Bike ride to Bankura
পথ যদি না শেষ হয়, বাইক চড়লে বেশ হয় ব্যাপারটা আমার বেশ পছন্দের। তাই লম্বা ট্রিপের চেয়ে টুকটাক বাইক ট্রিপ-এ বেরিয়ে পড়ায় আমার উৎসাহ বেশি থাকে। কিন্তু লং বাইক ট্রিপে আমার হাতেখড়িটা সময় ও সুযোগের অভাবে একটু দেরিতেই হয়েছে। আমার প্রথম ট্রিপ বলা যায় এমন বাইক ট্রিপ বাঁকুড়ার (Bankura) জয়পুর ফরেস্ট-এ। তার আগে টুকটাক ভাঙর, কোলাঘাট গেছি কয়েকবার। তবে একদিনে যাওয়া আসা মিলিয়ে অত কিলোমিটার বাইক চড়া বাঁকুড়ার (Bankura) পথেই প্রথম।
প্ল্যানটা হয়েছিল হুজুগের মতোই। অর্কর রাইড পাগল বন্ধুদের একটা গ্রুপ আছে। যাদের অনেকেই বিয়ে থা করে বাইক ট্রিপ করা ভুলতে বসেছে। সেরকমই এক বন্ধু পুরনো ভালোলাগা উস্কে দিয়ে উদ্যোগটা নিল। সঙ্গে জুটে গেল আরও দুজন ব্যাচেলর বন্ধুও। প্ল্যান হল সকাল সকাল বেরিয়ে ওখানে একটু ঘুরে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে আবার কলকাতায় ফেরা হবে। অর্ক আমায় প্রস্তাব দিতে আমি এক কথায় রাজিও হয়ে গেলাম। 2017 সালের নভেম্বরের এক রবিবার দিন ঠিক হল।
সকাল সকাল মিট করে রওনা দেওয়ার প্ল্যান। সময় লাগবে ৩-সাড়ে ৩ ঘণ্টা। এদিকে শীতের সকালে ঘুম ভাঙা যে কি কষ্টের! ঠিক হওয়া টাইম-এ যথারীতি পৌঁছল না কেউ। যখন চিনারপার্ক থেকে সকলের বাইকের চাকা একসঙ্গে ঘুরল তখন ঘড়িতে প্রায় 8 টা! বাইক এয়ারপোর্টের রাস্তা ধরে চলতে শুরু করল। রবিবারের সকাল, রাস্তা মোটামুটি ফাঁকাই। এয়ারপোর্ট আড়াই নম্বর গেট ছাড়িয়ে বেলঘড়িয়া এক্সপ্রেস ওয়ে-এর রাস্তা ধরলাম। আমরা মোট 5 জন, বাইক 4 টে, পিলিয়ন একমাত্র আমিই। বেলঘড়িয়া এক্সপ্রেস ওয়ে-তে উঠে গতি বাড়ল বাইকের। দক্ষিনেশ্বর হয়ে ডানকুনি হয়ে ন্যাশনাল হাইওয়ে 2 ধরে সিঙ্গুর পৌঁছে গেলাম 1 ঘণ্টার মধ্যেই। শীতের রোদ মেখে হাইওয়ে ধরে ছুটে চলার মজাই আলাদা। সিঙ্গুর থেকে বাঁদিকে চলে গেছে তারকেশ্বর হয়ে আরামবাগের রাস্তা। সেদিকেই লাইন দিয়ে চলল আমাদের বাইকবাহিনী। এদিকে গাড়ি-ঘোড়া আছে বেশ, বাজার, সকালের ব্যস্ততা, বাস-লরি কাটিয়ে আমরা চলতে লাগলাম। এলাকা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাওয়া মানুষ দেখতে বেশ লাগে, তাদের কথা বলা, হাঁটা-চলার ধরণ জায়গাটার সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করায়। আমরা চলতে চলতে পৌঁছে গেলাম পল্লীশ্রী মোড়। এখান থেকে ডানদিকে রাস্তা চলে গেছে