চীন বেড়ানোর শুরুটাই হয়েছিল Beijing দিয়ে। চীনে গেলাম কিন্তু যে প্রাচীরের কাহিনী পরে চীন দেশটাকে চিনলাম, বেড়াতে গিয়ে সে জায়গাকে বাদ দেওয়া অন্যায়। তাই গ্রেট ওয়াল দেখতে হবে বলেই বেজিং যাওয়া। আর যাচ্ছি যখন তখন চায়নার ইতিহাসের সাক্ষী বহন করছে এমন কিছু জায়গাকে জুড়ে নেওয়াটা অবশ্যি কর্তব্য। সেই মতোই আমাদের Beijing-এর প্ল্যান হয়েছিল 4 দিন, 3 রাতের।
কলকাতা থেকে কুনমিং হয়ে বেজিং-এর কানেকটিং ফ্লাইট। পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল। এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে যখন আমাদের হোস্টেল-এ পৌঁছলাম তখন প্রায় সাড়ে 6 টা। আমাদের হোস্টেলটা একটা Hutong-এর ভিতরে। Hutong চীনের অতীত ঐতিহ্য, ইতিহাসের সাক্ষী। সরু রাস্তা, দুদিকে সারি সারি ধূসর রঙা পাঁচিলঘেরা বাড়ি-এমন জায়গাকে বলে Hutong. উত্তর চীনে সারি সারি ঐতিহাসিক siheyuan অর্থাৎ Courtyard ধরণের বাড়ি পাশাপাশি জুড়ে জুড়ে থাকার ফলে Hutong Alleyway তৈরি হয়েছিল। আবার বহু Hutong একে অপরের সঙ্গে জুড়ে তৈরি হয়েছিল প্রতিবেশী, পরিজন। চীনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় মূলত Yuan, Ming, Quin সাম্রাজ্যে এসব Hutong তৈরি হয়। বিশ শতকে চীনের বহু Hutong ভেঙে দেওয়া হয় নতুন রাস্তা, বাড়িঘর তৈরির জন্য। তবে কিছু Hutong ইতিহাস সংরক্ষণের লক্ষ্যে থেকে যায় ঐতিহাসিক মর্যাদায়। এমনই কিছু Hutong-এ এখনও Beijing-এর সাধারণ মানুষের বসতি। কিছু কিছু Hutong এ তৈরি হয়েছে হোস্টেল, রেস্টুরেন্ট, বার। সেরকমই একটি Hutong-এ আমাদের হোস্টেল Ming Courtyard. রিসেপশন পেরিয়ে courtyard, যার চারপাশে সার দিয়ে দাঁড়ানো ঘর। নামে হোস্টেল হলেও ডরমেটোরি, শেয়ার্ড রুম ছাড়াও প্রাইভেট রুম আছে, সবরকম সুবিধা হোটেল-এর মতোই। রিসেপশন-এ সবসময়ই লোক থাকে। আমাদের ডাবল বেড রুম-এর ভাড়া পড়েছিল 3000/night. চীনের অন্যতম বড় শহর হওয়ার বেজিং এ হোটেল ভাড়া বেশির দিকেই। বিশেষত চেইন হোটেল-এর ক্ষেত্রে। ভাল ভাল হোস্টেল আছে Hutong সংলগ্ন এলাকায়, সেখানে প্রাইভেট রুম হোটেল-এই চেয়ে কোনও অংশে কম না। Booking.com, agoda থেকে সহজেই বুকিং পাওয়া যাবে।
চেক ইন করে ফ্রেস হয়ে আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম Ghost Street-এ খাবারের সন্ধানে। Ghost Street বা Gui Jei বেজিং-এর বিখ্যাত একটি ফুড স্ট্রিট। রাস্তার দুপারে সার দিয়ে বড় বড় রেস্টুরেন্ট, যার বেশিরভাগই 24 ঘণ্টা খোলা থাকে। শোনা যায়, Qing Dynasty-এর সময়কালে ব্যবসায়ীরা রাতের দিকে লণ্ঠন জ্বালিয়ে এ রাস্তায় বিক্রিবাটা করত। রাতে তাঁদের লণ্ঠনের মৃদু আলো চারপাশটাকে ভৌতিক করে তুলত, সেই থেকেই এ রাস্তার নাম হয় Ghost Street. পরবর্তীকালে চাইনিজ খাবারের পীঠস্থান হিসেবে গড়ে ওঠা এই রাস্তার নাম