রং আমার চিরকালই ক্যানভাসে ভালো লাগে, নিজের গায়ে নয়। ছোটবেলা থেকেই দোলের দিন লুকিয়ে থাকা আমার স্বভাব ছিল। সে যতই ‛আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া’-য় খড় পুতুলের মুন্ডু অব্দি আগুন উঠে গেলে ‘হরি বোল হরি বোল’ বলে লাফাই না কেন। সবাই জানত পরদিন সকালে আমার নো পাত্তা! আমার পাড়াতুত বন্ধুরা দু-তিন বার এসে কোনো আশা না দেখে চলে যেত প্রতিবার। আমি জন্ম থেকে জীবনের 25 টা বসন্ত শ্রীরামপুরে কাটিয়েছি, একটা শান্তিনিকেতনে, আর বিয়ের পর কলকাতাতেই। ছোট থেকে বড় হওয়ার বছরগুলোতে দোলের বদলে যাওয়া দেখেছি ক্রমশ, সঙ্গে সঙ্গে মানুষেরও।
মনে পড়ে দোলের দিন মায়েদের সকাল থেকে রান্নার তাড়া থাকতো। কারণ, কে কখন রং মাখাতে এসে যাবে! আমাদের খোলা বাড়িতে কলিং বেল না বাজিয়েই রান্নাঘরে ঢুকে রং মাখিয়ে দেওয়া যেত। এইসব দল-বল আসার সময়টায় আমি সন্ত্রস্ত হয়ে দোতলার ঘরে দরজায় ছিটকিনি দিতাম। আমার কাকিমণি রং খেলতে খুব ভালোবাসতো। সকাল সকাল কাজ সেরে ভেসলিন বা বডি অয়েল লাগিয়ে নিত। যাতে রং গায়ে বসে না যায়। আমি দেখাদেখি ভেসলিন মাখতাম কিন্তু রং না! আমার মেজ বোন হওয়ার পর পরিস্থিতি কিঞ্চিৎ বদলেছিল বার কয়েক। মেয়ে টা ছোট্ট থেকেই রং খেলার ওস্তাদ। আমি খালি ভাবতাম আমার বোন হয়ে ও কেন এমন অন্যদের মতো! পারলে অচেনা লোকের সঙ্গেও দোল খেলে আসে। ও আমার লুকিয়ে থাকাকে দু-একবার যে জব্দ করেনি তা না। তবে বাঁদুরে রং আমি কোনওদিনই মাখিনি। একবার মনে আছে নিজে রং না মাখলেও খুব রং ভরা বেলুন ছুঁড়েছিলাম দাদামণির পাল্লায় পড়ে!
আমাদের ছোটবেলায় গোটা পাড়াটাই পরিবারের মতো ছিল। বারান্দা থেকে দেখতাম পাড়ার সবাই কেমন কথা বন্ধ, মুখ দেখা-দেখি নেই এসব ভুলে গিয়ে রং খেলছে, কেউ না বেরোলে হিড় হিড় করে নিয়ে আসছে, বালতি বালতি গোলা রং ঢালা দেখে আমি চমকে চমকে উঠতাম। সেই হুল্লোড় চলতো কয়েক ঘণ্টা ধরে! বাবা-কাকুদের একটা নাটকের দল আছে। সেই দলের অনেকেই কালো-সবুজ-সোনালী হয়ে হানা দিত আমাদের বাড়িতে। ছোট কাকু ভূত হয়ে বাড়ি ঢুকতো। গায়ে মুখ ঘষে দেওয়ার ভয় দেখাত। দুপুর গড়ালে কলতলাতে, বাড়ির ছাদে হা-হা-হি-হি করে রং ওঠানোর পর্ব চলত ঘরে ঘরে। তারপর বেগুনি, গোলাপি হয়ে যাওয়া রাস্তা, ইলেক্ট্রিকের তারে ঝুলতে থাকা জামা প্যান্ট, অনেক সাবান ঘষেও রঙিন থাকা হাতের তালু, কানের লতি, পাড়ার মেনি-নেড়িগুলোর গায়ে লেগে থাকা রংগুলো উৎসবের ইতিহাস লিখতো।
যখন ছোট ছিলাম আমাদের পাড়ায় একটা দারুন ট্র্যাডিশন ছিল। দিনের বেলাতেই রং খেলা শেষ হয়ে যেত না, বিকেল হলে ফাগের রঙে রঙিন হওয়া ছিল রেওয়াজ। সে নেশা ছিল ছোটদেরই বেশি। এ দলে আমার নাম ছিল। আবির-এ আমার কোনও না নেই। 4 টে বাজতে না বাজতেই বেরিয়ে পড়া হত। তখন তো ফোন ছিল না, প্যাকেট হাতে অপেক্ষা ছিল আর বাড়ি গিয়ে গিয়ে ডেকে আনা। তারপর অলি-গলি হয়ে বড়দের দেখে পায়ে আবির দিয়ে প্রণাম, ছোটদের দুপুরের কসরত করে তোলা রঙের ওপর আবার রং চাপানোর আনন্দ। আকাশ রঙিন করে সন্ধে নামাতাম আমরা। আলো চলে গেলে মাথাময় আবির নিয়ে ঘরে ঢুকতাম। রাতে শ্যাম্পু করায় কড়া না ছিল, সেই আবির উঠতো পরদিন সকালে। ফুটকড়াই, কে কোন মঠ টা খাবে তাই নিয়ে খুনসুটি, বাবার আনা জিলিপি আর পাঁপড় ভাজা দিয়ে সন্ধের আড্ডা বসত।