আমার চিরকালই বড় রাস্তার থেকে গলি বেশি পছন্দের। ছায়া ছায়া, ফুলের গন্ধে ভরা, ধাক্কা খাওয়ার ভয় কম, আবোল তাবোল ভাবনায় হেঁটে চলার সুবিধা। মফস্বলে বড় হওয়ায় অলি-গলি ঘুঁজিগুলো আমার জীবনে জড়িয়ে ছিল খুব। আমাদের বাড়িটাই ছিল একটা গলির শেষ প্রান্তে। অনেককেই বাড়ি কোথায় বলতে গিয়ে ‘ওই যে গলিটা আছে না…’ বলেছি। কিংবা কাউকে কোনো রাস্তা বোঝাতে গিয়ে দত্ত পাড়া থেকে মান্না পাড়া হয়ে মুখার্জি পাড়ার গলি ফিরে এসেছে মুখে। আমার রাস্তা চিনতে শেখা গলি চিনেই, ওই যেমন গলির সামনে ডাস্টবিন-টা, চপের দোকানটা, তারা মা মেডিকেল বা ভ্যারাইটি স্টোরস-টা মনে রাখা। কোনও কোনও গলির আবার গাছ-ফুল-ও মনে থাকতো, গন্ধগুলো মাথায় ঘুরতো। অমলতাস, কাঞ্চন, বকুল, বগেনভেলিয়া, কৃষ্ণচূড়া নতুন গলিতে ল্যান্ডমার্ক হয়েছে কতবার। সেইসব গলিতে শেষ বিকেলে সাইকেল থেমে যেত, সন্ধে নামতো চোখের সামনে। কিংবা আচমকা বৃষ্টিতে ভিজে যেত মন খারাপগুলো।
আমার ফেলে আসা শহরে কিছু গলি ছিল খুব আপন। যেমন প্রিয় বন্ধুর বাড়ির গলিটা, স্যারের বাড়ি ঢোকার আগে গল্প জমার গলি টা, ঘাড় ঘুড়িয়ে ওর বাড়ির জানলা দেখতে পাওয়া গলিটা, পাশাপাশি হেঁটে যাওয়ার গলিটা। সে সব এখনও চোখ বুঝলে স্পষ্ট। আমাদের সাবধানী সাইকেল গলিতে ঢুকে আকাশ দেখার স্বাধীনতা পেত। পেত মান-অভিমান মেটানোর অবসর। বয়ঃসন্ধির প্রথম চুমু। কুড়িয়ে পাওয়া ফুল। আরও না বলতে পারা কত কী!
যে গলিগুলো রোজনামচার সঙ্গে মিলে থাকতো, পুজোর সময় সেই গলিগুলোই পাল্টে যেত। ভিড়, আলো, খাবারের স্টল, মেলার নাগরদোলা। চেনা রাস্তার ভিড় এড়াতে পরিচয় হত কত নতুন গলির সঙ্গে। যাওয়া বারণ গলিগুলোতেও বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে যাওয়া হিয়ে যেত। অচেনা বাড়িতে বেল বাজানোর দুস্টুমি সে সব গলিতেই হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে গ্রুপ-এ থাকা কাপল-দের গলির মধ্যে একটু একা সময় খুঁজে দেওয়ার পাগলামি। নতুন জুতো হাতে অচেনা বাড়ির রকে বসে পড়া, কারণে-অকারণে হাহা-হিহি।