Gui Jei স্ট্রিট হয়, কিন্তু Ghost Street হিসেবেই এ রাস্তা বেশি জনপ্রিয়। রাস্তায় নেমে প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম ভাষা নিয়ে এখানে বেগ পেতে হবে। অফলাইনে গুগল ট্রান্সলেটর থাকলেও লোকে উত্তর দিচ্ছে চাইনিজ-এই। তাই কি খাব তা বোঝাতে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হচ্ছে। অবশেষে ছবি দেখে এবং লিখে বুঝিয়ে সে রাতের খাওয়া হয়েছিল। তবে পরের দিনগুলোয় এতটা সমস্যা হয়নি। পরদিন সকাল সকাল বেরনো, তাই ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে ব্রেকফাস্ট হিসেবে নিয়ে নিয়েছিলাম নানারকম ব্রেড ও ফল। বেজিং-এ ব্রেড কিন্তু দারুণ সুস্বাদু আর লোভনীয়।
বেজিং-এ বেড়ানোর সবচেয়ে বড় সুবিধে হল এর সাবওয়ে কানেকটিভিটি। পুরো শহরটাই সাবওয়ে দিয়ে জোড়া। একটা Yikatong কার্ড করে নিয়ে ব্যালেন্স ভরে সব জায়গা সহজেই ঘুরে নেওয়া যায়। আমাদের দুজনের 3 দিন ঘুরতে Subway তে 2000 টাকার বেশি লাগেনি। এই কার্ড বাসেও চলে এবং এটি ব্যবহার করে সাইকেল রেন্টও নেওয়া যায় বুথ থেকে। আমরা প্রতিটা জায়গা Subway ব্যবহার করেই ঘুরেছি। প্রথম দিনের প্ল্যানে আমরা রেখেছিলাম Summer Palace আর Beijing Zoo. আমাদের হোস্টেল থেকে পায়ে হেঁটেই মেট্রো স্টেশন Beixinqiao. সকাল 9 টার মধ্যে বেরিয়ে মেট্রো স্টেশন পৌঁছে সাবওয়ে কার্ড বানিয়ে রিচার্জ করে উঠে পড়েছিলাম মেট্রোয়। Beijing Metro Man App টা ফোন-এ ডাউনলোড করা থাকলে যে কোনও জায়গায় যাওয়া খুব সুবিধে, স্টেশনের ম্যাপ, কোন স্টেশনের পর কি স্টেশন, কোথায় লাইন চেঞ্জ সে সব ডিরেকশন এখানে পরিষ্কার দেওয়া আছে।
Summer Palace
Summer Palace Xiyuan স্টেশন থেকে 10 মিনিটের হাঁটা পথ। মেট্রো থেকে বেরনোর পরই ঝকঝকে সাজানো গোছানো রাস্তা। খানিক এগোতেই বুঝলাম ভিড় আছে। বেশিরভাগই চীনা ট্যুরিস্ট। ট্যুর গাইড নিয়ে গাইডেড গ্রুপ ট্যুর-এর ভিড়ই বেশি। টিকিট দুরকম। একটা এন্ট্রি টিকিট আছে, সেটায় ভারতীয় টাকায় 150 টাকা দিয়ে ভিতরে ঢোকা যায়। তারপর ভিতরের পয়েন্টগুলোয় ইচ্ছেমতো টিকিট কেটে নেওয়া যায়। অন্য টিকিটটি all inclusive. ভিতরের সব এনট্রেস-এর দাম ধরে মাথাপিছু 600 টাকা (ভারতীয় টাকায়)। টিকিট কেটে ম্যাপ-এর ছবি তুলে ঢুকে পড়লাম ভিতরে। গরমের সময় একটু নিরিবিলিতে, গাছ-পাখি, হাওয়া-বাতাসের মধ্যে সময় কাটানোর জন্য Qing রাজাদের রাজত্বকালে তৈরি হয় Summer Palace. Kunming Lake ও Longevity Hill এই প্যালেস-এর অন্যতম আকর্ষণ। Kunming Lake-এ বোট-এ চড়ে ঘুরতে ঘুরতে পাহাড়ি সৌন্দর্য উপভোগ করতে বেশ লাগে। Longevity Hill-এর খাড়াই সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গিয়ে দেখা যায় বর্তমান ও প্রাচীন শহরের সহাবস্থান। একটা বেলা ঘুরে-বেরিয়ে কাটানোর জন্য Summer Palace ভালোই, শুধু চীনা ট্যুরিস্ট-দের চেঁচামেচি একটু কম হলে এমন মনোরম জায়গা আরও বেশি উপভোগ্য হয়, এই যা…।
