাকুক।
তো যা বলছিলাম, আমাদের শ্রীরামপুরে বসন্তের পলাশ-শিমূল আসতো শীতলাপুজো এসে যাওয়ার খবর নিয়ে। বেশিরভাগ সময়ই মার্চ এ, কোনও বছর ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে। বাড়ির কাছেই মন্দির। রেল গেট পেরোলে আলোয় আলো, বেলুন ওলা, রাশি রাশি জিলিপি-গজা-পাঁপড়। 4-5 দিন ধরে বিশাল জায়গা জুড়ে মেলা, নাগরদোলা, নানা জেলার ঘুগনি-ফুচকা, বাসন-কোসন, আরও কত কী। আর পরীক্ষাটা নিয়ম করে আসতো সেইসময়। মন্দিরের কাছে বাড়ি হওয়ার যেমন সুবিধে আছে, তেমন অসুবিধেও। টুক করে একবার মেলাতলা ঘুরে আসা যায়, আবার ঢাকের আওয়াজে পড়ায় মন বসে না। যতগুলো শীতলাপুজোর কথা মনে পড়ে, তার মধ্যে হয়তো এক-দু বছর ছাড়া কখনই পুরোপুরি আনন্দ করে ওঠা হয়নি পড়ার চাপে। কিন্তু যা পেয়েছি তাই আমাদের ছোট থেকে বড় হওয়ার গল্প লিখেছে নতুন ভাবে।
মনে পড়ে তখন আমার ক্লাস ফোর। এডমিশন টেস্ট দিয়ে ভর্তি হওয়ার তোড়জোড় হাই স্কুল-এ। যথারীতি কোন স্কুলে চান্স পেতে হবে তাই নিয়ে মা-বাবাদের বেশি চাপ আমাদের থেকে। এদিকে ঢাকের আওয়াজে মন উচাটন আর চোখের সামনে খোলা গাইড টু এডমিশন টেস্ট! একটা পেপার শেষ করতে পারলে তবে ছাড়পত্র। এক চক্কর জিলিপি বা আইসক্রিম খেয়ে এসে আবার বসা! বাবা সাধারণত আমায় পড়াতো না, যেদিন পড়াতো পাগল করে দিত। এই পুজোর সময় পরীক্ষাগুলো তেমন দিন নিয়ে আসতো মাঝে মাঝেই। তখন সারাদিন পড়ে মেলায় গিয়ে মুক্তি খোঁজার চেয়ে পরম সুখ আর কিছু ছিল না। বাবা কিন্তু নিয়ে গিয়ে চীনা মাটির নানা ডিজাইনের কফি মাগ কিনে দিত একটা বাঁধা কাকুর থেকে, প্রতি বার, আমার শখ ছিল খুব। কাপের সঙ্গে জুটে যেত এর ওর দেওয়া হেয়ার ব্যান্ড, রং বেরঙের রাবার ব্যান্ড, ক্লিপ, চুরি, টুকটাক খেলনা, কাগজের কুমির, ম্যাজিক, আরো কত কী! বাড়িতে লোকজনও আসতো এ সময়। হইহই, অষ্টমীর লুচি-আলুরদম, নতুন জিনিস কিনে মা-কাকিমা-আত্মীয়দের বাড়ি ফেরা, সেসব দেখার উৎসাহই ছিল আলাদা। ভাই-বোনদের সঙ্গে মেলা যেতে পারতাম যে বছর, আনন্দ হত দ্বিগুন। কখনও কখনও পুরো পুজোর দিনগুলোতেই পরীক্ষা থাকতো। ঠাকুর দেখে আসা টা মান্ডেটরি ছিল ঠাকুর মণ্ডপে এসে যাওয়ার পরেই। তারপর বলা তো যায় না, প্রথম পরীক্ষায় ধ্যাড়ালে কপালে কী দুঃখ নাচছে!
