Zhangjiajie থেকে আমাদের গন্তব্য ছিল দক্ষিণ চীনের নদী-পাহাড় ঘেরা শহর Guilin। Guangxi Zhuang Autonomous Region-এর উত্তর পূর্বে অবস্থিত এই শহরের আনাচে কানাচে প্রকৃতির খেলায় গড়ে উঠেছে লাইমস্টোন পাহাড়। সেখানে Li নদীর ধার ধরে পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে উঠেছে জনবসতি। প্রকৃতি এখানে প্রাণ ভরে সেজেছে নদী, পাহাড়, সবুজের মিশেলে। সে রূপ চোখে লেগে থাকে।
আমাদের প্রাথমিক প্ল্যান-এ Zhangjiaje থেকে বাসে Changsha South স্টেশন পৌঁছে সেখান থেকে Guilin-এর ট্রেন ধরার কথা থাকলেও ভাষাগত সমস্যার কারণে আগের রাতে বাসের টিকিট কাটতে গিয়ে কোন বাস South স্টেশন যাবে এবং তার টাইম কটায় তা বুঝে উঠতে সমস্যা হয়েছিল। তাই Zhangjiajie এর হোটেল-এর রিসেপশনিস্ট-এর পরামর্শে ট্রেন-এর টিকিট পেয়ে Changsha স্টেশন যাওয়া হবে ঠিক হয়েছিল। সেখান থেকে মেট্রো ধরে South Station. সকাল সাড়ে আটটায় ট্রেন। এদিকে আমাদের পরবর্তী ট্রেন বিকেল 5 টার পর। কিন্তু আর ট্রেন না থাকায় সকাল সকালই বেরিয়ে পড়তে হয়েছিল। তবে Changsha south station পৌঁছে টিকিট অফিসে কথা বলে সহজেই ট্রেন-এর টিকিট এগিয়ে নেওয়া গেল নিখরচায়। টুরিস্ট বলে নয়, ওখানকার মানুষজনের ক্ষেত্রেও একই সুবিধা বলবৎ। এমন সহজ পদ্ধতিও থাকতে পারে দেখে খুশি হলাম।
জীবনের প্রথম বুলেট ট্রেন চড়া নিয়ে ভীষণ উত্তেজনা ছিলই। ট্রেন-এর ভিতরের ব্যবস্থাপনা দেখে তাক লেগে গেল। ইয়া বড় বড় জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখতে দুর্দান্ত, ট্রেন-এর বাথরুম বাড়ির বাথরুমের মতোই বড়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে কোনও অভিযোগের জায়গা নেই। ট্রেন কোন সময় কত স্পিড-এ চলছে তা ডিজিটাল ডিসপ্লে-তে সবসময় দেখা যাচ্ছে। এক এক সময় গতি এত বাড়ছে বাইরে তাকাতে রীতিমতো অসুবিধে হচ্ছে। বাইরে বেশিরভাগই পাহাড়ি এলাকা, ভারী সুন্দর সেই সব নাম না জানা জায়গা। এমনই কোথাও পাহাড়ের কোলে আকাশ লাল করে সূর্যাস্ত দেখলাম। যতক্ষণ আলোর রেশ রইল ততক্ষণ প্রকৃতিকে উপভোগ করলাম মন ভরে।