কালীপুরের দিকে। আমরা পল্লীশ্রী মোড়ে বাইক সাইড করলাম। সকালে শুধু জল খেয়ে বেড়িয়েছি, পেটে ছুঁচোরা ছুটোছুটি করছে। মোড়ের মাথাতেই মিষ্টির দোকান। সেখানে বেশ ভিড়ও। ঢুকে দেখলাম গরম গরম কচুরি রাখা ঝুড়িতে। সবাই টেবিলে বসে পড়লাম। কচুরি, তরকারি খাওয়ার পর মিষ্টিগুলো খুব ডাকতে লাগল। টপাটপ খেয়ে নিলাম দুটো রসমালাই, আহ কি তার স্বাদ, এখনও মনে পড়লেই খেতে ইচ্ছে হয়। দামে কলকাতার মিষ্টির হাফ, স্বাদে দ্বিগুণ। বাকিরাও যে যার পছন্দমতো মিষ্টি টেস্ট করল জমিয়ে।
ততক্ষণে ঘড়ি 11 টা ছাড়িয়ে গেছে। আমরা কালীপুর মোড়ের ঢুকে যাত্রা শুরু করলাম। এখানে ঢোকার মুখ থেকে খানিকটা রাস্তায় খানাখন্দ ছিল সে সময়। চলতে চলতে পৌঁছে গেলাম কতুলপুর। এখান থেকে জয়পুর ফরেস্ট 20-21 কিমির বেশি না। রাস্তা ঝকঝকে, দুদিকে কখনো গাছ, কখনো ধূ ধূ মাঠ। রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা, মাঝে মধ্যে কিছু বাইক লরি পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। গ্রাম্য রাস্তার একটা মায়া আছে। কখনো চোখে পড়ল দুটো সাইকেল পাশাপাশি কথা বলতে বলতে চলেছে বা আলপথ ধরে হেঁটে যাচ্ছেন দুই গ্রাম্য মহিলা। কখনও দুদিকে ধান গাছের সিনারি, কখনো হুট করে রাস্তায় উঠে আসা ছাগল ছানা, কোথাও মাঠে হেলে-দুলে চলতে থাকা গরু ছোটবেলায় আঁকা ছবি মনে করিয়ে দেয়।
নির্ঝঞ্ঝাট রাস্তায় পড়ে মোটরসাইকেল-এর গতি বাড়ছে। খানিক চলার পর ঢুকে পড়লাম ফরেস্ট-এর পথে। দুদিকে জঙ্গল, মাঝখানে ঝকঝকে রাস্তা। তখন প্রায় 1 টা বাজতে যায়। পিলিয়ন সিট থেকে দেখলাম পালসার 200-এর মিটার 100 ছুঁয়েছে। কখনো সোজা চলছি আবার কখনো রাস্তার বাঁকে কার্ভ নিয়ে ঘুরছে বাইক। দুপুর রোদেও ছায়া ছায়া ঘেরা পথ। মাঝে মাঝে দুদিকে খাঁড়ি। বর্ষায় এলে সেখানে পা ডুবিয়ে দু-দণ্ড বসা যায়। একেবারেই নিরিবিলি, জঙ্গলের ভিতর দিয়ে রাস্তা ঢুকে গেছে ভিতরের গ্রামে। এক সময় এ এলাকায় মাওবাদীদের রাজ ছিল, মানুষ রীতিমতো ভয় পেত আসতে। এখন কালেভদ্রে হাতি দেখা যায়। কিন্তু আমাদের সে সৌভাগ্য হয়নি। আমরা জঙ্গলের রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটু আশপাশটা হেঁটে দেখলাম। বেশিরভাগই শাল গাছ। পলাশ, কুসুম, নিম, মহুয়াও আছে। রাস্তায় মাঝে মাঝে লরি যাচ্ছে, বাকি শুনশান। রাস্তায় বসে ছবি তোলার পাগলামি, হৈচৈ চলল কিছুক্ষণ। ফাঁকা জঙ্গলের পথে তখন আমাদেরই রাজ!
