শান্তিনিকেতন-এ আরও আকাশ বলে একটা বাড়ি আছে আগেই জানতাম, নামটার মধ্যেই একটা ‛আয় আয়’ ডাক আছে। কিন্তু বোলপুর স্টেশন ও ইউনিভার্সিটি চত্বর থেকে খানিক দূরে হওয়ায় এখানে কখনও গিয়ে থাকা হয়নি। একটা রবিবারের দুপুরে এক বন্ধু একটা ছোট্ট মেসেজ ফরওয়ার্ড করল আরও আকাশ-এ পূর্ণিমায়া মুনলাইট কনসার্ট নিয়ে। সঙ্গে লিখল, “যেতে চাই, যাবি?” শান্তিনিকেতন-এর কামার পাড়ায়, আরও আকাশ ও আশেপাশের আরও 4-5 টি বাড়ির সদস্যরা যাদের কাছে বোলপুর “হোম আওয়ে ফর্ম হোম”, তারা মিলে এলাকার মানুষজনের সহযোগিতায় এই পূর্ণিমায়া মিউজিক কনসার্ট এর আয়োজন করছেন গত বছর থেকে, এটা তৃতীয় পূর্ণিমায়া। ভাবতে সময় নিলাম না এতটুকুও, চাঁদের আলোয় খোলা আকাশের নীচে গান শুনতে পারার ডাক কি না শুনে থাকা যায় নাকি! ঠিক হল এটা বর বর্জিত আউটিং হবে। সঙ্গে সঙ্গে টাকা পাঠিয়ে বুকিংটা সেরে ফেললাম। খাওয়া-দাওয়া, থাকার ব্যবস্থা ওনারাই করে রাখবেন। তারপর যা বাকি থাকে ট্রেনের টিকিট কাটা আর বনলক্ষ্মী-তে রবিবারের লাঞ্চ-এর প্ল্যানটা সেরে ফেলা গেল নিমেষেই। সঙ্গে জুড়ে গেল আর এক বান্ধবীও।
24 নভেম্বর কনসার্ট। আমাদের ট্রেন সেদিনই সাতসকালে। 3 জনে হাওড়া স্টেশনে মিট করে ট্রেনে চড়ে বসলাম। নানান গল্পে গড়িয়ে গেল সময়। দুপুর 12 টা নাগাদ বোলপুর স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখি পূর্ণিমায়া-র বোর্ড হাতে লোক দাঁড়িয়ে। সেখানে গেস্টদের বিভিন্ন বাড়িতে পাঠানো হচ্ছে বিভিন্ন গাড়িতে। আমরা জানলাম আমাদের থাকার জায়গা হয়েছে আরও আকাশের কাছেই কলাভূমিতে। পৌঁছে দেখলাম ঘাসের লন, মাটির বাড়ি। একদিকে বারান্দাওয়ালা দোতলা, অন্যদিকে কলাভবনের আদলে কালো রঙের মাটির বাড়ি। সেটিই আমাদের সে রাতের আশ্রয়। এটা মাটির দোতলা, থাকব আমরা 3 জনেই। আরও আকাশ-এ থাকার আশা নিয়ে এসে মন ভাঙল এখানে। জানলাম অনেক লোকজন হওয়ায় আশেপাশের বাড়িগুলোয় ভাগে ভাগে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। আমার বান্ধবী আগে আরো আকাশ-এ থেকে গেছে। সেই মাটির দোতলা আর এই দোতলায় অনেক ফারাক। বিছানা-বালিশ তেমন ঝকঝকে না, বাথরুমে বেসিক জিনিসগুলোও নেই। কিন্তু তখন পরিস্থিতি এমন যে সেরকম কিছু করার নেই। নিজেকে বোঝালাম শুধু তো রাতটুকু, বাকি সময় ঘুরেই কেটে যাবে। খাওয়া দাওয়া, অনুষ্ঠান সবই আরও আকাশ-এ। আমরা জিনিসপত্র রেখে ফ্রেস হয়ে সেদিকেই এগোলাম। গাড়ি করে যাওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও চারপাশটা দেখার জন্য পায়ে হাঁটা পথই বেছে নেওয়া গেল। মাটির বাড়ি, সরু গলি পথ, ঘুঁটে গোয়ালের গন্ধ পেরিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম আরো আকাশ-এর নীচে।