Guilin-এ নামলাম যখন তখন প্রায় সন্ধে 7 টা। ট্যাক্সি ধরে রওনা দিলাম হোটেল। রাস্তায় যেতে যেতে এ জায়গাটা তেমন ইম্প্রেসিভ লাগল না, আলো ঝলমল না, বরং খানিক আলো আঁধারি। তারওপর এই প্রথম কোনও ট্যাক্সি ড্রাইভার মিটার-এ যেতে না চেয়ে ঠকানোর চেষ্টা করল। ভাষাগত সমস্যা না থাকলে কলকাতার মতো খানিক ঝগড়াই করে নিতাম হয়তো। যাইহোক, মিনিট 20-এর মধ্যেই হোটেলে পৌঁছলাম। আমাদের Guilin-এর হোটেল Memory Inn, Booking. com থেকেই বুক করা। রিসেপশন ফার্স্ট ফ্লোর-এ। সেখানে গিয়ে দেখা হল হোটেল ম্যানেজার Tony-র সঙ্গে। আগেই WeChat এ আলাপ পর্ব সারা ছিল। প্ল্যানও খানিকটা বলা ছিল। Guilin এর কাছাকাছি দেখার অনেক কিছু থাকলেও আমরা নিজেদের সুবিধামতো ও সিজন হিসেবে কিছু জায়গা বেছে নিয়েছিলাম। যেমন, লংজি রাইস টেরাস- এখানে অক্টোবর-এর শুরুতেই ধান কেটে ফেলা হয়। আমরা যে সময় গেছি তখন ন্যাড়া ধাপ ছাড়া কিছুই দেখা যেত না। তাই সেটা লিস্ট থেকে বাদ গিয়েছিল। Red Flute Cave যাব না ঠিক করেছিলাম কারণ আমরা Zhangjiajie তে লাইম স্টোন কেভ দেখেছি। যে ছাড়াও মৎস্যজীবীদের গ্রাম Xingping ঘুরে দেখার ইচ্ছে থাকলে সময় ছিল না। আমাদের দেড় দিন সময়ে আমরা ঠিক করেছিলাম প্রথম দিন রিভার ক্রুজ আর Yangshuo ঘুরে দেখব, এক্ষেত্রে প্যাকেজ-এ নিলে রেট কম বেশি একই দেয় সব হোটেল। ঠিক করেছিলাম, দ্বিতীয় দিন ভোরের আলো ফোটার আগে Yangshuo-এর Xianggong mountain-এ গিয়ে সূর্যোদয় দেখব। গোল বেঁধেছিল সেখানেই! Tony কে সেই প্ল্যান জানিয়ে গাড়ির কথা জানতে চাইলে সে বিশাল দাম হাঁকল! শুধু Xianggong Hill যেতে আসতে ভারতীয় টাকায় আট হাজার (800 Yuan)! শুধু তাই না, ক্রুজ না বোট তা নিয়েও সঠিক সাজেশন দেওয়ার বদলে নানারকম কনফিউজন তৈরি করল Tony. বুঝলাম Guilin জায়গাটা আমাদের ঘুরে আসা অন্য জায়গা গুলোর চেয়ে বেশ আলাদা।
আমরা ফ্রেশ হয়ে বেরোলাম আশপাশ দেখতে। হোটেল থেকে পায়ে হেঁটেই Fir lake-এর ওপর Sun & Moon Pagoda. লেকের জলে হলুদ ও সাদা আলোয় Twin Pagoda দেখতে বেশ। লেকের চারপাশ জুড়ে লোকজন হেঁটে বেড়াচ্ছে বা বসে গল্প জুড়েছে কেউ। বোটিংও হচ্ছে জলে ঢেউ তুলে। এখান থেকে বেরিয়েই অল্প হেঁটে সাবওয়ে দিয়ে নেমে গিয়ে ঢুকে পড়লাম একটি আন্ডারগ্রাউন্ড মার্কেটে। এখানে জিনিসপত্র বেশ সস্তা চীনের অন্যান্য প্রভিন্স-এর চেয়ে। বাইরে এসে Xianggong Hill যাওয়ার জন্য taxi বুক করা যায় কিনা চেষ্টা শুরু করলাম। দু এক বার ট্যাক্সি পেয়েও ভাষাগত কারণে Deal ফাইনাল হল না। অবশেষে এক মহিলা ট্যাক্সি ড্রাইভারকে পেলাম যে ইংরেজি না জানলেও আমার সঙ্গে we chat এ কথা বলতে আগ্রহী হল। তাকে Xianggong Hill যাওয়ার কথা বলতে সে নিজেও খুব উৎসাহী হয়ে উঠল। জানালাম সূর্যোদয় দেখতে চাই। ভোর হওয়ার আগে বেরোব। মহিলা জানালেন তিনি