চিকমাগালুর- কফির রাজ্যে লং ড্রাইভ
ব্যাঙ্গালোর-এ সকলেরই মোটামুটি কাছের বন্ধু-বান্ধব, পরিবারের বা অন্তত দুঃসম্পর্কের কেউ না কেউ থাকে। আমাদের আবার সবকটাই আছে। তাই মে মাসের কাঠফাটা গরমে দুটো দিন ছুটি ম্যানেজ করে উইকেন্ডের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে উড়ে গিয়েছিলাম। পৌঁছে আড্ডা, পাব হপিং যে হবে তা জানাই ছিল কিন্তু যাচ্ছি যখন টুক করে একটা রোড ট্রিপ হলে মন্দ হয় না ভেবেই চিকমাগালুর যাব ঠিক করি। চিকমাগালুর পশ্চিমঘাট পর্বতমালার পাদদেশে কর্ণাটকের কফি প্ল্যান্টেশন-এর অন্যতম জায়গা। সমুদ্র থেকে 1000 মিটারের বেশি উঁচুতে হওয়ায় গরমও কম। মোটামুটি 300 কিলোমিটারের রাইড, সময় লাগবে পাঁচ-সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা। ঠিক করেছিলাম সেলফ ড্রিভেন গাড়ি ভাড়া করে পৌঁছে যাব। সহযাত্রীদের সম্মতি পেয়ে বুক হয়েছিল থাকার জায়গা। খোদ কফি এস্টেট-এর ভিতর সাজানো গোছানো কফি বিন হোম স্টে। নামেই কফির গন্ধ মাখা। কলকাতায় বসে ফিল্টার হতে থাকা ইচ্ছেগুলোর তখন ডানায় কালবৈশাখী।
আমরা বুধবার ব্যাঙ্গালোর পৌঁছেছিলাম আর চিকমাগালুর যাওয়ার ছিল শুক্রবার। প্রাথমিক প্ল্যানে দুদিন সেখানে থাকার কথা ভাবলেও সময় ও রুম এভিলিবিলিটির অভাবে শুধু শুক্রবার রাতটাই থাকা হবে ঠিক হয়েছিল। ঠিক ছিল শুক্রবার সকাল সকাল বেরনো হবে আর শনিবার রাতে ফেরা হবে। সেইমতো কোন কোম্পানি থেকে গাড়ি নিলে পকেটে টান কম পড়ছে দেখে নিয়ে ভোলার কারস-এ ভরসা করেছিলাম। আমাদের সঙ্গে অর্কর দিদিভাই, ছোট্ট বনঝি, জেঠু, জেঠিমাও সঙ্গী, তাই স্কর্পিও বুক করেছিলাম। ব্যাঙ্গালোর ট্রাফিক এবং এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় দূরত্ব কেমন তা মোটামুটি আজকাল লোকে জেনে গেছে তাই নিজেরা গাড়ি আনতে যাওয়ার ঝামেলায় না গিয়ে বাড়িতে কার ড্রপ আর পিক-আপ এর রিকোয়েস্ট করে দিয়েছিলাম। যাওয়ার দিন, মানে শুক্রবার সকাল 7 টায় গাড়ি দিয়ে যাওয়ার কথা বাড়িতে। তখন রওনা দিলে মোটামুটি 12টা সাড়ে 12 টায় পৌঁছব, সেই ভেবেই প্ল্যান করা হয়েছিল। কিন্তু সকাল সকাল ভোলার ভোল পাল্টে দিল প্ল্যান-এর। নানান অজুহাত দিয়ে এসে পৌঁছল সাড়ে 8 টায়। আমার তো মাথা আগুন। কিন্তু এখানে লোকেদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে কোনও শান্তি নেই! মেনে নেওয়াটাই অপশন। ফর্মালিটি সেরে গাড়ি স্টার্ট করেছিলাম পৌনে 9 টায়। অর্কর দিদি থাকে ইলেক্ট্রনিক সিটি-তে। এখান থেকে শহরের ভিতরের জায়গাগুলো দূর হলেও শহরের বাইরে যাওয়াটা সহজ। খুব একটা জ্যাম ট্যাম না পেয়ে আমরা অল্প সময়েই উঠে পড়েছিলাম নাইস রোড-এ। এখানে রাস্তাঘাট সুন্দর। দুধারে