Flavour of Durga Puja | The greatest festival of Bengal
পুজোর আসার আগে থেকে পুজো পুজো গন্ধ পাওয়াটা কিন্তু বাঙালির মজ্জাগত। সে গন্ধ কেমন বলে বোঝাতে না পারলেও তা নিয়ে চর্চা করার সময় বাঙালির চোখে-মুখে সব পেয়েছি’র হাসি লেগে থাকে। এই গন্ধটা পাওয়ার শুরু কবে থেকে তা নিয়ে যেমন কোনও দিনক্ষণ মাপা নেই, তেমনই কে কবে সে গন্ধে গা ভাসবে তার কোনও হিসেব নেই। এই যেমন ধরুন আমি, আমার বয়স ও অবস্থান বদলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাল্টেছে পুজোর গন্ধ পাওয়ার ধরণ। গন্ধটা পেয়ে গেলে আবার আর এক মুশকিল, পুজো ছাড়া আর কিছু মাথায় কাজ করে না তখন। ছোটবেলায় মনে পড়ে প্রথম পুজোর জামাটা পাওয়া বা কেনা হয়ে গেলেই গন্ধটা এসে যেত। তারপর জামা-কাপড়ের সংখ্যার সঙ্গে টেক্কা দিয়ে বাড়ত গন্ধে ডুবে যাওয়ার সুখ। মফস্সল শহরে বড় হওয়া। পাড়ার মন্দিরে নিয়ম-নিষ্ঠা মেনে পুজোর চল। কোনও কোনও বছর সেখানেই ঠাকুর তৈরি হত। সেবার পুজো আসতো বেশি তাড়াতাড়ি। রোজ স্কুলফেরতা কত্তটা এগোল দেখতে গিয়ে পুজোর গন্ধটা নাকে লাগতো। রেললাইনের ধারে গজিয়ে ওঠা কাশ, বিশ্বকর্মার ভোকাট্টা, টিভিতে ‘ছুটি ছুটি’ শুরুর অপেক্ষায় মিশে থাকত সে সময়ের পুজোর গন্ধ।
ছোটবেলায় এত নিম্নচাপের ঠেলা ছিল না। বর্ষা ঠিক সময়ে আসতো-যেত। বর্ষা চলে গেলেই মেঘের খেলা শুরু হত আকাশ জুড়ে। নীলের ওপর সাদা সাদা মেঘের ফর্মেশন দেখতে দেখতেই পুজো এসে যেত টুক করে। সাইকেল চালাতে চালাতে আকাশের দিকে চেয়ে থাকার জন্য কত ঝাড় খেয়েছি সে সময়, কিন্তু প্রাণভরে পুজোর ওই গন্ধটা নেওয়ার লোভ সামলাতে পারিনি কখনও। আমাদের বাড়ির সামনের বাড়িটায় একটা শিউলি গাছ ছিল, সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তা জুড়ে শিউলি বিছিয়ে থাকা দেখতাম যেদিন প্রথম, সেদিন সমস্তদিন পুজোর গন্ধটা ঘিরে থাকত। গন্ধটাকে আগলে রাখার জন্য শিউলি ভরতাম মুঠোয়। পড়ার ফাঁকে আনন্দমেলা, দেশের পাতা জুড়ে থাকা পুজোর গন্ধ ভরে নিতাম বুকের মধ্যে। আর যখন আমাদের ওখানকার কুমোরটুলির পাশ দিয়ে যেতাম কোনোদিন, তখন কাদা লেপা কাঠামো দেখে গা শিরশির করে উঠতো। সে শিরশিরানি আজ এত বছর পেরিয়ে এসেও একই আছে। ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়ে কলকাতার হাওয়া গায়ে লাগার পর জানলাম এখানকার কুমোরটুলির পুজোর গন্ধটা একেবারে আনকোরা। সার সার দিয়ে দাঁড়ানো মূর্তি, কোনওটায় প্রথম রঙের পোচ, কোনোটায় শুধু চক্ষুদান বাকি, কোনোটা আবার শুধুই মাটি, সেসব দেখে চমক লাগত। গোলার পর গোলা ওই গন্ধটা খুঁজে বেড়ানোর নেশায় যে কতবার ছুটে গেছি মনে নেই। টিমটিমে হলুদ আলোয় চারদিকে মূর্তির মাঝে নিস্পলক দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যে দিয়ে আমার জীবনে শরৎ এসেছে বার বার।
কলকাতায় থাকতে শুরু করার পর থেকে পুজোর গন্ধ পাল্টেছে। বিয়ে ভাগ্যে এসে পড়েছি থিম পুজোর পাড়ায়। সেখানে একটা পুজো শেষের এক মাসের মধ্যেই পরের পুজোর প্রস্তুতির গন্ধ পাওয়া যায়। আর পুজো শুরুর 3 মাস আগে থেকে দিনগোনার শুরু হয়ে যায়। একটু একটু প্যান্ডেল গড়ে ওঠার আপডেটগুলো, অফিসফেরতা কতটা হল দেখে আসার টানগুলো প্রতিদিনের ব্যস্ত জীবনে বাতাস দেয়। রোজ রোজ পুজোর গন্ধ বাড়ে। জড়িয়ে পড়ে রোজনামচায়। অফিস যাওয়ার পথে, ছুটির দুপুরে, অনলাইন শপিংয়ের উইন্ডোয় হঠাৎ হঠাৎ ভেসে আসে সে গন্ধ। নাকে আসে না, কিন্তু অনুভব করা যায়। ট্রাফিক জ্যামে, ধর্মতলার ভিড়ে, রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা পেরেকে, নতুন শাড়ির ভাঁজে সে গন্ধ ঘুরে বেড়ায় প্রতি মুহূর্তে। এসবের মধ্যেই যেদিন প্রথম পাড়ার রাস্তায় বিজ্ঞাপনী ব্যানার লাগে, বাড়িগুলো ঢেকে যায় হোর্ডিং-এর আড়ালে, আমার মনে পুজো এসে যায়। হোর্ডিং-এর আড়াল থেকে দেখা শরতের আকাশ এখন এভাবেই অপেক্ষা মুছে দেয়।
Follow me on Facebook & Instagram