আমাদের যাওয়া আসা নিয়ে ভারতীয় টাকায় 3000 টাকা (300 Yuan) নেবেন। আমি শুনে মহানন্দে হ্যাঁ বলে দিলাম। ঠিক হল নির্দিষ্ট দিন হোটেলের সামনে থেকেই মহিলা আমাদের তুলে নেবেন। নিজেদের এমন এচিভমেন্ট-এ আমরা খুশি হয়ে যখন ডিনার করব ভাবলাম তখন সাড়ে 10টা বেজে গেছে। দোকানপাট খোলা থাকলেও খাওয়া-দাওয়ার জায়গা বেশিরভাগই বন্ধ। আমরা bun, pastry, cup noodles কিনে হোটেল-এ ফিরলাম। ফিরে ম্যানেজার-এর সঙ্গে কথা বলে River Cruise বুক করলাম দুজনের জন্য।
River Cruise
Li River এর আশপাশ ঘুরে দেখতে আগে বিদেশিদের জন্য শুধুমাত্র Cruise-এর অপশন থাকলেও কয়েক বছর হল Bamboo Raft-এও বিদেশিরা Li River-এ ঘুরতে পারে। তবে দুটোর ক্ষেত্রে রুট, প্ল্যান এবং ভাড়া আলাদা। রিল্যাক্স করে ঝাড়া হাত পা হয়ে ঘুরতে চাইলে Cruise বাছাই ভালো। Raft শুনতে ইন্টারেস্টিং লাগলেও অনেক দায়িত্ব নিজেকে নিতে হয়। Cruise-এর রুট লম্বা, নদী পথেই সোজা Yangshuo পৌঁছনো যায়।
প্যাকেজে প্রথমে হোটেল এর কাছাকাছি কোনও পয়েন্ট থেকে বাসে করে নিয়ে যায় Zhujiang Wharf, সেখান থেকে ছাড়ে Cruise. Guilin শহর থেকে সেখানে যেতে সময় লাগে আধ ঘণ্টা। সকাল 9 টা থেকে 9.30 এর মধ্যে Cruise ছেড়ে দেয়। River Cruise এর ক্ষেত্রে ক্যাটাগরি অনুযায়ী 2 স্টার, 3 স্টার, 4 স্টার Cruise রয়েছে। Cruise-এই খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা, টয়লেট, এয়ার কন্ডিশনড বসার জায়গা সবই থাকে। Cruise Li River-এর ওপর দিয়ে চারপাশের সব পাহাড় দেখাতে দেখাতে নিয়ে যায় Yangshuo. সময় লাগে 4-5 ঘণ্টা। সেখানে Cruise থেকে নেমে Yangshuo ঘুরে দেখার জন্য সময় থাকে আরও 2-3 ঘণ্টা। তারপর Yangshuo-এ নির্দিষ্ট পয়েন্ট থেকে বাসে তুলে আবার স্থলপথে পৌঁছে দেওয়া হয় হোটেল। কেউ কেউ Yangshuo তে থেকে যান আবার অনেকেই ফিরে আসেন Guilin.
Bamboo Raft-এর রাস্তা কিছুটা আলাদা। বোট অবধি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের থাকলেও ফেরার দায়িত্ব নিজের। Yangdi নামক একটি জায়গা থেকে বোট ছাড়ে। একটি বোটে 4 জনের বসার জায়গা। বোট যায় Xingping অবধি। বোটে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা নেই। নদীর ধারে অনেক হোটেল রয়েছে, নেমে সেখানে নিজের খরচে খেয়ে নিতে হয়। বোট পুরো নদীর সেরা অংশগুলো দেখায় ঘণ্টা দেড়েক সময় নিয়ে। Xingping থেকে রাস্তা ধরে ইচ্ছেমতো চলে যাওয়া যায় Yangshuo বা Guilin.
সকাল সাড়ে 7 টা নাগাদ বাসে ওঠার টাইম মতো আমরা নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। বাস এসেছিল 8 টারও পর। গোটা চীন ভ্রমণে এটাই হচ্ছে আমাদের একমাত্র গাইডেড ট্যুর। বেশিরভাগই বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মানুষজন। এর আগে চীনে শুধুমাত্র চীনের মানুষদেরই গাইডেড ট্যুর দেখেছি ট্যুরিস্ট স্পটগুলোয়। এটা সেগুলোর থেকে খানিক আলাদা। বাসেই গাইড চাইনিজ ও ইংলিশ দু ভাষাতেই বলে দিচ্ছিল ট্যুর সম্পর্কে। Zhujiang Wharf পৌঁছনোর পর আমাদের হাতে Cruise টিকিট দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। গাইড-র সঙ্গে উঠে বসেছিলাম নির্ধারিত সিট-এ। ভাগ্যক্রমে জানালার ধারের সিট দুটোই পাওয়া গিয়েছিল। নিচের তলায় মুখোমুখি সোফায় বসার ব্যবস্থা, মাঝে টেবিল। একটা সোফায় 3 জন করে বসার সিট। উপরে ছোট একটা ঢাকা জায়গা বসার, বাকি অংশ খোলা দাঁড়িয়ে প্রকৃতির রূপ উপভোগ করার জন্য।
Cruise ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে টেবিলে চলে এল চা। খানিকক্ষণ জানলা দিয়ে পাহাড় দেখার পর চলে গেলাম উপরের ডেক-এ। সেখানে ততক্ষণে খানিক ভিড় হয়ে গেছে। রোদ বেশ চড়া, তবে ঠান্ডা হাওয়া বইছে মাঝে সাঝে। সবুজে ঢাকা থ্যাবরা পাহাড়গুলো গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে। প্রকৃতির খেলায় এই ক্রাস্ট মাউন্টেন গুলো নানান রূপ পেয়েছে নদীর বাঁকে বাঁকে। নানান পয়েন্টে বিশেষত্ব অনুযায়ী নাম দেওয়া হয়েছে। কোথাও পাহাড়ের গায়ে চাষের জমি, কোথাও আবার সবুজের আবরণহীন ন্যাড়া পাহাড়। একটা বাঁকে চোখে পড়ল প্রাকৃতিক নিয়মে গড়ে ওঠা লাইমস্টোনের গুহা। নদী বেশি গভীর না, জল স্বচ্ছ। কোথাও Guilin-এর ছবিতে দেখা ফিশারম্যান পাখি কাঁধে চলে যাচ্ছে নৌকা বেয়ে, কোথাও bamboo Raft-এ সওয়ারি। ডেকে চারপাশ দেখতে দেখতে আলাপ জমে উঠল অনেকের সঙ্গে। ব্রাজিল, স্পেন, রাশিয়া, ফ্রান্স, মেক্সিকো থেকে আসা মানুষের কাছে গল্প শুনলাম তাদের বেড়ানোর, তাদের দেশের।
চীনের 20 Yuan নোটে Guilin-এর ছবি আছে। পিছনে পাহাড়, সামনে নদীতে মাঝি নৌকা বাইছে। 20 Yuan পয়েন্ট-এ পৌঁছে হিড়িক পরে গেল নোটের সঙ্গে সামনে দেখা ছবি মেলানোর। লাঞ্চের সময় হয়ে নিচে গিয়ে সিট-এ বসে খাওয়া হল মিল। তারপর আবার ডেক। ফিশার ম্যান, সাদা পাখি, জলের ছলাৎছল, ক্রুজের আওয়াজ সব মিলে মিশে যেতে লাগল। প্রায় সাড়ে 4 ঘণ্টা নদীবক্ষে যাত্রা শেষে Cruise ভিড়ল Yangshuo-এর ঘাটে। নেমে খানিকটা হাঁটা পথ পেরিয়ে গেলেই স্কুটার, সাইকেলের স্ট্যান্ড, ইচ্ছেমতো ভাড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়া যায়। এছাড়াও ট্রেকার/টোটো ধরণের গাড়ি আছে। মাথাপিছু ভাড়া দিয়ে মূল শহরে বা কান্ট্রি সাইড ঘুরতে চলে যাওয়া যায়। Yangshuo ছোট্ট শহর, অল্প সময়েই ঘুরে ফেলা যায়। আমরা ডিপোজিট মানি জমা রেখে ইলেকট্রিক স্কুটার ভাড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম।