প্রচুর গাছ, পাঁচিলের গা ঘেঁষে নানা রঙের বগেনভেলিয়া, চওড়া রাস্তার ফাঁকে ফাঁকে কৃষ্ণচূড়া, রাধা চূড়া। কোথাও আবার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ডাব গাছের সারি। উড়িষ্যায় তখন ফনী আছড়ে পড়ছে, কলকাতায় দিনের বেলা অন্ধকার, কিন্তু এখানে আকাশ ঝকঝকে নীল, চড়া রোদ। আগে থেকেই ম্যাপ-এ দেখে নেওয়া ছিল প্রথমে এনএইচ 48 ধরে গিয়ে তারপর এন এইচ 75 ও এনএইচ 173 ধরে চলতে হবে। রাস্তা ফাঁকা, এমনিতেই লেট-এ রান করছি, তাই টোল প্লাজা ছাড়া আর কোথাও দাঁড়ানোর ব্যাপার নেই। রওনা দেওয়ার 1 ঘণ্টার মধ্যেই হোম স্টে থেকে ফোন পেয়েছিলাম কে কি খাব, কখন পৌঁছচ্ছি সেসব জানতে। ম্যানেজার জানিয়েছিলেন চিকমাগালুর টাউন পৌঁছে ফোন করতে, রাস্তা বুঝিয়ে দেবেন। আমরা ঘন্টা চারেকের বেশি সময় হাইওয়ের ওপর দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম চিকমাগালুর টাউন। গোটা রাস্তায় কৃষ্ণচূড়ার ভিড় পুরুলিয়ার পলাশ মনে করিয়ে দিচ্ছিল বার বার।
এখান থেকে মালান্দুর রোড ধরে আঁকা-বাঁকা পথ আরও ওপরে উঠে গেছে। সেখানে গাড়ি চালিয়ে বেশ মজা। অর্কর চোখে-মুখে উত্তেজনার ছাপ। এই রাস্তায় গাছ আরও বেশি। প্রচুর সিলভার ওক দেখছি তখন। রোদ পরে রুপোলি পাতা ঝলমল করছে। সামনের রাস্তায় দুদিকে কফি প্ল্যান্টেশন। ঝোপ ঝোপ কফি গাছ হয়ে আছে, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে লম্বা লম্বা অন্য গাছ, বেশিটাই সিলভার ওক। মোড়ে মোড়ে কফি এস্টেট লাগোয়া হোম স্টে, রিসর্ট। রাস্তার ছবি তুলব, না ম্যাপ দেখব এই দোনামনা নিয়ে চলছি। খানিক এভাবে চলার পর রাস্তাটা লাল মাটির, আরও সরু, দুদিকে মাঝে মাঝেই বাহারি ফুল। সে রাস্তায় কয়েকটা বাঁক নিয়েই ঢুকে পড়া গেল কফি বিন-এর প্রপার্টি-তে। আরও খানিক এগোনোর পর গাড়ি সোজা গিয়ে থামল কফি বিন হোম স্টে-এর পার্কিং-এ।
গাছপালায় ঘেরা বিশাল এলাকার ওপর লাল রঙের বাড়ি। গাড়ি ঢুকতেই ম্যানেজার দিলীপ আমাদের ওয়েলকাম জানাতে হাজির। সঙ্গে আরও দুই কর্মচারী। তখন সোয়া দুটো বাজে। খিদেও পেয়েছে। আমাদের রুম মেইন কম্পাউন্ড থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গিয়ে, একটু নিরিবিলিতে। আমরা একটা 11 বছরের বাচ্চা নিয়ে 6 জন, এদিকে গিয়ে দেখি রুম দুটো। তাতে থাকা গেলেও অসুবিধে আছে। এখানে এমনিও মাথা পিছু খরচের হিসাব, সুতরাং ঘর দেওয়ার সমস্যা নেই আগে থেকে বুক করলে। কিছু একটা ভুল বোঝাবুঝিতে এমন ব্যবস্থা হয়েছে। আমরা খাবার জায়গায় গিয়ে ম্যানেজার এবং মালকিন রুচিকা-কে ব্যাপারটা জানালাম। একটা রুমই খালি ছিল, তাই ওনারা ব্যবস্থা করে দিলেন। কিন্তু খালি না থাকলে দুটোতে মিলিয়েই থাকতে হতো আমাদের। তাই অবশ্যই বুকিং-এর সময় ঠিক করে কথা বলে নেওয়াটা বেটার। মাথাপিছু খরচ 2700 টাকা থাকা খাওয়া নিয়ে, বয়স 7-12 হলে মাথাপিছু 1500, আর 4-6 হলে মাথাপিছু 800। ইনফ্যান্ট হলে চার্জ লাগবে না।