গেটের মাথা জুড়ে মাধবীলতা, বগেনভেলিয়া। ভিতরে মানুষের ভিড়, হাসি, কোলাহল। লাঞ্চ শুরু হয়ে গেছে। ভিতরে ঢুকতেই বাড়ির ওনার সুচন্দ্রা দি ও উদয় দা ওয়ার্ম ওয়েলকাম জানাতে এগিয়ে এলেন। আলাপ হল ক্যাটারিংয়ের দায়িত্বে থাকা সদাহাস্যমুখ লাল দার সঙ্গে। এখানে একপাশে মাটির তৈরি বসে খাওয়ার জায়গা, এমনি দিনে টুরিস্টরা সেখানেই বসে খান। কিন্তু এখন লোকসংখ্যা বেশি হওয়ায় অন্যপাশটা ঘিরে খাবার ও বসার জায়গা করা হয়েছে। ঘি, ভাত, বেগুন ভাজা, শুক্তো, ডাল, মাছের কালিয়া আর চিনিপাতা দই দিয়ে পেট ভরে খাওয়া হল। আমাদের প্যাকেজেই শনিবার দুপুর থেকে রবিবার দুপুর অব্দি খাওয়া ধরা। এ বাড়িটায় এসে আরও মন কেমন হল। বার বার মনে হতে থাকল এখানটায় থাকতে পেলে তো বেশ হত। আমরা খেয়ে-দেয়ে মাটির গেট পেরিয়ে চলে গেলাম আরও আকাশের থাকার জায়গা ঘুরে দেখতে। এখানে অন্য বোর্ডাররা থাকায় বাইরে থেকে দেখেই আনন্দ। প্রথমেই মাটির গেট পেরিয়ে ঢুকে দোক্কা (মাটির দোতলা), তারপর সরু রাস্তা ধরে একটু এগোলেই এক্কা (মাটির একতলা)। কি শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ, গাছপালা, ফুল, পাখি, প্রজাপতি, প্রকৃতির কোলে থাকার দারুন আস্তানা। দুটি বাড়ির সামনেই নিজস্ব দোলনা আর রোদ পরা উঠোন আছে। আরও আকাশ-এ এসে থাকতে চাইলে এই দুটি বাড়িতেই বর্তমানে থাকা যায়। খাওয়ার ব্যবস্থা রাম দা-ই করে দেন। এখান থেকে বেরোনোর সময় ঝোপের আড়ালে দেখলাম পুকুরের ধার ঘেঁষে বাঁধা মিউজিক কনসার্টের মঞ্চে ফাইনাল টাচ চলছে।
আগে থেকেই জানা ছিল সুচন্দ্রা দি-দের নিজের বাড়িটি ভারী সুন্দর। সেখানে আগে সাধারণের থাকার ব্যবস্থা থাকলেও এখন বন্ধ। তবে বাড়ির চত্বর ঘুরে দেখাই যাবে এখানে থাকলে। আমার বন্ধুর সঙ্গে আগে থেকে আলাপ থাকায় বাড়ির ভিতর ঘুরে দেখার ছাড়পত্রও পেয়ে গেলাম। আমরা গুটি গুটি সেদিকেই পা বাড়ালাম। লোহার গেট-এ বাহারি গাছ। গেট ঠেলে ভিতরে ঢুকে মনে হল সবুজের মাঝে একটা ছোট খাটো আর্ট এক্সিবিশন-এ ঢুকে পড়েছি। ঢুকেই দুদিকে বসার জায়গা, বাঁশ কেটে বানানো ফ্রেম-এ ফুল, প্রদীপ দিয়ে সাজানোর জায়গা করা। সামনের গাছে বসে আছে সেরামিকের লাল পাখির দল। আসে পাশে ছড়ানো পাথর, কাঠের স্কাল্পচার, লোহার আর্টিফ্যাক্টস। এখানটা খুব শান্ত। লোকজন কথা বললে বা চলাফেরা করলে শুধু শব্দ, না হলে পাখির ডাক, পাতার মড়মড়। আর একটু এগিয়ে একতলা মাটির বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। বাড়িতে ঢোকার লনটার দুদিকে কমলা রঙের রঙ্গন ফুটে আছে থোকা থোকা। নানান রঙের প্রজাপতি সেখানে পাখনা মেলে বেড়াচ্ছে। মাথার উপর আকাশটা সত্যিই আরও বিস্তৃত মনে হল। বাড়ির সামনে নানান ফুলের গাছ। দাওয়ায় খাটিয়া পাতা। দেওয়াল জুড়ে মাটির নকশা, হাতে আঁকা রঙিন ছবি, ছোট ছোট স্কাল্পচার। ভিতরে নকশা কাটা মাটির দেওয়ালে ফুল, পাখি, গাছ, সাঁওতালি ছবি, মাটির বসার জায়গা, তার দুপাশে দুটো ঘর, বইয়ের তাক, মাথা তুলে তাকালে চমক, খড়ের চালের মধ্যিখানটায় গ্লাসপেন্টিং, সেখান থেকে নেমে আসা রঙিন আলো ধুয়ে দিচ্ছে ঘর।