ছোট্ট শহর হলেও Yangshuo ভারি সুন্দর। শহরের মাঝেই যেখানে সেখানে গজিয়ে ওঠা পাহাড় বা বলা ভালো যেখানে যেখানে গজিয়ে ওঠা পাহাড়ের পাদদেশেই রাস্তা, হোটেল, দোকানপাট। গাছে নানা রঙের ফুল, ঝকঝকে রাস্তা ঘাট। নানা বয়সের লোকজন সাইকেল বা স্কুটার নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, দেখে মনে হচ্ছে এখানে সবাই খুব খুশি। আমরাও চললাম কান্ট্রি সাইড-এর দিকে। কোথাও মাউন্টেনিয়ারিং-এর পয়েন্ট, কোথাও গ্যাস এয়ার বেলুন, কোথাও পাহাড়ের নীচে থিম বার, নদীতে Bamboo Raft এ চড়ার ব্যবস্থা, মনোরঞ্জনের হাজার উপকরণ রাখা Yangshuo-তে। কিন্তু এ জায়গা এত সুন্দর রাস্তার ধারে বাঁধানো বেঞ্চে বসে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই প্রেম হয়ে যায়। আমাদের দুজনেরই খুব আফসোস হল Yangshuo তে না থেকে Guilin ফিরে যেতে হবে ভেবে। স্যুটকেস নিয়ে এলে নিশ্চিত থেকে যেতাম এমন সুন্দর মন ভালো করে দেওয়া শহরে।
আমাদের হাতে সময় বাঁধা। বসে থাকতে ইচ্ছে হলেও উপায় নেই। আমরা একইপথে আবার ফিরে চললাম স্কুটার জমা দিতে। সেখানে নদীর ধারে জেলের ছবি তুলবে অর্ক। তারপর বাস ধরার জন্য নির্দিষ্ট পয়েন্ট-এ যাওয়া। ছবি তুলতে খানিকটা সময় গেল। তখন বাসের সময় প্রায় হয়ে এসেছে। আমরা বাইক ট্যাক্সি চড়ে পৌঁছলাম নির্দিষ্ট স্থানে। সকালে বাস অনেক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখে দেরিতে এসেছিল। এদিকে ফেরার সময় নির্ধারিত সময়ের আগেই তা ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। আমাদের পৌঁছতেও খানিকটা দেরি হয়েছে। সেই অবস্থায় ফোন করে অনেক অনুরোধ করে বাসকে দাঁড় করিয়ে সেই পয়েন্ট-এ আবার পৌঁছেছিলাম বাইক ট্যাক্সিতে। বাস থেকে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে সারাদিনের ভালোলাগা আগলে ফিরলাম Guilin. হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম মার্কেট ঘুরে দেখতে। Yangshuo এর জন্য মন কেমন করতে লাগল বার বার। টুকটাক কেনাকাটা করে ডিনার সেরে ফিরে গেলাম রুমে। পরদিন আবার অন্ধকার থাকতে বেরোনো। ট্যাক্সি ড্রাইভার মহিলার সঙ্গে ফাইনাল কথা বলে নিলাম রাতে আবার।
