প্রথম দেশের বাইরে বেড়াতে যাওয়া তাও আবার চীন, শুনেই অনেকে নাক সিঁটকেছিল। শুধু তাই না ফিরে এসে ছবি দেওয়ার পরও লোকজন জিগেস করছে “হোয়াই চায়না?” তা তাদের আশঙ্কা বা অপছন্দের ইঞ্জিতকে আমি হেলায় উড়িয়ে দিতে পারি না কারণ আমার নিজেরও যে খানিক কিন্তু কিন্তু ছিল না তা নয়! প্রথমবার বলেই হয়তো আরও বেশি। তবে যাওয়ার পর 1.43 বিলিয়ন জনসংখ্যার ওই দেশটি আমায় অবাক করেছে প্রতি মুহূর্তে। সৌন্দর্যে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায়, পাবলিক রিলেশন-এ, সত্যিকার জনকল্যাণে এ দেশের নিয়মনীতি যে বলে বলে গোল দিতে পারে অনেক দেশকেই, তা বলাই বাহুল্য।
সে যাই হোক, চীন দেশ যাব যখন ঠিক করলাম তখন খাতা পেন নিয়ে বসতেই হল ইন্টারনেট-এর জানলা খুলে। আমরা ট্যুর অপারেটর-এর সঙ্গে বেড়াতে যেতে চাইনা বলেই ভালো করে রিসার্চ, গাইডেন্স এবং পড়াশোনার প্রয়োজন ছিল। ভারতবাসী যে চীন বলতে গেলে যায়ই না তা টের পেলাম বেশ। ইউটিউব ও কিছু ব্লগের কল্যাণে যে সব জায়গা খুঁজে পেলাম তার সব তো একসঙ্গে দেখা সম্ভব না। এদিকে Beijing-Xian-Sanghai -এর ট্রাইএঙ্গেল ট্রিপ-এর ফিরিস্তিই চারদিকে ভর্তি। কিন্তু আমার সেদিকে মন নেই। বেজিং যাব, গ্রেট ওয়াল-এ হাঁটব, এমনটা ভাবলেও আমার ইচ্ছে চায়নার দুর্দান্ত সব পাহাড়ি জায়গাগুলোয় ঘোরা। Avatar Mountain, Rainbow mountain, Yangshuo এর ছবি দেখে দেখে ততদিনে রক্ত টগবগ। অবশেষে এক সুহৃদয় বন্ধুর চীন বেড়ানোর গল্প পড়ে মনে একটু বল পেলাম। তার হাতে দিনসংখ্যা ছিল বেশি কিন্তু আমায় 10-12 দিনে ব্যাপারটা সারতে হবে দেখে নিজের মতো সাজিয়ে গুছিয়ে নিলাম প্ল্যান। Sanghai বা Xian এর চেয়ে Zhangjiajie এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর Gulin এর পাহাড়, নদী, মাঝির ছবি মন টানল বেশি। Rainbow Mountain দেখার সাধ থাকলেও সময়ের অভাবে ট্রিপ-এ গুঁজে দেওয়া গেল না সে জায়গা। ঠিক হল Beijing যাব প্রথমে। তারপর সেখান থেকে Hunan province-এ Zhangjiajie, তারপর Guangxi Province-এ Guilin হয়ে Yunan Province-এ Kunming হয়ে ফেরা। এই ট্যুরটা সহজেই Kunming দিয়েও শুরু করা যেত। কিন্তু অর্কর আমার আগে যাওয়া এবং ওর Dalian হয়ে Beijing আসা সুবিধেজনক বলে আমরা প্ল্যানটা সেভাবে সাজিয়ে নিয়েছিলাম। তারপর ফ্লাইটের টিকিট Makemytrip, Yatra, WeGo বা সরাসরি এয়ারলাইন-এর ওয়েবসাইট থেকে কেটে নেওয়া নিজেদের সুবিধেমতো।