এরপর আমরা চলে এলাম বাইরে বাঁধানো উঁচু মণ্ডপের মতো জায়গায়। এর চারপাশে কাঠের স্কাল্পচার করা থাম। লতানে গাছ উপরের রেলিং বেয়ে ডালপালা মেলেছে। ঝুলন্ত টবে বাহারি গাছ। এই দোলনায় বসে একটা শীতের দুপুর, কিংবা শিশির ভেজা ভোর, কিংবা কাকভেজা সকাল পেলে বেশ হত। চারপাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো প্রচুর সবুজ, পিছনে ঘেরা জায়গায় নিজস্ব চাষবাস, ডানপাশে গাছের ফাঁকে একখানা কাঠের বালিশ-বিছানা বিহীন খাট রাখা, এ জায়গাটায় বসে থাকার জন্য একটু শীত আর এক কাপ চা-ই যথেষ্ট।
সন্ধে 6 টা থেকে পূর্ণিমায়া-র কনসার্ট শুরু। তার আগে আমরা 3 জন টোটোয় চড়ে চক্কর দিতে বেরিয়ে পড়লাম। অনেকেই শনিবারের হাটে গেল। এই প্রথমবার শনিবারের হাট-কে খানিক উপেক্ষা করে ঘুরে এলাম আলচা, তানজিল। দুটোই ইউনিভার্সিটি চত্বরে। টোটোয় চড়ে কামারপাড়া থেকে বেশ খানিকটা সময় লাগবে। আলচা স্বনির্ভর গোষ্ঠী, এখানকার মেয়েরা ঘর সাজানোর জিনিস থেকে ব্যাগ, গয়না সবই বানায়। কলকাতার থেকে দামেও কম। তানজিল একটা ছোটখাটো আর্ট গ্যালারি। নানান প্রদেশের শিল্প নিদর্শন থেকে শাড়ি, গয়না সবই আছে। সঙ্গে মুখ চালাতে চা-কফি-কাপ কেক-ব্রাউনি আর মিউজিক। এখানে বসে আড্ডা দিতে দিতে 5 টা বাজিয়ে ফেললাম। কালোবাড়িতে টোটোয় করে ফিরতে ফিরতে অন্ধকার হয়ে গেল পুরো। একটু শীত শীতও লাগতে শুরু করেছে তখন। আমরা তৈরি হয়ে নিলাম অনুষ্ঠানের জন্য। 6 টার জায়গায় সাড়ে 6 টা হল।
আরো আকাশ-এ যেতেই চা মুড়ি চপ। তারপর ময়রা পুকুরের পাড়ে গিয়ে বসা। সেদিকে এগোতেই মনটা আনন্দে ভরে গেল। পুকুরের জলে লাইন দিয়ে ভাসানো প্রদীপ। প্রদীপের রেখা বেনারসের দেব দীপাবলি মনে করিয়ে দিতে বাধ্য, ঘটনাচক্রে এবার দেব দিপাবলিও এ সময়ই ছিল। একপাশে সন্ধ্যা আরতির প্রদীপ জ্বলজ্বল করছে। স্টেজ-এর পিছনে বাঁশের ফ্রেমে প্রদীপ, ফুলের সাজ। আসে পাশের সব গাছের গুঁড়ি থেকে ঝুলছে লন্ঠন। টিমটিমে আলোয় এগিয়ে গেলাম বসার জায়গার দিকে। এই জায়গাটার পিছনে বড় বড় গাছ, সেখান থেকে ঝুলে থাকা গোল গোল ইলেক্ট্রিক আলো মায়ার জাল বুনছে। পুকুরের একদিকে বসার জায়গা, সেখান থেকে সামনে সোজা তাকাতেই পূর্ণিমায়া-র স্টেজ, স্টেজ-এর পিছনে 8-10 টা তালগাছ আর ব্যাকলাইট অপূর্ব ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরি করেছে, তার পাশে দুটো গাছের ফাঁকে আটকে আছে পূর্ণিমার চাঁদ। এসব দেখে আমার চন্দ্রাহত হবার মতোই অবস্থা। এর আগে ওপেন এয়ার মানে যাদবপুরে OAT -তে পটা, ফসিলস কিংবা কলেজ সোশ্যাল উদ্দাম নৃত্য। এ পরিবেশ অন্য। এখানে সেতার, সরোদ, তবলায় শাস্ত্রীয় সুর। ভেবেছিলাম মশা থাকবে খুব, কিন্তু সিটরিনেলা আর ধুনোর দৌলতে সে সমস্যা নেই। বরং ধুনোর ধোঁয়া মাঝে মধ্যে বেড়ে গিয়ে আরও মায়াবী করছে পূর্ণিমার সন্ধে। ক্যালেন্ডার মতে পূর্ণিমা ছিল শুক্রবার, কিন্ত মায়া তাতে কিছু কমেনি। অনুষ্ঠান শুরুর আগেই শুনলাম পূর্ণিমায়া-র ভাবনা ও পরিকল্পনা নিয়ে দু-চার কথা। যাঁরা এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন তাঁরা সকলেই কলকাতাবাসী, কিন্তু শান্তিনিকেতনের কামারপাড়ায় সেকেন্ড হোম-এ তাঁরা প্রায় প্রতি উইকেন্ডেই এসে হাজির হন সেই কবে থেকে। এমনই 5 বন্ধু গল্প করতে করতে এক সন্ধ্যায় ভেবে বসেন কামারপাড়ায় পূর্ণিমার রাতে গান-বাজনা করলে কেমন হয়! বেশ চাঁদের আলো বাদ্যযন্ত্রের মূর্ছনায় রাত নামবে এই পাড়া গাঁ-এ, সুরের জোৎস্নায় ভিজে যাবে মন। কিন্তু শুধু তো ভাবনা ভাবলেই হল না, তার প্রয়োগ তো চাড্ডিখানি কথা নয়! গ্রামের মানুষ সহযোগিতা করবে কিনা, ঝামেলা অশান্তি হবে কিনা, শিল্পী নির্বাচন, জায়গা নির্বাচন, মানুষের কাছে খবর পৌঁছে দেওয়া, এমন হাজারো ঝক্কি। সে সব সামলে 2017 এর ফেব্রুয়ারিতে প্রথম অনুষ্ঠিত হয় পূর্ণিমায়া। শুধু মিউজিক্যাল, সেতার-সরোদ। দ্বিতীয়বার আবার 2017 এর নভেম্বরে। বন্ধুবান্ধব সাদরে গ্রহণ করে এই অভিনব উদ্যোগকে। গ্রামের মানুষও বাড়িয়ে দেয় সাহায্যের হাত। মুখে মুখে তখন খবর পৌঁছে গেছে অনেকের কাছে। এবার তাই আরও বড়, ভিড়ও বেশি। এবারই যন্ত্রসংগীতের সঙ্গে প্রথম ভোকাল মিউজিক। অনুষ্ঠান শুরু হল যখন তখন 7 টা বেজে গেছে। প্রথমে সৌভিক মুখার্জির সেতার। সঙ্গে তবলায় সমীর নন্দী অমন মায়াবি পরিবেশে সেতার ও তবলার যুগলবন্দিতে ভিমপলাশীর মূর্ছনা ঘাড় ধরে সুরে ডুবিয়ে দিল। সুরের বয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে গাছের আড়াল ঠেলে চাঁদও আরও খানিকটা উপরে উঠে এল। নরম জোৎস্নায় আলো পেল মেঠো পথ, টলটলে জল, শ্রোতাদের প্রাণ। এ দৃশ্য, এ অনুভূতি ওখানে না উপস্থিত থাকলে এভাবে উপভোগ করা কঠিন। টানা এক ঘণ্টা চাঁদের আলোয় জমে উঠল আলাপ। আমরাও জমে রইলাম, সুরে ও খোলা মাঠের ঠান্ডায়।