Xianggong Mountain যাওয়ার জন্য মনের মধ্যে উত্তেজনা ছিল ভীষণ। সাড়ে ৩ টায় বেরোনো, বার বার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল। আগে থেকে কথা হয়ে গিয়েছিললেডি ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে। ৩ তে উঠে যখন তৈরি হচ্ছি সে হাজির হোটেল-এর সামনে। আমরা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই নেমে এসে উঠেপড়েছিলাম ট্যাক্সিতে। অন্ধকার রাস্তায় শুধু স্ট্রিট লাইটের আলো। ট্যাক্সি ছুতে চলেছে দ্রুত গতিতে। খুব থ্রিলিং ব্যাপার বিদেশ বিভূঁইয়ে এসে এমনএক্সপিডিশন। খানিকক্ষণ হাইওয়ে দিকে চলার পর ট্যাক্সি পাহাড়ি রাস্তা নিল। তখন অন্ধকারের পাকদন্ডী। চারপাশে কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না।আকাশ জুড়ে তারার মেলা। ছায়া ছায়া পাহাড় শরীর মাঝে মাঝে বুঝতে পেরেও পারছি না। কোথাও কোনও সাইনবোর্ড বা পথনির্দেশ কিছুই নেই।এমন নির্জনতায় একটুও যে ভয় করেনি এমন না, কিন্তু মজাও লেগেছে সমান তালে। অবশেষে বাঁকের পর বাঁক ঘুরে ঘুরে আমরা পৌঁছলামপাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা একটি টিকিট কাউন্টারের সামনে। লোকজন তেমন নেই, রাস্তা না জানা থাকলে ড্রাইভার ভুল কর এ জায়গা মিসকরে যেতেই পারে। তখনও আলো ফুটতে দেরি। আমরা নেমে কাউন্টারে গিয়ে দেখলাম আছে একজন লোক বসে। আর একজন এন্ট্রি গেট-এরকাছে দাঁড়িয়ে। আমরা ছাড়াও আরো এক দুজন এসেছেন বড় ক্যামেরা হাতে। টিকিট মাথাপিছু ৬০০ টাকা করে (ভারতীয় টাকায়)। গেট দিয়ে ঢুকেঅনেকগুলো খাড়াই সিঁড়ি ভেঙে উপরে ভিউ পয়েন্ট-এ যেতে হয়। পাহাড়কেটে বানানো সিঁড়ি বেয়ে টর্চ হাতে হাঁফাতে হাঁফাতে পৌঁছে গিয়েছিলাম ওপরে।
তখন অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে। সামনেই Xianggong Hill দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে। আকাশ জুড়ে অজস্র তারা। অন্ধকারে নির্নিমেষ চেয়ে থাকার সুখ উপভোগ করছি তখন প্রাণ ভরে। রাত্রি যে এত সুন্দর তা এর আগে কবে দেখেছি মনে পরে না। আস্তে আস্তে লোক বাড়ছে তখন। ভিউপয়েন্টধরে লাইন দিয়ে জড়ো হচ্ছে ট্রাইপড। ফটোগ্রাফি ট্যুর-এর গ্রুপ, সিঙ্গল ফটোগ্রাফার থেকে ফ্যামিলি সবই হাজির। সূর্য উঠবে ৬ টায়। আমরাওসামনের দিকে জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছি ততক্ষণে। শুধু তাকিয়ে থাকতেই বেশ লাগছে। মেঘের রং বদলানো শুরু হল সাড়ে ৫ টা থেকেই। নীলথেকে হলদেটে হয়ে কমলার রেখা। পলক পড়লেই তখন দৃশ্য পাল্টাচ্ছে। পর পর লেয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়গুলো ফুটে উঠছে চোখের সামনে। এদৃশ্য চোখে দেখার, লিখে এ সৌন্দর্য ব্যক্ত করা যায় না। ক্রমে কমলা রেখা সরে গিয়ে বেরিয়ে পড়ল সূর্য। লাল রঙের গোল থেকে এল ঠিকরে পড়লপাহাড়ের গায়ে। মেঘ নেমে এল সারি সারি পাহাড়ের ফাঁক বেয়ে। নিচের জলে আলো চিক চিক করে উঠল। মাঝিরা বেরিয়ে পড়ল মোটর বোট নিয়ে। মেঘগুলো তৈরি করল এক অভাবনীয় দৃশ্য। জীবনের শ্রেষ্ঠ সূর্যোদয়ের সাক্ষী হলাম আমরা।
