Durga Puja and Pandal hopping
মহালয়াটা শোনা হয়ে গেলে পড়াশোনাটা লাটে উঠে যেত ছোটবেলায়। কবে কোথায় ঠাকুর দেখব, সেসব লিস্ট তখন থেকে মাথার মধ্যে ঘুরপাক। ভিড় টির নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাতাম না এমন নয় তবে পুজোতে (Durga Puja) লাইন পেরিয়ে ঠাকুর দেখার মধ্যে আমার একটা পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া সুলভ আনন্দ ছিল। আমাদের মফস্বল শহরে কলকাতার মতো লাইনের রমরমা ছিল না, 4 দিনে পাড়া বেপাড়া সব চষে ফেলা যেত নির্বিঘ্নে। কোথাও জ্যান্ত দুর্গা, ভ্যানিশ বা কারেন্ট এফেয়ার হলে খানিক লাইন উৎসাহের তোড়েই উৎরে ফেলতাম। বিকেল সন্ধে-তে পাড়া বেড়ানোর ভালোলাগা থাকলেও রাত জেগে ঠাকুর দেখা আমার ধাতে ছিল না। কলকাতার পুজোর সঙ্গে পরিচিতি ছোট বয়সেই হয়েছিল পিসির বাড়ির সুবাদে। পুজোর 2 টো দিন অন্তত আমার খিদিরপুর বাঁধা ছিল। কিন্তু সেখানে আশপাশের কটা ঠাকুর দেখেই আমার উৎসাহে ভাঁটা পড়ত। তার চেয়ে বরং দাদার সঙ্গে পুজোর গান বা গল্পের টান ছিল বেশি। কোনও কোনও বছর পিসির বাড়ি মা-কাকিমা-বোন সমেত পুরো গুষ্টি হাজির হতাম। তখনও রাতে সবাই খুব প্ল্যান করে ঠাকুর দেখতে গেলেও আমি ঠাকুমার আঁচল আঁকড়ে ঘুমনোয় বেশি সুখ পেতাম। সবাই পরদিন সকালে আমি কি কি মিস করলাম তার লিস্টি নিয়ে বসলেও আমার খুব কিছু আফসোস হত বলে মনে পড়ে না।
আর একটু বড় হয়ে কলকাতার পুজোর (Durga puja in Kolkata) প্রস্তুতির খবর পড়তে শিখে শহুরে পুজোকে অন্যভাবে চিনতে শুরু করলাম। কলকাতার সেরা পুজো বলতে তখন জানি মহম্মদ আলি পার্ক, লেবুতলা, কলেজ স্কোয়ার, যোধপুর পার্ক- আনন্দবাজারে ষষ্ঠী থেকে নবমী কোন পুজোয় মধ্যরাতে কত মানুষের ঢল নেমেছে তার একটা লিস্ট বের হত, সেখান থেকেই এই পুজো গুলোর নাম চেনা। মনে পড়ে বারুইপুর দিদার বাড়ি থেকে সকলে মিলে ভিড় ট্রেনে শিয়ালদা, সেখানে বেজায় লাইন দিয়ে এথলেটিক, লেবুতলার পুজো দেখা, কলেজ স্কোয়ারে আলোর রোশনাই, হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে মায়ের আঁচল জাপটে থাকা, নিজে না হারালেও কিছু না কিছু হারিয়ে ফেরা। কোনওদিন আবার বালিগঞ্জ-এ নেমে কালচারাল, একডালিয়া, সিংহী পার্ক হয়ে বাসে চড়ে সেলিমপুর। পায়ে ফোস্কা, গায়ের ঘামে মিশে যাওয়া পুজো দেখার আনন্দ।