প্ল্যান হওয়ার পর প্রথমেই আসে ভিসার চিন্তা। কলকাতায় চীনের ভিসা অফিস সেক্টর ফাইভ-এ Omega Building-এ। চীনের ভিসার জন্য ফ্লাইটের রাউন্ড ট্রিপ-এর টিকিট, কোথায় কোথায় যাচ্ছি, কোনদিন কোন হোটেল-এ থাকছি তার ডিটেল তথ্য জমা দিতে হয় পাসপোর্ট-এর সঙ্গে। সঙ্গে লাগে নির্দিষ্ট মাপের ছবি, ব্যাঙ্ক আকাউন্ট-এ অন্তত এক লক্ষ টাকা থাকার প্রামাণ্য নথি। যাওয়ার মোট দিনসংখ্যা, যাওয়ার উদ্দেশ্য এবং কত টাকা ব্যাঙ্ক-এ আছে তা ভিসা অফিসারকে উদ্দেশ্য করে একটি চিঠিতেও জানাতে হয়। এসব তথ্য সহজেই ইন্টারনেট-এ পাওয়া যাবে এবং Visa Application Form ডাউনলোড করে ফিল আপ করে নিয়ে গিয়ে জমা দেওয়া যাবে। ভিসা অফিসে এপ্লিকেশন জমা দেওয়ার 7-10 ওয়ার্কিং ডেজ এর মধ্যে ভিসা পাওয়া যায় সব ঠিকঠাক থাকলে। টাকা জমা করতে হবে Visa আনতে যাওয়ার সময়। খরচ মাথাপিছু 5552 টাকা। টুরিস্ট ভিসা সাধারণত 3 মাসের জন্য ভ্যালিড থাকে। ভিসা পাওয়ার পর প্ল্যান-এ অদল-বদল করা যেতেই পারে, তাতে কোনও সমস্যা হবে না।
আগেই বলেছি আমি প্রথমে Beijing গিয়েছিলাম। কলকাতা থেকে Kunming, তারপর Kunming থেকে Beijing-এর কানেকটিং ফ্লাইট। Kunming-এ পৌঁছেই ইমিগ্রেশন হয়ে গিয়েছিল। ফ্লাইটেই এয়ার হোস্টেস প্রয়োজনীয় ফর্ম দিয়ে দিয়েছিলেন। না দিলেও সবাই যে পথে যাচ্ছে সেদিকে গিয়ে ফর্ম-এর কাউন্টার সহজেই ফর্ম পাওয়া যায়। এয়ারপোর্ট-এ ইংরেজিতে মার্কিং ও ইন্সট্রাকশন থাকবে। ইমিগ্রেশন হয়ে যাওয়ার পর মোবাইল কানেকশন নিয়ে নিতে পারলে ভালো, 7 দিন, 15 দিন, 1 মাস বা তার বেশি দিনের হিসেবে China Mobile এর কানেকশন পাওয়া যায়। এয়ারপোর্টে না নিলে বাইরেও কানেকশন নেওয়া যাবে। আমার কানেকটিং ফ্লাইট থাকায় আমি বেজিং পৌঁছে সেখান থেকে SIM নিয়েছিলাম।
চীনে কমিউনিকেশন একটা বড় সমস্যা কারণ বেশিরভাগ মানুষই চাইনিজ ছাড়া অন্য ভাষা বোঝেন না এবং বলেন না। Translation App ডাউনলোড করে যাওয়া প্রয়োজন। আমরা Google Translator-এ অফলাইন-এ চাইনিজ language ডাউনলোড করে নিয়েছিলাম। Google ও দেশে Banned. তবে অফলাইনে ট্রান্সলেটর ভালো কাজ করে। Google Map একেবারেই চলে না। চীনের নিজস্ব Map App ‘Baidu’, কিন্তু তা সব ফোনে সাপোর্ট করে না। লেখাও চাইনিজ-এ, তাই নেভিগেশন মুশকিল। WeChat এর মাধ্যমে কথা বলা সুবিধেজনক। তবে লোকজন হেল্পফুল। যথাসাধ্য সাহায্য করার চেষ্টাটা আছে। বেশকিছু সুহৃদয় মানুষ আমাদের বিভিন্ন সময় নানাভাবে সাহায্য করেছেন গোটা ট্রিপ-এ।
ওখানে যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই উন্নত। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ফ্লাইট ফেয়ার বেশি হলেও হাইস্পিড ট্রেন বা ওভারনাইট এক্সপ্রেস ট্রেন সাধ্যের মধ্যে ও কনভিনিয়েন্ট। আমরা এক প্রভিন্স থেকে অন্য প্রভিন্স ট্রেন-এই গিয়েছি। বুলেট ট্রেন-এ চড়ার অভিজ্ঞতা সত্যিই মনে রাখার মতো। ওখানে ট্রেন-এর স্পিড অনুযায়ী ক্যাটাগরি ভাগ করা আছে। China Travel Guide বা China DIY travel-এর ব্লগ ও ইউটিউব ভিডিও-তে এ ব্যাপারে যাবতীয় তথ্য পাওয়া যাবে। ট্রেন-এর টিকিট এখান থেকেই কেটে গিয়েছি। Trip.com বা ChinaDIY এর ওয়েবসাইট থেকে টিকিট কাটা যাবে। trip.com -এ ক্রেডিট কার্ড দিয়েই পেমেন্ট করা যাবে। PayPal একাউন্ট থাকলে ChinaDIY এ payment করতেও কোনও অসুবিধে হবে না। বড় শহরগুলোতে মেট্রো যোগাযোগ খুবই উন্নত। বেজিং-এ আমরা সাবওয়ে ব্যবহার করেই সমস্ত জায়গা সহজেই ঘুরতে পেরেছি। মেট্রোর ইংরেজি App-ও রয়েছে, Metro Man. অন্যান্য জায়গাতেও এয়ারপোর্ট, রেল স্টেশন, বাস স্টেশন-এর সঙ্গে মেট্রো যোগাযোগ খুবই উন্নত। ট্যাক্সি, বাস সবই সহজলভ্য। চাইলে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করেই দেশটা ঘুরে ফেলা যায়।
সব জায়গায় হোটেল বুকিং আমরা এ দেশ থেকেই করে গেছি। Booking.com থেকে বুকিং করলে বেশিরভাগ হোটেল-এর ক্ষেত্রেই গিয়ে পেমেন্ট করার অপশন থাকে। Agoda-তেও হোটেল-এর ভালো deal পাওয়া যাবে, সেক্ষেত্রে ক্রেডিট কার্ড-এ রিফান্ডেবল বুকিং-এর অপশন আছে। যাওয়ার সময় সঙ্গে অবশ্যই কিছু টাকা RMB-তে কনভার্ট করে নিয়ে যাওয়া উচিত। ওখানে ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিট কার্ড-এ পেমেন্ট-এর অপশন হোটেল বা কিছু টিকিট কাউন্টারে থাকলেও সব জায়গায় সব সময় সে সুবিধে পাওয়া যাবে না।
চীনে ঘুরে বেড়ানো, জায়গার বিবরণ, খাওয়া-দাওয়া, রাস্তাঘাট, মানুষজনের গল্প আরও ডিটেল-এ করব আলাদা করে জায়গাগুলোর বর্ণনা দেওয়ার সময়। এই লেখায় থাকল সাধারণ প্রয়োজনীয় বিষয় ও খরচাপাতি সংক্রান্ত তথ্য।
খুঁটিনাটি তথ্য:
India-China Flight Fare
Multicity round Trip মাথাপিছু (Kolkata-Beijing via Kunming, Kunming-Kolkata) ₹25000
(Kolkata-Kunming round trip করলে ফ্লাইট ফেয়ার 15-16 হাজার মতো)
Train-এর ভাড়া দূরত্বের হিসেবে মাথাপিছু 2-5 হাজারের মধ্যে
Metro- মোটামুটি সব জায়গাতেই Minimum Fare 3RMB, দূরত্ব অনুযায়ী দাম বাড়বে
Beijing Transportation Smart Card- 20 RMB deposit, চারদিন ঘোরার জন্য 50 RMB রিচার্জ যথেষ্ট। ফেরার সময় এয়ারপোর্ট বা নির্দিষ্ট কিছু স্টেশনে Card জমা করে Deposit ও Balance টাকা ফেরত পাওয়া যায়। এই কার্ড দেখিয়ে বাসের টিকিটেও ডিসকাউন্ট পাওয়া যায়।
Taxi- ট্যাক্সির Base Fare জায়গা ভেদে 9-10 RMB. তারপর কিলোমিটার হিসেবে ভাড়া ওঠে।
থাকা-খাওয়ার খরচ ভারতের মতোই।
আরো কিছু লেখা:
চীন ভ্রমণের প্রথমাংশ জানার জন্য click করুন এখানে।
চীন ভ্রমণের দ্বিতীয়াংশ জানার জন্য click করুন এখানে।
চীন ভ্রমণের তৃতীয়াংশ জানার জন্য click করুন এখানে।