জঙ্গলের ভিতর ঢোকা হবে কিনা তাই নিয়ে খানিক মতবিরোধের পর ঠিক হল একপাক ঘুরে আসাই যায়। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ছিল যাওয়া মেঠো পথ ধরে আবার লাইন দিয়ে ঢুকে পড়ল বাইকবাহিনী। ভিতরের রাস্তা সরু, জঙ্গল আরও ঘন। আলো আরও কম। এল ছায়ার মধ্যে দিয়ে ধুলো উড়িয়ে চলেছি আমরা। এসব রাস্তায় ঢুকে পরে মনে হয় সত্যিই পথ যেন না শেষ হয়…! খানিকটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার পর মাটির বাড়ি চোখে পড়ল। সেখানে মেঠো পথ, টিনের চালের মাটির বাড়ি। আমরা সেই অব্দি গিয়ে আবার বাইক ঘুরিয়ে বাইরের মূল রাস্তায় চলে এলাম।
তখন 2 টো বেজে গেছে। খিদে পেয়েছে সকলেরই। এখানে থাকা-খাওয়ার জায়গা বলতে জঙ্গল লাগোয়া বনলতা রিসর্ট। এখানে শুধু খাওয়াদাওয়ার জন্যও যাওয়া যায়, আবার জঙ্গলের কাছে কটেজ বা রুমে থাকারও ব্যবস্থা আছে। ফার্ম হাউজ মূলত স্থানীয় স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মানুষদের দ্বারা পরিচালিত। সামনে খাবার জায়গা, পিছনে বিশাল এলাকা জুড়ে চাষবাস, থাকার জায়গা। এমু, টার্কি ঘুরে বেড়াচ্ছে। খরগোশ, ছাগল, হাঁস-মুরগি সবই চাষের। পার্কিং-এর ব্যবস্থা আছে। আমরা রেস্টুরেন্ট-এর সামনে গিয়ে দেখলাম ভিড় আছে। বাইক রেখে অপেক্ষায় থাকতে হল কিছুক্ষণ। রেস্টুরেন্ট পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন মহিলারা। হাসি মুখে অর্ডার নিচ্ছেন, খাবার সার্ভ করছেন। আমরা মিনিট 15 পরে সুযোগ পেলাম বসার। মেনু কার্ড-এ লম্বা লিস্ট। বেশিরভাগই বাঙালি পদ। নিরামিষ পদ অনেক আছে। আমিষে আমাদের সাধারণ মুরগি, পাঁঠার পাশাপাশি এমু, টার্কি, কোয়েল, হাঁসও জায়গা করে নিয়েছে। আমরা আমিষ নিরামিষ মিলিয়ে অর্ডার করলাম। পোস্তর বড়া, ডাল, আলু-পটলের তরকারি, মাংস, চাটনি, পাঁপড়-সহ কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া-দাওয়া হল। খেয়ে উঠে আশপাশ-টা হেঁটে বেড়ালাম একটু। ততক্ষণে পাখিদের ডাক শোনা যাচ্ছে। বিকেল হব হব। জঙ্গলের মধ্যে এমনিই আলো ঢোকে কম, 4 টে বাজার আগেই আলো-আঁধারি। আমাদের আবার এতটা পথ বাইকে ফেরা। তাই বেশি সময় ব্যয় না করেই রওনা দিলাম।
বাইক আবার ছুটে চলল শাল-পলাশের সারি দুপাশে রেখে। জঙ্গল পেরিয়ে আবার এসে পড়লাম দুদিকে ধানক্ষেত ভরা চওড়া রাস্তায়। শেষ বিকেলের আলোয় ধানের শিস চিকচিক করছে। থেমে গেল বাইক। কমলা হতে থাকা আকাশ দেখলাম। একেই বোধয় গোধূলি বলে। আমরা আবার চলতে শুরু করলাম। বাইকের পিছনে বসে কমলা সূর্যের ডুবে যাওয়া দেখলাম একসময়। তখন আমি বুক ভরে প্রকৃতি গিলছি, কোথায় পৌঁছেছি সে বিষয়ে সঠিক ধারণা নেই। সন্ধে নামল, বাইক ছুটে চলল হেডলাইটের আলোপথ ধরে। তারকেশ্বর-এ এসে চা খেতে নামা হল। তখন বুঝলাম পিঠে হেব্বি ব্যথা। প্রথম এতক্ষণ ধরে বাইকে চড়ার ফল যে টের পাব তা বুঝলাম। তখন ঠান্ডা লাগছে সকলেরই কম-বেশি। চা শেষ করে আবার ছুটে চলা। যাওয়ায় পথ ধরেই যখন এয়ারপোর্ট চত্বরে এসে পৌঁছলাম তখন 8 টা বাজে প্রায়। সবাই সবাইকে টাটা করে বাড়ির রাস্তা নিলাম মন ভালো করা দিনের শেষে।