Beijing Zoo
আমরা Summer Palace থেকে দুপুর দুপুর বেরিয়ে লাঞ্চ সেরে রওয়ানা দিয়েছিলাম Beijing Zoo. মেট্রোয় চড়ে 10 মিনিটেই পৌঁছে গিয়েছিলাম। মেট্রো থেকে বেরিয়ে দু পা হেঁটে পাশেই Zoo. সেখানেও টিকিট দুরকম। পান্ডা দেখতে চাইলে কিছু এক্সট্রা টাকা লাগে। পান্ডা দেখতেই যখন আসা আমরা সেই টিকিট কেটে ঢুকে পড়েছিলাম। নাদুস-নুদুস জায়েন্ট পান্ডা-দের দুস্টুমি, বোকামি, খাওয়া, ঘুমানো দেখতে দেখতে অনেকটা সময় কাটিয়ে দিয়েছিলাম। মূলত পান্ডা দেখতে Beijing Zoo গেলেও Zoo এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমায় মুগ্ধ করেছে। অক্টোবর মাস, গাছে সবুজ হলুদ লাল পাতাদের ভিড়, রাস্তার মাঝ বরাবর বয়ে চলা খাল, তারওপর দিয়ে বাঁধানো রাস্তা, উইলো গাছের পাতাদের মাটি ছুঁয়ে থাকা, নাম না জানা পাখির কিচির-মিচির, জলের ধার ঘেঁষে বসে সন্ধে নাম দেখা সবই আমায় মুগ্ধ করেছে। অনেক জন্তু জানোয়ার, aquarium এসব থাকলেও আমার এই Zoo নামক পার্কটিতে হেঁটে বেরিয়ে সময় কাটাতেই বেশি ভাল লেগেছে। সাড়ে 5 টার পর বেরিয়ে আমরা মেট্রো ধরে চলে গিয়েছিলাম Wangfujing.
Wangfujing Street
Beijing এর বিখ্যাত Wangfujing শপিং স্ট্রিট টুরিস্টদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। পাশাপাশি অগুনতি শপিং মল, পৃথিবীর বিখ্যাত সব ব্রান্ডের স্টোর। ঐতিহ্যবাহী কিছু দোকানও চোখে পড়বে। ভাল সিল্ক থেকে ভালো চা, মশলাপাতি, সুভেনিয়র সবই এই বিখ্যাত বাণিজ্যিক স্ট্রিট-এ পাওয়া যায়। রয়েছে নানান খাবারের দোকানও। ঝাঁ-চকচকে আলো ঝলমল এই রাস্তার বেশিরভাগ দোকানই 24 ঘণ্টা বা মধ্য রাত অবধি খোলা থাকে। এই রাস্তায় প্রাচীন কালে 8 টি রাজকীয় বাড়ি (wangfu) এবং একটি মিষ্টি পানীয় জলের কুয়ো (Jing) থাকায় এ রাস্তার নাম হয় Wangfujing street. এ রাস্তার আর একটি অন্যতম আকর্ষণ হল রাস্তার লাগোয়া Snack Street. সেখানে বেজিং-এর বিখ্যাত সব স্থানীয় খাবার পাওয়া যায়। পোকামাকড়, সাপ, ব্যাঙ ভাজা থেকে কাবাব, ক্যান্ডি সব কিছুর দোকান সেখানে। কিন্তু আমাদের দুৰ্ভাগ্য আমাদের Bejing বেড়ানোর সময় এ রাস্তা রেনভেশন-এর কারণে বন্ধ ছিল। তাই গল্পে শোনা Snack Street চাক্ষুষ করার ইচ্ছেটা ইচ্ছেই থেকে গেছে। Wangfujing Street এ এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত হেঁটে বেড়াতে বেশ লাগে। কত মানুষ, কত দোকান, নানান সাজ, রঙিন আলো দেখতে দেখতে সময় এমনিই কেটে যায়। এই স্ট্রিট-এ Wuyutai tea shop-এ জেসমিন টি না খেলে কিন্তু এক্কেবারে মিস! আমরা সন্ধে থেকে রাত অবধি এখানেই কাটিয়ে হোটেল-এ ফিরেছিলাম।
Great Wall of China