শীতলাপুজোর আনন্দ বেশি করে ধরা দিয়েছিল ওই ‘আমি তখন নবম শ্রেণী’-র সময়। তখন পড়ার ব্যাচ, নতুন বন্ধু, প্রথম ছেলেদের সঙ্গে ঘুরতে বেরোনোর ছাড়পত্র। তখন নিজের পড়াটা নিজে বুঝে নেবার স্বাধীনতা পেয়ে গেছি। অষ্টমীর দিন পরীক্ষা না পড়লে সপ্তমী আমাদের টিম-এর বাধা মেলা তলা। ওহ, আমি চিরকালই দলবাজিতে সিদ্ধহস্ত। তাই কাছের বন্ধুরা ছাড়া আর কেউ গ্রুপ-এ নাম লেখাক এ আমার না পসন্দ ছিল। আমরা 5-6 জনই বেরোতাম প্রতিবার, কখনো দু-এক জন বাড়ত, কিন্তু সেটা প্রতি বছর না। আমার প্রথম নাগরদোলা চাপা, ব্রেকডান্স-এ চড়ে ছিটকে চলে যাওয়ার উপক্রম হওয়া, ময়ূরপঙ্খীতে উঠে পায়ে পায়ে ঠোকা-ঠুকি লেগে যাওয়া, রাস্তার দোকানের চাউমিন, ফুচকার ফাউ নিয়ে ঝগড়া সব এই বন্ধুদের সাথেই। ভিড় রাস্তায় আড়াল দেওয়া, ঘোরা সেরে গেট পেরিয়ে বাড়ি অব্দি ছেড়ে দেওয়ার দায়িত্ব নেওয়া কী, বুঝতে শেখাও এদের সাথেই। শীতলাতলা আর এই পুজোটা বার বার আমাকে বুঝিয়েছে বন্ধুত্বের মানে। আর এক প্রিয় বান্ধবীর সঙ্গেও বেরোনোর জন্য রাখা থাকতো একটা দিন। ছেলেমানুষি আর দুস্টুমি মিশে থাকতো সেইসব ভিড় হাঁটায়। তারপর সময়ের সঙ্গে স্কুলের গন্ডি পেরোনো আর বিকেলবেলায় গান শোনার অপেক্ষা হয়ে থেকে যাওয়া আমাদের সপ্তমীগুলোর। কেউ থাকে তো কেউ থাকে না, দু একবার চেষ্টা করেও আর সেভাবে হল না সেই টাইম ধরে বেরিয়ে পরা। পুজোটার মানে বদলে গেল। ঠাকুর দেখা, ফুচকা-জিলিপি চলল কিন্তু ভালোলাগাগুলো মিইয়ে গেল। কোনও পুজোয় হয়তো 4 মাথা এক হল, আড্ডা জমল খানিক, কিন্তু সেই ছেলেবেলার স্বাদ পাওয়া হল না।
চাকরি জীবনে ঢুকে বুঝেছিলাম এ ছোটবেলার পরীক্ষার দিনগুলোর চেয়েও নিষ্ঠুর। ছুটির তো বালাই নেই, সঙ্গে বাড়ি ফেরার ও ঠিক নেই। একদিন ঠাকুর দেখতে পাওয়া মানেই অনেক। কোনোদিন মাকে নিয়ে বেরিয়ে একটু কিছু খেয়ে বাদাম ভাজা, জিলিপি ঠোঙায় নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। ঘুরতে ভয় লাগতো, ছোটবেলায় যে ভিড়ে গা ভাসানোর আনন্দ ছিল, বড় হয়ে তা থেকে দূরে থাকাতেই যেন শান্তি পেতাম।বোনেদের কাছে গল্প শুনতাম ওদের স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে বেড়ানোর, বয়ফ্রেন্ড-এর হাত ধরে ইলেকট্রিক নাগরদোলার। আর মনের মধ্যে ফিরে যেতাম আমাদের সেই সব দিনে।
বিয়ের পর পুজোটা আরও দূরের হয়ে গেল। তখন পরীক্ষা শুরু হল টাইম ম্যানেজমেন্ট-এর। উইক ডে-তে পুজো পড়লে একটা দিন গিয়ে রাত টা কাটিয়ে ফিরে আসব নাকি উইকএন্ড-এ যাব সেই দ্বন্দ্ব পেরিয়ে যা হোক করে ম্যানেজ দেওয়াটুকুই হয়। তবু যাই, ছোটবেলাটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই হয়তো। বেলুন দেখে আনন্দ পাওয়ার জন্যই হয়তো। আমাদের বেশিরভাগ পার্বণই তো অফিসের ডেস্ক-এর নিচে, অন্ধকারে ল্যাপটপের আলোয় হারিয়ে যায়, কিন্তু ছেলেবেলার স্মৃতি উস্কে দেওয়া এইসব পার্বণগুলো বাঁচিয়ে রাখতে আজও ভীষণ মন চায়। নতুনের চাপে ঢাকা পড়ে যাওয়া মূহুর্তদের বাঁচতে ভীষণ মন চায়।