আটটার পর সৌভিক মুখার্জির অনুষ্ঠান শেষে কফি ব্রেক হল। কফির জায়গা হয়েছে সিট ছাড়িয়ে আরও খানিক ডানদিকে এগিয়ে গিয়ে একটু উঁচুতে। সেখানে গাছের গুঁড়িতে লাগানো আলো ঝলমল করছে। কফি, পকোড়া ও পাটিসাপটার জমাটি স্ন্যাক্স। পিছনের গাছের ইলেকট্রিক আলোগুলো অনুষ্ঠানের সময় নেভানো ছিল, ব্রেক-এ আলোর চাদর বিছাচ্ছে রাস্তা জুড়ে। বেশি হাঁটাচলা করলে শীত করছে, সঙ্গে শীত আটকানোর বিশেষ সঙ্গতি নেই। তাই আলো নেভার আগেই সিটে বসে মন দিলাম পূর্ণিমায়া-য়। ভেসে থাকা প্রদীপের সেই তেজ তখন কমে আসছে, আলোর রেখা টিম টিম করছে। এরপর শুরু হল দ্বিতীয় শিল্পী কোয়েল দাশগুপ্ত নাহা-র অনুষ্ঠান। এই প্রথম পূর্ণিমায়ায় ভোকাল, কোয়েল শুরু করলেন খেয়াল দিয়ে। তারপর খামাজ রাগে ঠুংরি, তারপর দাদরা এবং শেষে দর্শকের অনুরোধে ভৈরবী। জোৎস্না মেখে গান শুনতে শুনতে তখন রাত 10টা বেজে গেছে। অনেক প্রদীপ নিভে এসেছে, অনেকগুলো নিভু নিভু। জলে চাঁদের ছায়া তখন টলমল করছে। পূর্ণিমার মায়ার চাদর জড়িয়ে আমরা তখন মনের ভিতর উত্তাপ নিচ্ছি। অনুষ্ঠান শেষেও ওখানটাই আরও কিছুক্ষণ বসে থাকতে লোভ হচ্ছে খুব। কিন্তু ততক্ষণে খাবার ডাক এসে গেছে। আমরা গুটি গুটি পা বাড়িয়ে ডিনার-এর জায়গায় গিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম। সবার মনে, কথায়, হাবভাবে প্রশান্তির ছাপ। শহুরে মানুষদের এমন এসকেপ রুট-ই তো স্বপ্ন দেখার সোনা কাঠি দেয়। দলছুট হবার সাহস যোগায়।
ডিনার-এ পোলাও, মাটন, বোঁদে খেয়ে আমরা গাড়ি চড়ে চলে গেলাম কালো বাড়িতে। রাতে আমাদের তিন বন্ধুর আড্ডা জমল খুব। তারপর যখন ঘুম খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙল ব্রেকফাস্ট-এর কড়া নাড়ায়। ব্রেকফাস্টের সঙ্গে ঘরে এল পূর্ণিমায়া-র উপহার। মাটি পাত্রে যত্নে মোড়া। মোড়ক খুলতেই বেরিয়ে পড়ল ছোট্ট ছোট্ট দুটো মাটির হাঁস ও মাটির মাছ, ভারী মিষ্টি। সে সব গুছিয়ে রেখে আমি তৈরি হয়ে হেঁটে এলাম আশপাশটা। মাটির বাড়িই বেশি এদিকটা। মানুষজনও সরল-সাদা। অচেনা শিশুও এখানে এক গাল হেঁসে জিগ্যেস করে “ভালো আছো?” আরও আকাশ-এ গিয়ে দেখলাম অনেকেই রওনা দিচ্ছেন। আমি নিরিবিলিতে প্রজাপতি দেখলাম অনেক্ষণ, দোলনায় বসে নিজের সঙ্গে কথা বললাম, অনেকখানি আকাশ দেখলাম একা একা। খানিকটা আকাশ ধার নিলাম মনে মনে।
আমাদের দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা আরও আকাশ-এ থাকলেও বনলক্ষীর লোভ আমার সামলাতে পারিনি। তাই সেখানেই লাঞ্চ। কালো বাড়ি ছেড়ে দিয়ে নিজেদের লাগেজ আরো আকাশ-এ রেখে আমরা সোদিকেই চললাম। আগেরদিনই ফোন করে অর্ডার দেওয়া ছিল। ভাত, ঘি, আলুভাজা, ডাল, পোস্তর বড়া, চিংড়ির মালাইকারি, ইলিশ, মাটন কষা, চাটনি সহযোগে জমিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সেরে আমরা আবার ফিরলাম সুচন্দ্রা দির মাটির বাড়ির দাওয়ায়। একটু জিরিয়ে অনেক আন্তরিক অভিজ্ঞতা নিয়ে রওনা হলাম বোলপুর স্টেশনের উদ্দেশে, আবার কোলাহলে ফিরব বলে।