আমরা আর একটা রুম পেয়ে নিশ্চিন্তে খেতে বসলাম। খাবার-দাবার বুফে সিস্টেম-এ। মেনুতে ট্রাডিশনাল ‘মালনাড’ কুইজিন। বিট রুটের রুটি, চানা, শাক দেওয়া ডাল, নারকেল-সর্ষে-কারিপাতা দিয়ে বানানো এঁচোর, সাদা ভাত, গ্রিন চাটনি দেওয়া ফ্রায়েড রাইস, সাদা চিকেন কারী, রায়তা, আভকাডো স্যালাড, চাটনি, পাঁপড় দিয়ে লাঞ্চ সারলাম। এখানে সবজি, মাংস সবই নিজেদের ফার্মিং-এর। ঘি, মাখন হোম-মেড। এমনকি সোলার এনার্জি, বায়ো গ্যাস, ইলেক্ট্রিসিটি-ও নিজেরাই এখানে উৎপাদন করে, পুরোপুরি ইকো-ফ্রেন্ডলি লিভিং। এনিম্যাল ফ্রেন্ডলি-ও বটে। নিজের পোষ্যকে নিয়ে দিব্যি এখানে আসা যায়। এদের নিজেদেরই পোষা কুকুর, বিড়াল, পাখি সবই আছে। লাঞ্চ করতে করতেই রুচিকার সঙ্গে কথা বলে জেনে নিলাম কোথায় কোথায় যাওয়া যেতে পারে। আমাদের হাতে সময় কম। তাই যে কোনও একটাই বাছতে হবে। তবে বিকেলে কাছেই একটা সানসেট পয়েন্ট আছে, কভিকালমাতা, সেখানে যাওয়া হবে ঠিক হল। সানসেট পয়েন্ট যেতে হলে হোম স্টে-তে বলে জিপ নিতে হয়। আমরা 6 জন তাই একটা জিপে হয়ে যাবে, সংখ্যায় কম হলে অন্য গ্রুপ-এর সঙ্গে শেয়ারেও যাওয়া যায়। জিপ প্রতি ভাড়া 1000 টাকা। ঠিক হল আমরা রেস্ট নিয়ে 5-5.30 টা নাগাদ রেডি হয়ে চলে আসব ডাইনিং এরিয়ায়। নিচের রুমদুটোর একটা আমি আর অর্ক নিলাম। এই রুম দুটোর নাম কুমকুমা আর অরিসিনা। সিঁড়ি বেয়ে উঠেই বাঁ হাতে একটা দোতলা, সেটারই নিচের অংশটায় আমাদের আর একটা রুম। সেই রুমের সামনে দোলনা লাগানো। কাঠের ছোট্ট দরজায় ঐতিহ্যের ছাপ। নিচের ঘর দুটোতেই কাঁচের দরজা দেওয়া বারান্দা আছে, বারান্দার ওপারে সবুজ জঙ্গল। ঘরে খাটে বসেও সে জঙ্গলের রূপে ডুব দেওয়া যায়। আমাদের ঘরের রংটা লাল, তাই খানিক আলো আঁধারি, পাশের ঘরটা হলুদ, এটায় বেশ আলো খেলছে। উপরের ঘরটার ধরণটা খানিক আলাদা, দেওয়াল, বিছানায় রাস্টিক ছোঁয়া। ঘরের সামনে বাগান, প্রাইভেট দোলনা, বিশাল ঘর, বাহারি কাঁচের আয়না, বেশ একটা নিজস্ব জগতে ঢুকে পড়ার মতো ব্যাপার আছে। দেওয়ালের সঙ্গে লাগোয়া কাঁচের জানলা দিয়ে বাইরে দেখলে নীচে আমাদের অন্যদুটো ঘরসহ দক্ষিণী স্টাইলের বাড়িটির সঙ্গে জঙ্গল দেখা যাবে। ফ্রেস হয়ে বাইরের জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমি এই বিশাল এস্টেটের ইতিহাসের কথা ভাবছিলাম। ইতিহাস বলতে যতটুকু নিশ্চিত-এর সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি আর কি। ‘আরালাগুপ্পে’ পরিবারের ষষ্ঠ জেনারেশন নিশ্চিত তাঁর স্ত্রী রুচিকাকে সঙ্গে নিয়ে 5-6 বছর আগে শুরু করে এই হোম স্টে। কফি প্লান্টার হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি হোম স্টে পরিচালনা করা, নতুন নতুন গেস্ট-দের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়-আড্ডা নিয়ে এই পাহাড়ি আস্তানায় দিন কাটে। নিশ্চিতের বাবা-মাও ওদের সঙ্গেই এখানে থাকেন। ওদের 6 মাসের একটি ছেলে আছে। ওনার হিসেবে দুজনেই খুব হেল্পফুল।
প্রকৃতির রূপ দেখতে দেখতে ঘড়ি 5 টা ছাড়িয়েছে। আমরা তাড়াতাড়ি ওপরে গেলাম। সেখানে গরম গরম কফি খেয়ে সূর্যাস্ত দেখতে যাওয়া। আমরা কফি শেষ করে উঠে পড়লাম জিপে। কফি বিন থেকে বেরিয়ে জিপ মেঠো পথ ধরে খানিক গিয়ে পিচ রাস্তায় পড়ল। খানিক যাওয়ার পরই রাস্তার মজা টের পাওয়া গেল! আঁকা-বাঁকা পথ, পুরো ব্যাম্পি রাইড! খানিক গিয়ে আবার লাল মাটির রাস্তা, দুদিকে জঙ্গল, সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে পাতার ফাঁক দিয়ে। আমাদের প্রায়ই ঠোকাঠুকি লেগে যাচ্ছে। লাল সরু রাস্তায় নীচে নেমে আবার খাঁড়াই ওপরে উঠে গিয়ে থামল জিপ।
নেমে সিমেন্টে বাঁধানো বসার জায়গা করা আছে একটা। সেটার পাশ দিয়ে ঢাল বেয়ে খানিক নীচে নামা যায়। সামনে পুরো পশ্চিম দিগন্ত জুড়ে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা। কোনটা কী পাহাড় বুঝতে পারছি না মোটেই, কিন্তু গায়ে গায়ে লেগে থাকা সবুজ পাহাড় চোখ জুড়িয়ে দিচ্ছে। নীচে সবুজ গাছ, কোথাও এক ফালি ঝিল। তখনও সূর্য ডুবতে দেরি, আকাশ সবে হালকা কমলা হতে শুরু করেছে। আমরা নীচে নেমে গিয়ে পাহাড়ের গা ঘেঁষে বসলাম। উপরের দিকে লোকের ভিড় বেশি। এখানে বসে সামনের পর্বতমালার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সহজেই হারিয়ে যাওয়া যায় মনে মনে। যেখানে কেউ নেই, নিস্তব্ধতার সঙ্গে শব্দ বিনিময় যেখানে প্রিয় অবসর। চারপাশটা দেখতে দেখতে কিছুক্ষণের মধ্যেই আলো কমতে লাগলো। সূর্য তখন সম্পূর্ণ কমলা। তারপর সবুজ পাহাড় নীলচে হয়ে এল। মেঘের আড়ালে ঝুপ করে মিলিয়ে গেল সূর্য। পাহাড়ের গায়ে সন্ধে নামল। আমরা আরও খানিক নিস্তব্ধতা উপভোগ করে উঠে এলাম। এসে দেখি বিপত্তি। আমাদের ভাড়া করা জিপটির অয়েল লিক হয়েছে। সে নামতে পারবে না। অন্য জিপ সব ততক্ষণে নেমে গেছে। একটা পিক-আপ ট্রাক আছে, সেটায় নামাই একমাত্র উপায়। অগত্যা সেখানেই উঠতে হল। জেঠিমার বসার জায়গা হল সামনের ড্রাইভারের পাশে। আমরা বাকিরা পিছনে দাঁড়িয়ে। ওই উঁচু-নিচু রাস্তায় টলমল করতে করতে, কোমরে ঠোকা খেতে খেতে, লাল মাটির ধুলো মাখতে মাখতে, পাহাড়ে ঠান্ডা নামা উপভোগ করতে করতে, হঠাৎ পাওয়া এডভেঞ্চারের স্বাদ নিতে নিতে আমরা ফিরে এলাম কফি বিন-এ।