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব ট্র্যাডিশন কোথায়, কবে হারিয়ে গেল মনে পড়ে না। আসতে আসতে গলিটা রঙিন হওয়া কমে এল, লোকজন মুঠো রং নিয়ে বাড়িতে আসা ছেড়ে দিল, বাড়ির ছেলে গুলোও কেমন বন্ধুদের নিয়ে পাড়া বেড়ানো বন্ধ করে দিল। মা-কাকিমার উৎসাহেও ভাঁটা পড়ল। শুধু সকালে বাড়ি থেকে বেরোলো উৎসাহী বাচ্চাদের পিচকারির জলরং টুকুই পরে রইল পাড়া ঘরে। আমাদের বিকেলের আবিরও হারিয়ে গেল, প্রতিবার জনসংখ্যায় কমতে কমতে। বাড়িতে নিজেদের মধ্যে সেই উৎসব বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা কয়েকবার হলেও, জমল না।
যেবার শান্তিনিকেতন গেলাম দোল-এ, বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎসবে অন্যরম বসন্ত কাটালাম। অচেনাদের সঙ্গে রং মাখা সেই প্রথম। আবির ছাড়া অন্য রঙের এন্ট্রি না থাকলেও ফেরার পথে অটোতে রাস্তা থেকে দুস্টু বাচ্চাদের ছোঁড়া রঙ বদলে যেতে থাকা শান্তিনিকেতনের ছবিও দেখিয়ে দিল। রবীন্দ্রভারতী-তে মাস্টার্স করাকালীন দোল সত্যি সত্যিই উৎসবের মতো এসেছিল জীবনে। ক্যাম্পাসে আবির ওড়ানোর পাশাপাশি জোড়াসাঁকোর বসন্ত উৎসবে আমাদের পড়ুয়াদের ছিল অবাধ আধিপত্য। হলুদ শাড়ি, শান্তিনিকেতনী গয়নায় সেজে হাজির হয়ে যেতাম সদলবলে। সেই নাচ-গান-আবির ভরা বিকেলটা রঙিন করে দিত মনটা। এখন বসন্ত উৎসবের হুজুগ বেড়েছে, মোড়ে মোড়ে উৎসব দোলের এক হপ্তা আগে থেকেই। সে হুজুগে গা ভাসাবার ইচ্ছে হয় না আর।
বিয়ের পর একবারই রং খেলেছি। ভাগ্যক্রমে কানাডাবাসী প্রিয় বন্ধুরা তখন এখানে ছিল। যদিও রং মাখার চেয়ে একসঙ্গে রান্না করা, জমিয়ে খাওয়ার আনন্দ ছিল অনেক বেশি। তবু ছাদ রঙিন, বাথরুম গোলাপি হয়েছে সেই একবারই। এখন জীবনে দোল আসে ছুটির আগের দিনে অফিসে ঠান্ডাই, মিষ্টিমুখে। আর সারাদিনে সব থেকে বেশি সময় একসঙ্গে কাটানো মানুষগুলোকে একটু আবিরে রাঙিয়ে দিয়ে, হ্যাপি হোলি-র উল্লাসে। বন্ধুবান্ধবরা সব ছিটকে আছে এ দেশ, ও দেশ-এ। এখনও বাড়িতে লুকিয়েই থাকি। পাড়ার উৎসাহী বাচ্চাদের আওয়াজ কানে আসে মাঝে মাঝে। বাড়ির বারান্দা থেকে দেখা টা ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুকে ভারচুয়াল রং খেলা দেখায় বদলে গেছে। তবে ছুটি টা, ল্যাদ টা, দূরে মাইক থেকে ভেসে আসা ‘রাঙ্গ বরসে’ টা, দুপুর গড়িয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এদিক-সেদিক পড়ে থাকা আবিরের রং-টা মনটাকে আজও রঙিন রাখে বইকি!
আরো কিছু লেখা:
চীন ভ্রমণের প্রথমাংশ জানার জন্য click করুন এখানে।
চীন ভ্রমণের দ্বিতীয়াংশ জানার জন্য click করুন এখানে।
চীন ভ্রমণের তৃতীয়াংশ জানার জন্য click করুন এখানে।
চীন ভ্রমণের চতুর্থাংশ জানার জন্য click করুন এখানে।
Follow me on Facebook & Instagram.