প্রচন্ড গরমের বৈশাখ মাস টা ছোট থেকেই প্রিয় ছিল দুটো কারণে, এক পয়লা বৈশাখে নতুন জামা পরে দোকানে দোকানে হালখাতার নেমন্তন্ন যাওয়ার সুখ আর দুই পড়াশোনায় খানিক ছাড় পেয়ে ২৫ শে বৈশাখ-এর রিহার্সাল-এর সুযোগ। রবিঠাকুরের জন্মদিন মানে পুজোই ছিল আমাদের। সে পুজোর প্রস্তুতি নিয়ে গোটা পাড়া মাথা ঘামাতো। দিন 20 আগে থেকেই সকাল হোক বা বিকেল পাড়ার কচি-কাঁচাদের দায়িত্ব নিয়ে একটু বয়সে বড় কেউ বসে যেত। কে কি নাচবে, কি গাইবে, নাটকে কার পার্ট কি এসব ঠিক হওয়ার পর জমে উঠতো রিহার্সাল। ভুল-ভ্রান্তির চেয়ে বড় ছিল উৎসাহ। রোজ দু-তিন ঘণ্টা একদম আমার মুক্তি আলোয় আলোয়।
আমাদের গলির যে ফাংশনটা সেই স্টেজটা হতো আমাদের বাড়ির সামনে। ডেকোরেটর কাকু স্টেজ বেঁধে দিয়ে যাওয়ার পর কাকু-পিসিরা সুন্দর করে সাজাত। কাগজে রংতুলি দিয়ে লেখা হত রবীন্দ্রজয়ন্তী। চেয়ারে ছবি রেখে ধূপ, মালা। জুঁই ফুলের গন্ধে ম ম করত চারদিক। ভাড়া করা লাইট আসতো। রঙিন কাগজ পাল্টে পাল্টে নাচ আর নাটকের সময় আলো ফেলা দেখতে আমার দারুন লাগতো। 25 সে বৈশাখ সকাল থেকে সাজ সাজ রব পরে যেত বাড়িতে। সেদিন হিন্দি গান গাইলে পাপ হয় জানতাম। বাবা রেডিও চালাত। রবি ঠাকুরের ছবিতে মালা দিয়ে প্রণাম করার সময় আমি প্রতি বার বলতাম, এ সপ্তায় তোমার জন্মদিন, পরের সপ্তাহে আমার। তখন ওটা বলার সময় বিশ্বাস করতাম উনি বুঝি শুনছেন, এখন মনে মনে হাসি। মায়ের ব্লাউজ সেলাই করে আমার মাপের বানানো, ফিতে দিয়ে মাথার ফুল তৈরি, হলুদ শাড়ি, লাল-পাড় সাদা শাড়ি ইস্তিরি করা সেসব শুরু হয়ে যেত সকাল সকাল। এমনকি পাশের বাড়ির দিদা বা কাকিমার শাড়ি তখন নিজ অধিকারে পরে নেওয়া যেত। মনে পড়ে 25 সে বৈশাখে বৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকলে আমরা কেউ একজন পাশেই এক বন্ধুর বাগানে লুকিয়ে বাটি উপুর করে পুঁতে দিয়ে আসতাম। এমন করলে নাকি বৃষ্টি আটকে থাকে, এটা তুক ছিল কারও থেকে শোনা। একবার বাটি পুঁতে বৃষ্টি না হওয়ায় খুব বিশ্বাস হয়েছিল, কিন্তু পরে একবার বৃষ্টিই সে বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে।
আমি ছোট থেকেই নাচ শিখতাম। নাচের স্কুলের ফাংশনের চেয়ে পাড়ার ফাংশনে আকর্ষণ ছিল বেশি। কারণ পাড়ায় ভুল হলে কেউ বকতো না, আর পাত্তা পেতাম বেশি। একটা কবিতা আর একাঙ্ক নৃত্য আমার বাধা ছিল। একাঙ্ক নৃত্যের সবচেয়ে সুবিধে ছিল ভুলচুক হলে দর্শকরা খুব একটা বুঝতে পারতো না! মনে পড়ে সঞ্চয়িতা খুলে বাবার সঙ্গে বসে আগে থেকেই ঠিক হয়ে যেত কোন কবিতাটা আমি বলব। কোনও দিনই খুব বড় কবিতা মনে রাখতে পারিনি, এদিকে দেখে দেখে পড়লে একদম চলবে না, তাই ‘সাধারণ মেয়ে’ বা ‘আমি’ যতবারই শখ হোক জনসমক্ষে বলে ওঠা হয়নি। আর ওই দর্শকের দিকে তাকিয়ে কবিতা বলার সময় আমার যে কী ভীষণ ভয় করত তা বলার না। হাত-পা কাঁপত। চাকরি জীবনেও বড় ক্লায়েন্ট প্রেসেন্টেশন-এর আগে ওই কাঁপুনিটা হয়, দেখতে পাই আমি স্টেজ-এ দাঁড়িয়ে আর শ’য়ে শ’য়ে জুলুজুলু চোখ আমায় দেখছে। বাড়িতে যেটা ঝরঝর করে বলতে পারতাম স্টেজে উঠলেই মনে হত ভুলে যাব। অনেকের মতোই আমার স্টেজে উঠে প্রথম বলা কবিতা ছিল ‘প্রশ্ন’। ‘মাগো আমায় ছুটি দিতে বল’ না, ‘ভগবান তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছো’, আমার সব সময়ই দ্বিতীয় প্রশ্নটাই বেশি প্রিয় ছিল। একবার ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ বলার সময় মাঝের দুটো লাইন স্কিপ করে গিয়েছিলাম। বাবার সেই কটমট করে তাকানো এখনো মনে আছে।
আমাদের বাড়িতে নাটকে অভিনয়ের চল ছিল বাবা-কাকুদের মধ্যে। গলির ফাংশনে কোনো না কোনো শ্রুতি নাটক হত, বড় নাটক নামানোর মতো স্টেজ ছিল না। পাড়াতেই বাবাদের নাটকের দল। কোনও কোনও রবীন্দ্রজয়ন্তীতে পাড়ার ক্লাব থেকে অনুষ্ঠান হলে বাবা-রা নাটক করতো। খুব মনে পড়ে বাবা আর ছোটকাকুর ‘দুই-বিঘা-জমি’। ছোট কাকু উপেনের চরিত্র করতো। যত বার বাবা ছোটকাকুকে বলতো ‘বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়’, ততবার চোখ ভিজে যেত। জানতাম অভিনয়, তাও খুব কষ্ট হত উপেনের জন্য, আর বাবার ওপর রাগ হত।
আমাদের কৈশোর পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে এইসব দিনগুলো হারিয়ে যেতে লাগল আচমকাই। যে সব পিসিরা উদ্যোগ নিত তাদের বিয়ে হয়ে গেল। আমরা যারা বড় হওয়ার পরও অনুষ্ঠান চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম, তবে দল পেলাম না। সব ছোটদেরই নাচের স্কুলে, গানের স্কুলে অনুষ্ঠান। সেখানে ব্যস্ততা। আবার পাড়ায় অংশ নিলে পড়ার ক্ষতি। আমাদেরও তখন পড়ার চাপ, কলেজের ক্লাস, সেসব করে পাড়া কালচারগুলো হারিয়ে ফেললাম। প্রথম প্রথম বাড়ির সামনে স্টেজটা নেই দেখে কষ্ট হত। তারপর সয়ে গেল। তখন ছবিতে মালা দেওয়া, সঞ্চয়িতা বা গীতাঞ্জলির পাতা ওল্টানো আর বাড়ির কম্পিউটারে রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনায় সীমাবদ্ধ হল ঠাকুরের জন্মদিন। চাকরি করার সুবাদে ছুটিও গেল। কাজের চাপে রবীন্দ্রনাথ শ্রদ্ধার্ঘ্য-এর ডিজিটাল পোস্ট হয়ে গেলেন। তবু এই দিনটায় স্মৃতিগুলো খুব ফিরে ফিরে আসে। দুটো কবিতা আওড়াতে ভালো লাগে। বেসুরো গলায় কোরাসে ‘হে নূতন’ গাইতে আজও ইচ্ছে করে। যতই গৃহবন্দি থাকি, হতাশায় থাকি, ওই ভালোলাগাগুলোই এই দিনটার পাওনা, বাকিটা তো “আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে, তাই হেরি তায় সকল খানে”।