পরদিনের প্ল্যান গ্রেট ওয়াল অফ চায়না। বেজিং থেকে গ্রেট ওয়াল-এর অনেকগুলো সেকশন-এ যাওয়া যায়। তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় Badaling Section. সেখানে ভিড়ও বেশি, তবে যাওয়া সহজ। এছাড়া Mutianyu, Juyongguan, Jinshanling, Huanghua ইত্যাদি অনেকগুলি সেকশন রয়েছে। আমরা সকাল অব্দি Badaling না Mutianyu সেই নিয়ে আলোচনা করতে করতে Badaling-এ যাবই ঠিক করলাম। আমাদের Hutong থেকে যাওয়াও সহজ। মেট্রো ধরে Jishuitan স্টেশন, সেখান থেকে হাঁটা পথে বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকেই পর পর ছাড়ে 877 নম্বর বাস। সেই বাসে চড়ে সোজা The Great Wall of China. বাস থেকে যেখানে নামলাম তার উল্টোদিকেই Slide car এর টিকিট কাউন্টার। আরও খানিকটা এগিয়ে গেলে Great Wall ঢোকার টিকিট অফিস। আরও খানিক হেঁটে যাওয়ার পর Cable car এর টিকিট কাউন্টার। কেউই প্রায় চাইনিজ ছাড়া অন্য ভাষা বোঝে না। তাই টিকিটটি ঠিক কোথা থেকে কাটতে হবে তা বুঝতে খানিক সময় লাগবেই। পুরোটা হেঁটে ওঠা আমাদের কম্ম ছিল না তাই Slide car-এর ওঠা-নামার টিকিট কেটে নিয়েছিলাম আমরা। Cable Car এর টিকিটও কেটে নেওয়া যায়। রাউন্ড ট্রিপ করলে খরচ কম পরে। Slide way তে পর পর চেয়ার পাতা, সেখানে বসে টানেল-এর মধ্যে দিয়ে ওপরে উঠে যাওয়া যায়। ওপরে উঠে দেখলাম ভিড় যথেষ্টই। Badaling এ থাকারই কথা। তবে সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে একটির ওপর দাঁড়িয়ে আছি, সেই অনুভূতিটাই ভিড়ের বিরক্তি খানিক ফিকে করে দিল। এদিক ওদিক তাকিয়ে বুঝে নিলাম কোনদিকটা টুরিস্ট কম। তারপর হাঁটতে শুরু করলাম। আকাশ ঝলমলে, দুদিকের পাহাড়ে পাতাবাহার। লাল, হলুদ, নানা শেড-এর সবুজ ঘিরে আছে চারপাশ, ভারি সুন্দর সে দৃশ্য। ওঠা-নামার ধাপগুলো বেশ খাঁড়াই। কিন্তু মজার একটুও কমতি হল না তাতে। দুজনে মিলে মনের আনন্দে হেঁটে চললাম বহুদূর। বইতে দেখা ছবি আর সামনে দেখা যে কত আলাদা তা প্রতি পদে টের পাচ্ছিলাম। এ পাঁচিলের সত্যিই বোধ হয় শুরু শেষ নেই। দুজনে প্রচুর হেঁটে আবার Sliding car এ নীচে নামলাম পায়ে ব্যথা নিয়ে। তারপর Jian Bing, Dumpling এসব দিয়ে খিদে মিটিয়ে বাসে চড়ে ফিরে এলাম বেজিং শহরে।
Qianmen Shopping Street
প্ল্যান ছিল Great Wall থেকে ফিরে Qianmen Shopping Street যাওয়ার। হোস্টেল-এ গিয়ে একটু ল্যাদ খেয়ে বেরোনো হল সেইমতো।
Qianmen Shopping Street বেজিং-এর আর একটি বিখ্যাত পেডিস্ট্রিয়ান শপিং স্ট্রিট। এই স্ট্রিট-এ চীনের ভাস্কর্যের নিদর্শন ছড়ানো-ছিটানো। প্রবেশদ্বার থেকে শপিং কমপ্লেক্স সবই বইতে দেখা চীনকে মনে করায়। বেজিং-এর বিখ্যত পেকিং ডাক থেকে শুরু করে ওথেন্টিক চীন খাবার বলতে যা বোঝায় তার অনেককিছুই পাওয়া যাবে এ রাস্তায়। শপিং-এর জন্য বড় বড় ব্রান্ডের পাশাপাশি চীনের ঐতিহ্যবাহী দোকানও রয়েছে। দর দাম করতে জানলে বেশ সস্তায় মিলবে জিনিসপত্র। তবে সবচেয়ে ভাল লাগবে এ রাস্তা ধরে হাঁটতে। বাঁধানো রাস্তা, মাঝে মাঝেই নানান আকারের বাঁধাই করা বসার জায়গা, পাথরের মডেলিং, সার দিয়ে লাগানো গাছ, রকমারি আলো। চারদিক দেখতে দেখতেই হুট করে সময় ফুরিয়ে এসেছিল। খাওয়া-দাওয়া সেরে ফিরেছিলাম রুমে।