হোম স্টে-তে ফিরেই দেখি সন্ধের স্ন্যাকস রেডি। বেবি কর্ন পকড়া, আমাদের এখানে যেমন ছোট ছোট গোল গোল করে ভাজা হয় তেমন না, লম্বা লম্বা বেবি কর্ন মাঝখান দিয়ে চিড়ে বেসনের গোলায় ভাজা। সস দিয়ে খারাপ লাগল না খেতে। এরসঙ্গে ট্রে তে করে ছোট ছোট গ্লাস-এ এল হোম মেড ওয়াইন, টেস্টিং-এর জন্য। তিন রকমের ওয়াইন – বেটেল লিফ (পান পাতা), গ্রেইপ (আঙ্গুর), কফি লিকার। প্রথম দুটোয় এলকোহল নেই, শেষেরটিতে আছে। এরপর নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না আমাদের কোনটা সবচেয়ে ভালো লেগেছিল! রুচিকা এই ওয়াইনগুলো তৈরি করে। এখান থেকে কিনে নিয়েও যাওয়া যায়। আমরা ফেরার সময় কফি লিকার কয়েক বোতল নিয়ে যাব তা তখনই ঠিক করে নিয়েছিলাম। লিকারে চুমুক দিতে দিতে নিশ্চিত-এর সঙ্গে আড্ডা জমেছিল। ওর পরিবার, বাবা-মা, গোয়ায় স্যাক চালানো, তারপর এখানে হোম স্টে চালুর পরিকল্পনা, সেসব খবর জেনে নিয়েছিলাম কথায় কথায়। আমরা যেহেতু কম সময় নিয়ে গেছি তাই আর কি কি দেখা যায় তাই নিয়েও আলোচনা হচ্ছিল। চিকমাগলুর গেলে অনেকেই মূল্যানগিরি বা বাবা বুদানগিরি যায়, সুন্দর পাহাড়ি পথ, ট্রেকিং-এর ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু গরম-এর জেরে পরিবার নিয়ে সেখানে যাওয়া খানিক সমস্যার। তাই নিশ্চিথ-এর সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক হল আমরা পরদিন ফেরার সময় বেলুর ও হালেবেদু টেম্পল দেখে ব্যাঙ্গালোর ফিরব।
রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা পড়তে শুরু হল। এখানে অনেক ইনডোর গেম আছে, সময় কাটানোর সমস্যা নেই। না হলে দোলনায় বসে বসে সাত-পাঁচ ভাবা বা ঘরের বারান্দায় বসে অন্ধকার জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে থাকার মধ্যে ভালোলাগা আছে ভীষণ। বারান্দা থেকে জঙ্গল দেখতে দেখতে ডিনার টাইম হয়ে এল। আমরা জড়ো হলাম ডাইনিং এরিয়ার। ভাত, রুটি, ডাল, ছোলার সবজি, রসম, গ্রিন চিকেন কারি, স্যালাড ইত্যাদির সঙ্গে ছিল একটা রাইস বল যেটা ঘি মাখিয়ে নারকোলের চাটনি দিয়ে খেতে হয়। ঘরে বানানো ঘি-এ মাখানো সেই রাইস বলের স্বাদ বহুদিন মনে থেকে যাবে। অনেকগুলো খেয়ে ফেলেছিলাম আমরা গল্প করতে করতে। খাওয়া-দাওয়া সেরে রুমে গিয়ে দেখলাম বেশ ঠান্ডা লাগছে। পাতলা কম্বল দেওয়াই ছিল, মুড়ি দিয়ে ঘুম দিলাম জম্পেশ।