প্রকৃতির খেলা দেখতে দেখতে খেয়ালই হয়নি কখন ৮ টা বেজে গেছে। আমাদের Gulin ফিরে সেখান থেকে বুলেট ট্রেন স্টেশনে যাওয়ার কথা। এমনসুন্দর দৃশ্য ছেড়ে আসতে ইচ্ছে না করলেও সিঁড়ি বেয়ে নামতে হল। আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে নামতে নামতে রাতে দেখতে না পাওয়া পাহাড়গুলোর দেখাপেলাম। ঘণ্টাদেড়েক লাগল হোটেল ফিরতে। আমাদের লেডি ড্রাইভারকে একবার বলতেই সে জানালো স্টেশনে ছেড়ে দেবে। ১২ টার সময় হোটেলেচলে আসবে নিতে এমনটাই ঠিক হল। ভিনদেশে এমন সুহৃদয় মানুষের দেখা পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। এর আগে যেখানে যেখানে থেকেছিহোটেল-এর ম্যানেজার/মালিকের থেকে যারপরনাই সাহায্য পেয়েছি, কিন্তু Guilin আলাদা। এখানে লোক ঠকানোটা খানিক সহজাত বলেই মনেহয়েছিল ট্রেন থেকে নামার পর ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের ট্যাক্সি ড্রাইভার বা হোটেল ম্যানেজার টনি-র ফন্দি-ফিকিরে। সে জায়গায় পথচলতি খুঁজে পাওয়াএকজন সৎ অতিথি বৎসল চীনা মহিলাকে আমার মনে থাকবে বহুকাল। আমরা ট্যাক্সি থেকে নেমে হোটেলের সামনেই লোকাল দোকান থেকেমোমো, বাও খেয়ে রুমে ফিরলাম। ফ্রেশ হয়ে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে চললাম Guilin West স্টেশন। এখানেও আগের মতোই বিকেলের ট্রেনেরটিকিট এগিয়ে নেওয়া গেল দুপুরে। শেষ হল আমাদের Guilin সফর, বুলেট গতিতে ট্রেন ছুটল Kunming-এর উদ্দেশে।
টুক-টাক তথ্য
যাতায়াত-
Guilin চীনের বড় শহরগুলি থেকে হাইস্পিড ট্রেন, ফ্লাইট, দূরপাল্লার বাসে যাওয়া যায়।
শহরের মধ্যে ঘোরার জন্য বাস, ট্যাক্সি, বাইসাইকেল, স্কুটার রয়েছে।
হোটেল-
অনেক হোটেল আছে Guilin ডাউনটাউন, Yangshuo তে।
সব রকম সুযোগ-সুবিধা-সহ হোটেল-এ ডাবল বেড রুম-এর ভাড়া ১৩০-১৪০ Yuan থেকে শুরু
Booking.com / Agoda / Trip.com
খাওয়া-দাওয়া-
Guilin-এর রাইস নুড্ল খুব বিখ্যাত। অনেক ছোট বড় রেস্টুরেন্ট আছে। তবে রাতে তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যায় বেশিরভাগ জায়গা।
এছাড়া Burger King, Mac ডোনাল্ড এসব আছেই।
Yangshuo Via Li River
River Cruise-এর ভাড়া মাথাপিছু ৪০০ Yuan
Bamboo Raft-এর ভাড়া মাথাপিছু ২৫০ Yuan
ইলেকট্রিক স্কুটার রেন্ট ঘণ্টা হিসেবে। ৩-৫ ঘণ্টার জন্য ৫০ Yuan. ডিপোজিট হিসেবে জমা রাখতে হয় ৫০ Yuan.
Xianggong Hill
Guilin থেকে ট্যাক্সি নিয়ে যাতায়াত-সহ ৩০০-৪০০ Yuan (হোটেল-এর ওপর ভরসা না করে নিজে রাস্তায় নেমে দরদাম করে নেওয়া ভাল)
এন্ট্রি টিকিট- ৬০ Yuan/মাথাপিছু
চীন ভ্রমণের প্রথমাংশ জানার জন্য click করুন এখানে।
চীন ভ্রমণের দ্বিতীয়াংশ জানার জন্য click করুন এখানে।
চীন ভ্রমণের চতুর্থাংশ জানার জন্য click করুন এখানে।
Follow me on Facebook & Instagram.