Forbidden City
পরদিন আমাদের বেজিং ছাড়ার দিন। তাই ঠিক করেছিলাম সাতসকালে না বেরিয়ে খানিক ঘুমিয়ে নিয়ে একেবারে চেক আউট করে বেরোব। জিনিসপত্র গুছিয়ে ব্যাগ সুটকেস জমা রেখে বেরিয়ে পড়েছিলাম Forbidden City এর উদ্দেশ্যে। সাবওয়ে ধরে পৌঁছে দেখি বেজায় ভিড়। বেজিং-এ চীনা টুরিস্ট দেখে মনে হবে এরা বুঝি রোজ বেড়াতে বেরোয়। এদিকে Forbidden City না দেখলেও মন খুঁতখুত করবে। তাই লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। লাইন দিয়ে ঢুকে মূল দরজা। এখানে ঢুকতে টিকিট লাগে না। এরকম দুটো কোরটিয়ার্ড পেরিয়ে প্যালেস মিউজিয়াম-এ ঢোকার টিকিট কাউন্টার। টিকিট মাথা পিছু 600 টাকা। পাসপোর্ট টাই টিকিট হিসেবে ব্যবহার হয়। Forbidden City Ming রাজাদের সময়কাল থেকে Qing রাজাদের সময় অবধি মূল রাজবাড়ি ছিল। কাঠের তৈরি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এই চৈনিক ভাস্কর্য একসময় চীন সরকারের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কার্যকলাপের পীঠস্থান ছিল। আমার কখনোই ঐতিহাসিক মর্যাদা সম্পন্ন জায়গায় ভিড় ভাট্টা হট্টগোল ভালো লাগে না। তাই আমার এ জায়গায় গিয়ে ঘোরা হলেও মন ভরেনি। প্যালেস মিউজিয়াম-এর ভিতরে দেখার মতো বেশ কিছু জিনিস থাকলেও ট্যুরিস্ট-দের চিৎকার, বকবক বিরক্তির সৃষ্টি করেছে। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গিয়ে Jingshan পার্কে ঢুকে পড়েছিলাম। এখানের পাহাড়ি বাঁধানো জায়গায় উঠে পড়ে Forbidden City-এর সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্যালেসগুলোর ছাদ দেখতে বেশ লাগে। ভুলে যাওয়া পরিত্যাক্ত শহরের মাথা পেরিয়ে ধোঁয়াশায় ঘেরা আকাশচুম্বী বিল্ডিং এর দাঁড়িয়ে থাকা এক অদ্ভুত বৈপরীত্য তৈরি করে। এ ছাড়া পার্কে সবুজ গাছের ফাঁক দিয়ে হেঁটে বেড়ানো বেশ আনন্দদায়ক। বেজিং-এ পার্কগুলো ভারি সুন্দর। সাইপ্রাস, উইলো ও বহু প্রাচীন গাছে সাজানো। আছে নানান রকম ফুলও। গাছতলায় বসে দুদণ্ড জিড়িয়ে নিতে মন চাইবে সবসময়। বসার জায়গাও অনেক। কিন্তু আমাদের সময় কম। অল্প কিছুক্ষণ বসে ও হেঁটে বেরিয়ে আমরা রওনা দিয়েছিলাম Temple of Heaven-এর উদ্দেশ্যে।
Temple of Heaven