বয়ঃসন্ধির সাথে সাথে বড়দের সঙ্গ ছেড়ে সমবয়সীদের সঙ্গে পুজোর আড্ডা, ঠাকুর দেখার ইচ্ছেগুলো বাড়তে শুরু করল। ক্লাস 8-9-এ বন্ধুদের সঙ্গে ঠাকুর দেখার স্বাধীনতা যখন পেলাম সপ্তমীর বিকেলটা পাল্টে গেল। রাস্তার দাঁড়িয়ে ফুচকা ঘুগনির সঙ্গে মিশল পুজোর প্রেমের গন্ধ। তখন ঠাকুর দেখার চেয়েও দামি বন্ধুরা মিলে পকেট মানি ভাগ করে রেস্টুরেন্ট-খাওয়া গুলো, বড় হয়ে যাওয়ার স্বাদগুলো। তবে আমাদের গন্ডি ছিল শ্রীরামপুর অবধিই। কলেজে ঢুকে ডানা গজাল, কলকাতার পুজো দেখার ছাড়পত্র মিলল দিনের বেলা। তখন ষষ্ঠী, সপ্তমী দুদিন ভিড় ট্রেনে চড়ে ঠিক হাজির হয়ে যেতাম শিয়ালদা বা ধর্মতলা। বাসে, মেট্রো-তে, ট্যাক্সিতে বন্ধুবান্ধবের কোলে-পিঠে করে এ পুজো থেকে সে পুজো করে বেড়ানোর মজাই আলাদা ছিল। দেশপ্রিয়, ম্যাডক্স চেনা এ সময়ই। ইউনিভার্সিটি-তে বন্ধু বদলেছে কিন্তু সে ট্র্যাডিশন-এ ভাঁটা পড়েনি। কলকাতায় তখন থিম পুজো ঢুকে পড়েছে পুরো দমে। উত্তর দক্ষিণ রেষারেষি বাড়ছে। আমাদেরও দিন ভাগ হচ্ছে। রাসবিহারী তে মিট করলে দক্ষিণের অনেকগুলো নামি পুজো হাতের নাগালে। একদিন সেসব সেরে আর একদিন বাগবাজার, কুমারটুলি, হাতিবাগান। বৃষ্টি, রোদ-কে তখন থোড়াই কেয়ার। সাবেক থিমের দ্বন্দ্ব পেরিয়ে শুধু প্রাণভরে দেখার সুখ। সে সুখের জন্য জুতো হাতে পায়ে ব্যান্ডেড লাগিয়ে সুরুচি থেকে চেতলা হেঁটেছি, 66 পল্লীর রঙ বেরঙের বাড়ির সামনে অবাক বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি, হাটারি-তে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিয়েছি।
যত বেশি কলকাতার সঙ্গে একাত্ম হয়েছি ঠাকুর দেখার নেশা আমায় পেয়ে বসেছে। এবিপি আনন্দে কাজ করার সুবাদে দু’বছর প্রেস কার্ড দেখিয়ে ভিআইপি লাইনে পুজো দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্তু পুজোর দিনে অফিস থাকায় সে দেখা অল্পেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। স্ক্রিন জুড়ে সুপারস্টার মেগারস্টার পুজো দেখে তখন আফসোস জমেছে। পিসি খিদিরপুর থেকে বেহালায় শিফট করার পর বেহালার পুজোর সঙ্গেও পরিচিতি ঘটেছে। বিজ্ঞাপনে কাজ করতে এসে পুজো ব্যাপারটা পারফেক্ট হয়ে গেল সংবাদ প্রতিদিন-এর বিজ্ঞাপনী কাজ করতে এসে। কাজের মিটিং-এ ব্র্যান্ড ম্যানেজার প্রস্তাব দিলেন শর্টলিস্টার প্যানেল-এ কাজ করার। 3 টে দিন, অফিস-এর পর গাড়ি চড়ে বেরিয়ে পড়া, রাত ভোর করা কলকাতা চষে। পুজো বাছাই-এর চেয়ে শহরের সিংহভাগ পুজো দেখে ফেলার এই মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া করার কথা এক মুহূর্তের জন্যও ভাবি নি। আর রাত জাগা? তাতে কষ্টের চেয়ে আনন্দ হয়েছে ঢের বেশি। দেখার চোখ বদলেছে, বোঝার মনও। শহরের পুজো পাগল একগুচ্ছ মানুষের সঙ্গে আলাপ জমেছে। 2015 থেকে সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে। কলকাতার পুজো আমার প্রাণের পুজো হয়ে উঠেছে রোজ।
Follow me on Facebook & Instagram