কলকাতা চিনতে শিখে কিছু গলির সঙ্গে প্রেম হয়েছিল খুব। কলেজ পাড়ার গলি, সাদার স্ট্রিট, প্রিন্সেপ ঘাটের ভিতরে বিউটিফিকেশন হওয়ার আগের গলিপথ, ফিয়ার্স লেন, গিরিশ পার্ক, শ্যামবাজার, হাতিবাগান, বাগবাজার চত্বরের নাম না জানা গলি, কুমোরটুলির গলিতে যতবার হেঁটেছি নতুন নতুন গল্প তৈরি হয়েছে। নতুন করে এ শহরটার সঙ্গে আলাপ জমেছে। ভালোবাসা বেড়েছে। যেমন প্রথম দেখাতেই প্রেম হয়েছে বেনারসের গলিগুলোর সঙ্গে। বাঙালি টোলার গলিতে অন্ধকারে হেঁটে চলা, ব্লু লস্যি সপ খুঁজে বের করতে এ গলি সে গলি হেঁটে যাওয়ার উৎসাহ, প্রতি বাঁকে অমূল্যরতন খুঁজে পাওয়ার আনন্দ, মনের ভিতর চিরকালীন জায়গা করে নিয়েছে। শান্তিনিকেতনে কামারপাড়ার লাল মাটির গলি বা রতনপল্লীর ছায়া ঘেরা গলিপথও একইভাবে মন জুড়ে আছে।
গলি নিয়ে নস্টালজিয়ার পাশাপাশি ছড়ানোতেও আমার জুড়ি নেই। কতবার চেনা গলি গুলিয়ে ফেলেছি। কনফিডেন্টলি ঠিকানা জেনেও ভুল গলিতে ঢুকে পাক খেয়েছি। আমাদের মফস্বল শহরে রাস্তাঘাট এমনিতেই সরু। তাতে আমার গলি সম্পর্কে যে একটা মিসকনসেপশন হয়েছিল তা বুঝেছি অনেক পরে। বড় রাস্তা থেকে ডান, বাম বা ভিতরের দিকে কোনও রাস্তা ঢুকে গেলেই আমার সেটাকে গলি মনে হত। সে তাতে লরি ঢুকে গেলেও! কেন হত সে প্রশ্নের উত্তর নেই। তাতে অসুবিধাতেও পড়েছি অনেক। কলকাতায় এসে ছড়িয়েছি আরও। ফোনে যে রাস্তাকে গলি বলেছি উল্টোদিকের লোক মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলেছে সেখানে গলি কোথায় আছে ভাবতে গিয়ে! কিন্তু আদতে গলি বলার শুরুটা ঠিক কোথা থেকে হয় আমি ধরতে পারিনি। আমার নিরিবিলি ছায়া ছায়া সুন্দর বাড়িওয়ালা রাস্তা দেখলেই গলি মনে হয়েছে বার বার। দক্ষিণ কলকাতার রাস্তা আর গলির কনফিউশন কাটিয়ে ওঠার জন্য এখনও লড়ে গেলেও উত্তর কলকাতাটা সেদিক থেকে সরল-সোজা। আমাদের মফস্বল ভাবটা ওখানেও আছে। গলির ভিতরে ঘেঁষাঘেঁষি বাড়ি, ক্রিকেট, রক, কল তলা, চেনা তবু অচেনা ধরণের কাকুদের হেঁটে যাওয়া, এমন রাস্তাকে গলি ছাড়া অন্য কিছু বলতে ইচ্ছেই হয় না। সে সব গলি আমার, আমাদের অনেক হেঁটে যাওয়ার সাক্ষী।
আসলে মফস্বল ছেড়ে শহরে এসেও মনটা গলি ঘুঁজিতেই আটকে গেছে। তাই শহরে থেকেও গলির সুখ খুঁজি। অনামি দোকানের কচুরিতে কামড় দিয়ে বাড়ির গন্ধ পাই। কিংবা শহুরে কোনো শিমুল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে প্রিয় বন্ধুর বাড়ির গলিটায় চলে যাই। গলির ভিতরে লাল রক পুরোন কত গল্প মনে করিয়ে দেয়। কত ভুলে যাওয়া হাসি আবার চাগার দিয়ে ওঠে। হাঁটি হাঁটি পায়ে পিছুটানগুলো আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে যায় বর্তমানের সঙ্গে।