চীনের রাজাদের প্রার্থনাগৃহ হিসেবে তৈরি হয় Temple of Heaven. গোটা এলাকা জুড়ে রয়েছে অনেকগুলি বিল্ডিং, একে অপরের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই তৈরি হয়েছে Hall of prayer of good harvest, The imperial vault, Temple of Sun, Temple of Earth, Temple of Moon. মূল Temple এলাকা থেকে বেরিয়ে চারপাশে সাজানো বাগান, নানান গাছ, ফুল। উত্তর, পূর্ব, দক্ষিণ, পশ্চিম সব দিক দিয়েই ঢোকার ব্যবস্থা আছে। শুধু বাগানের এন্ট্রি ফি আলাদা, Temple-সহ টিকিট আলাদা। পার্ক-এর টিকিট কেটে ঢুকে গিয়ে ভিতরেও Temple-এ ঢোকার টিকিট পাওয়া যায়। কম্বাইন্ড টিকিট ভারতীয় টাকায় 400 মতো। Temple গুলো ঘুরে দেখতে বেশি সময় লাগে না। বরং তার চেয়ে বসে বসে প্রকৃতির রূপ দেখার সুখ বেশি। চায়নার সব জায়গাতেই ভীষণ হাঁটা। Temple of Heaven-এ ঢুকে পুরোটা ঘুরতে যা সময় লেগেছিল তার দ্বিগুণ সময় লেগেছিল অন্য গেট দিয়ে বেরোতে। ঝরা পাতা, গাছের রংবদল দেখতে দেখতে মাইল খানেক হেঁটে অবশেষে Beijing ঘোরা পর্ব শেষ করে বেরিয়েছিলাম। তারপর হোটেল থেকে মালপত্তর নিয়ে সাবওয়ে ধরেই সোজা রেল স্টেশন। বেজিংকে টাটা করে নতুন গন্তব্যের পথে যাত্রা শুরু।
সার্বিকভাবে Beijing সুন্দর সাজানো শহর। কিছু পুরনো ঐতিহ্য এখনও বজায় থাকায় প্রাচীন ও নতুনের সহাবস্থান চোখে পড়ে অনেক জায়গাতেই। পাবলিক টয়লেট রাস্তার মোড়ে মোড়ে। পরিচ্ছন্নতা চমকে দেওয়ার মতন। খাওয়াদাওয়া নিয়ে সমস্যা তেমন নেই। খুব অসুবিধে হলে চেনা নামের চেইন ব্র্যান্ডগুলোতে ঢুকে পড়লেই হবে। গোটা বেজিং ঘোরায় যে সমস্যাগুলো সবচেয়ে বেশি ভোগ করেছি তার মধ্যে অন্যতম হল ভাষা। অফলাইনে গুগল ট্রান্সলেটর থাকলেও কথা বোঝাতে প্রায়শই খুব বেগ পেতে হয়েছে। খাওয়া-দাওয়া থেকে সাবওয়ে কার্ড জমা করে টাকা ফেরত নেওয়া সর্বত্রই ভাষাগত সমস্যার জন্য সময় অপচয় হয়েছে বেশ খানিকটা। wechat থাকলেও সবসময় তার সঠিক প্রয়োগ সম্ভব হয়নি। তবে সাধারণ মানুষ উপকার করার চেষ্টা সর্বোতভাবে করেছেন সব সময়ই। দ্বিতীয় সমস্যা ড্রেনেজ সিস্টেম। সন্ধে নামার পরই রাস্তাঘাটে মাঝেমধ্যেই ড্রেন থেকে উঠে আসা গন্ধ পাওয়া যায়। হোটেল-এ একতলার রুমে বাথরুম-এও এ সমস্যার আশঙ্কা রয়েছে। তবে সকাল হলেই গন্ধ হাওয়া হয়ে যায়। তৃতীয় সমস্যা, বেজিং তথা চীনের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরা মানে অনেকটা হাঁটতে পারার মতো ফিটনেস দরকার। পার্ক হোক বা প্রাচীন নিদর্শন কিংবা শপিং স্ট্রিট, হাঁটা এখানে সর্বক্ষণের সঙ্গী। আর একটা সমস্যার কথাও না বললেই নয়। চীনের ট্যুরিস্ট। এখানে বেশিরভাগ মানুষই ট্যুর অপারেটর-এর সঙ্গে বেড়াতে বেরোয়, গাইডের চিৎকার, টুরিস্টদের হট্টগোল অনেক সময়ই বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ শহরটাকে ভালো করে চেনার জন্য 3-4 দিন যথেষ্ট নয় মোটেই। শুধু টুরিস্ট স্পট ছাড়াও বেজিং-এ ভালোলাগার মতোন অনেককিছু আছে। শহরটাকে চিনতে, বুঝতে সময় লাগে আরও বেশি। এবার সে সময় হাতে ছিল না, জানি না, পরে কখনও হয়তো….।
চীন ভ্রমণের দ্বিতীয়াংশ জানার জন্য click করুন এখানে।
চীন ভ্রমণের তৃতীয়াংশ জানার জন্য click করুন এখানে।