সকালে 7 টা সাড়ে 7 টার মধ্যে উপরে গিয়ে কফি খেয়ে এস্টেট-এর কফি ট্যুর-এ যাওয়ার প্ল্যান। নিশ্চিথই নিয়ে যাবে এমন কথা ছিল। কিন্তু আমরা গিয়ে দেখলাম ও অন্য একটি গ্রুপকে নিয়ে আরও সকালে বেরিয়ে গেছে। আমরা কফি খেয়ে ম্যানেজার দিলীপ বাবুর সঙ্গে বেরোলাম। বাড়ির ভিতর থেকেই গাছ-পালার সঙ্গে পরিচয়পর্ব শুরু হয়ে গেল। বাইরের খোলা জায়গায় লিচু, চেরি, আম, আভকাডো গাছ গাছ দেখে চলা শুরু হল পাথুরে রাস্তায়। ঝোপ ঝোপ কফি গাছগুলো চিনিয়ে দিতে লাগলেন দিলীপ। রোবাস্তা, আরাবিকার পাশাপাশি চিনলাম কাবেরী নামের আর এক কফি-কেও, যার অস্তিত্ব সম্পর্কে আমার কোনও ধারণাই ছিল না। কফি বিন এ সময় একেবারেই কচি, সবুজ সবুজ বিন ডাল-এ লেগে থাকা দেখেই যদিও আমার প্রথম দেখার আনন্দ। কফি প্ল্যান্টেশনের একটা আকর্ষণীয় ব্যাপার হল ঝোপের আশেপাশে বেড়ে ওঠা জঙ্গল। কত রকমের গাছ যে আছে! সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সিলভার ওক গুলো আকাশের দিয়ে চেয়ে আছে। অনজির, বাঁশ, আম, কাঁঠাল, সুপারি, কমলালেবু, পাতিলেবু, মরিচ, সবই আছে। গাছের গা বেয়ে বেড়ে ওঠা লতানো ফুল কোনো কোনো জায়গায় এক মোহময় পরিবেশ তৈরি করেছে। খাঁড়াই উৎরাই পেরিয়ে আমরা বিশাল এস্টেট দেখলাম অনেকখানি সময় নিয়ে। ইকো ফ্রেন্ডলি এস্টেট-এ জলবিদ্যুৎ তৈরির জায়গা, কফি গ্রাইন্ড করার মেশিন, চাষের জায়গা, পোলট্রি, ডেয়ারি ফার্ম সবই ঘুরে দেখালেন দীলিপ। ঘণ্টাখানেকের এই ট্যুর অনেকখানি মনে থাকার মতন রসদ দিল।
ব্রেকফাস্ট সেরে ফ্রেশ হয়ে আমাদের বেরনোর প্ল্যান। আমরা ফিরে কফি নিয়ে বসলাম। ব্রেকফাস্ট-এ তরমুজ, মশলা দোসা, ব্রেড, হোম মেড বাটার, জ্যাম, অমলেট, পোহা ছিল। আমরা পছন্দমতো খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলাম। বেরোনোর সময় রুচিকা ওদের রীতি মেনে আমার আর দিদিভাই-এর কপালে হলদি-কুমকুম ছুঁইয়ে দিল। এই আপন করে নেওয়ার আন্তরিকতা বেশ লাগলো। শেষবারের মতো আরও একবার ঘুরে দেখে নিলাম কফি বিন।
তখন প্রায় সাড়ে 11 টা। সূর্যের খুব তেজ। আমরা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বেলুর-এর উদ্দেশ্যে। একই রাস্তায় চিকমাগলুর টাউন অবধি এসে অন্য রাস্তায় ধোকা। মোটামুটি যাওয়ার পথেই পড়বে। পাহাড়ি রাস্তায় ওঠার সময় যেমন মজা লেগেছিল, নামার সময়ও তার ব্যতিক্রম নয়। আমরা ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম বেলুর। সেখানে মন্দিরের বাইরে গাড়ি পার্ক করে মন্দিরের দিকে পা বাড়ালাম। বাইরে জুতো জমা দিয়ে মেঝেতে পা রেখেই ছ্যাঁকা খেলাম! রোদে পাথর আগুন হয়ে আছে। কিন্তু এসে যখন পড়েছি না দেখে তো যাব না! বেলুর-এর এই মন্দির চ্চেন্নাকেশভা মন্দির হিসেবে পরিচিত। দ্বাদশ শতাব্দীতে হয়সালা সাম্রাজ্যের রাজা বিষ্ণুবর্ধনের তত্বাবধানে এই মন্দিরের নির্মাণকাজ শুরু হয়। মন্দিরটি সম্পূর্ণ তৈরি হতে সময় লাগে ১০৩ বছর। প্রবেশদ্বার থেকে খানিকটা হেঁটে গিয়ে মূল বিষ্ণু মন্দির। মন্দিরের গায়ে প্রচুর কারুকাজ। আমরা গাইড নিয়েছিলাম। তিনি কাঁচের টুকরো হাতে রিফ্লেক্সন ফেলে ফেলে চিনিয়ে দিচ্ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ পাথরের কারুকাজ, ভাস্কর্য। মন্দিরের গায়ে নর্তকী, শিকারি-সহ বিভিন্ন নারী মূর্তির নিখুঁত সৌন্দর্য, তার পিছনে লুকিয়ে থাকা গল্প, 16 হাতওয়ালা শিব, নরসিংহ বধের দৃশ্য, পাথরের গায়ে সূক্ষ থেকে সূক্ষতর কাজ, থামে নানা মাপের নানা ডিজাইনের হাতি-ঘোড়া, নারী-পুরুষ, দেওয়ালে প্রাচীন লিপি সবই ওই কাঠফাটা রোদেও মুগ্ধ করেছিল। বিষ্ণু মন্দিরের গর্ভগৃহে অনেক থাম, প্রতিটির আলাদা কারুকাজ, জাফরির মতো কাজের জানলার মধ্যে দিয়ে আলো ঠিকরে পড়ছে ভিতরে। শিলিং-এ অপূর্ব শিল্পশৈলী। অনেক মানুষের ভিড় ভিতরে, বেড়ানোর না, পুজো দেওয়ার। আমরা ইতিহাসের গল্প শুনতে শুনতে বেরিয়ে এসেছিলাম বাইরে। এই মন্দিরটির পিছন দিকে একটি লক্ষ্মী মন্দির আছে। সেটা নিজেরাই ঘুরে দেখে আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম।
তখন খুব রোদে, খুব খিদেও। এদিকে হালেবিদু যাওয়ার কথা। কিন্তু কারও মনই এই রোদে আরও একটা মন্দির দর্শনে সায় দিচ্ছে না তেমন। গাড়ির এসির আরামের টান বেশি। তাই সবার মতামত নিয়ে হালেবিদু আমরা বাদ দিয়েছিলাম লিস্ট থেকে। এন এইচ 73-তে উঠে গাড়ি ছুটেছিল ফাঁকা হাইওয়ে ধরে। রাস্তার ধারে ধাবা-তে ম্যাঙ্গালোর স্টাইল মাছ ভাজা আর লস্যি খেয়ে রওনা দিয়েছিলাম সোজা ব্যাঙ্গালোর। মন জুড়ে ছিল গরম গরম সাউথ ইন্ডিয়ান কফির উষ্ণতা।
খুঁটি-নাটি তথ্য:
ব্যাঙ্গালোর থেকে কফি বিন হোম স্টে-এর দূরত্ব- প্রায় 265 কিমি (সময় লাগবে- সাড়ে 5 ঘণ্টা)
ব্যাঙ্গালোর থেকে সেলফ ড্রিভেন গাড়ি- Zoom car, My Choice, Drivzy, Volar cars ইত্যাদি বিভিন্ন সংস্থা থেকে অনলাইন-এ বুকিং করা যাবে। দুদিনের জন্য বুকিংয়ে খরচ মোটামুটি গাড়ি হিসেবে 4.5-6 হাজার টাকা। তেলের খরচ আলাদা। গাড়ি সংস্থার সেন্টার থেকে নিজে গিয়ে নেওয়া যায় আবার লোকেশন-এ গাড়ি দিয়ে যাওয়া নিয়ে যাওয়ারও ব্যবস্থা আছে।
থাকার জন্য হোটেল, হোম স্টে সবই পাওয়া যাবে। হোম স্টে-গুলোর বেশিরভাগই এস্টেট সংলগ্ন।
কফি বিন হোম স্টে-ভাড়া মাথাপিছু 2700 ব্রেকফাস্ট-লাঞ্চ-ইভিনিং স্ন্যাকস-ডিনার নিয়ে। বয়স 7-12 হলে মাথাপিছু 1500, আর 4-6 হলে মাথাপিছু 800। ইনফ্যান্ট হলে চার্জ লাগবে না।
ক্যাশ সঙ্গে রাখতে হবে, কার্ড accept করে না।
Website- coffeebeanhomestay.com
আরো কিছু লেখা:
চীন ভ্রমণের প্রথমাংশ জানার জন্য click করুন এখানে।
চীন ভ্রমণের দ্বিতীয়াংশ জানার জন্য click করুন এখানে।
চীন ভ্রমণের তৃতীয়াংশ জানার জন্য click করুন এখানে।