ছোটবেলায় পুজোর ছুটি কাটিয়ে স্কুল শুরু হওয়াটা যেমন মন কেমনের, বড়বেলায় অফিস শুরু হওয়াটাও একইরকম। আমাদের সময় স্কুলে তো তবু খোলার দিন নতুন জামা এলাউড ছিল, এখনকার বাচ্চাদের ছুটি কাটিয়েই পরীক্ষার ঘণ্টা বাজে। কটা দিন এই যে গা ভাসিয়ে থাকা টা, মণ্ডপে ঠাকুরের থেকেও বেশি মিস করি সেইটা। ছোটবেলা থেকেই আমার একটা জিনিস খুব অবাক লাগতো, দশমীতে ঠাকুর চলে যাবে তাই সবার মন খারাপ, এদিকে ঢাক বাজিয়ে দেদার আনন্দ করে, মিষ্টি, ঘুগনি, নিমকি খেয়ে চলে যাওয়ার উদযাপনটা তবে কেন? আবার এই আনন্দ ফিরে আসবে সেই অপেক্ষায় নাকি দুঃখ ভুলে রোজনামচার ঢুকে পড়বার প্রস্তুতির? এটার সঠিক উত্তর খুঁজে না পেলেও বিসর্জন চিরকালই আনন্দ মেশানো মনখারাপ নিয়ে এসেছে। আমার ছোটোবেলা যেখানে কেটেছে সেখানে পুজোয় নিয়ম-নিষ্ঠা ফার্স্ট প্রাইয়োরিটি ছিল। নির্ঘন্ট মেনে বোধন থেকে বিসর্জন। আমাদের পাড়ার পুজোটা ছিমছাম। পাড়ার কাকিমারা জোগাড় করত, কাকুরা তদারকি থেকে লাইন, সবই সামলাতো। তখন তো থিম পুজো হত না, ওই দু-এক বছর কোথাও ভ্যানিশ, নব দুর্গা বা জ্যান্ত দুর্গার খবর রটে গেলে ভিড় হত প্রচুর। তবে সেই উৎসাহ এখনকার মতো মহালয়ার আগে থেকেই উথলে পড়তো না। উদ্বোধনের তাড়া ছিল না, পুরস্কারের প্যাঁচও না। ষষ্ঠী থেকে দশমী নতুন জামা, ক্যাপ বন্দুক, হুড়োহুড়ি, ভোগ, ঠাকুর দেখায় হুশ করে কেটে যেত। তারপর দশমীর বিকেলে গঙ্গার ঘাটে ঢল নামতো প্রতিমার। আমরাও যেতাম, বাবার কোলে, মা-কাকিমার হাত ধরে। শ্রীরামপুরে তখন নৌকো করে ঠাকুর বিসর্জনের চল ছিল। যেমন টাকী-তে দুই বাংলার ঠাকুর বিসর্জনে আজও দেখা যায়। একটা নৌকায় ঠাকুর নিয়ে উঠতো কাকু দাদা-রা। আর একটা নৌকায় আমরা, পাড়ার বউ-বাচ্চারা। অনেক পাড়ার ঠাকুর-নৌকাই তখন পাড়ি দিত গঙ্গাবক্ষে। কোনও কোনও পাড়ার আবার দু-নৌকার মাঝে থাকতো ঠাকুর। বিসর্জনের সময় এলে দুদিকের নৌকা আসতে আসতে সরে যেত, আর মাঝখান থেকে ঠাকুর ঝপাং করে জলে। আমরা ছোটরা ছটফট করে উঠতাম প্রতিমার কোন জায়গাটা ডুবে গেল, আর কোন জায়গাটা ভেসে রইল দেখার জন্য। ওই অন্তিম মুহূর্তটায় প্রতিমার ভিজে যাওয়া গাল, আকাশের দিকে নিস্পলক চেয়ে থাকা মুখ আজও কেমন বুকের মধ্যে জ্বলজ্বল করে। ছোটবেলার সেই রীতি সময়ের সাথে সাথে বাজেট ও উদ্যোগের অভাবে কোথায় যে হারিয়ে গেল! টের পাবার পর দেখলাম ম্লান ঢাকের শব্দে জলে গুলে যাচ্ছে মায়ের গায়ের রং। তারপর সিঁদুর মাখা গালে ছোটকাকু বাড়ি ফিরলে কলাপাতায় দোয়াত থেকে আলতা নিয়ে দুর্গা নাম লেখা, লিখতে লিখতে জমায়-আঙুলে মাখামাখি আলতা, বড়দের প্রণাম, ছোটদের আদর, অনেক স্নেহ চুম্বন। সে সময় বাড়ি বাড়ি প্রণাম করতে যাওয়ার চল ছিল। সবার বাড়ি মিষ্টি, হাতে গড়া নিমকি, চন্দ্রপুলি, ঘুগনি খেয়েই ডিনার হয়ে যেত।
এখন ভাসানের রূপ বদলেছে। সিঁদুর মেখে দেদার নাচ, বক্স বাজিয়ে গান ঢাকের শব্দকে ম্লান করে দিয়েছে। ডিজে জায়গা করে নিয়েছে ভাসানের প্রসেশনে। যদিও শ্রীরামপুরে আমাদের পাড়ায় আজও ডিজে আসেনি। তবে ভাসানের দিন পাবলিক ডিমান্ড-এ দশমী ছাড়িয়ে দ্বাদশী, ত্রয়োদশী-তে গিয়ে ঠেকেছে। পাড়ায় কারও বাড়ি গিয়ে বা টিউশন থেকে বাড়ি ফেরার সময় প্রসেশনের জেরে আটকে পড়ে ছেলে-মেয়েদের উদ্দাম নৃত্য দেখে কখনোই খুব উৎসাহী হইনি। বরং বিরক্ত লেগেছে। কোনওদিন ওরকম ব্যয়বহুল ভাসানে হাঁটার ইচ্ছেও হয়নি।
তবে শ্বশুরবাড়ির পাড়ায় এসে উৎসব অন্যভাবে চাক্ষুষ করতে শিখেছি আমি। এখানে থিম পুজোর পাড়া। পাশাপাশি 5-6 টা পুজো, এ বলে আমায় দেখ, তো ও বলে আমায়। স্কুলের গন্ডি পেরোনোর পর কলকাতার পুজো আমার মনে অনেক বেশি জায়গা করে নিয়েছে। লাইনে দাঁড়িয়ে থিমের পুজো দেখতে ভালো লেগেছে বার বার। এহেন আমার শ্বশুরবাড়ির পাড়ার পুজো নিয়ে উৎসাহ থাকবেই তা বলাই যায়। এ পাড়াটায় সবচেয়ে মজা এখানেও কাকিমারা জোগাড় করে, রোজ নতুন শাড়ি-জামা পরে এসে পাড়াতেই আড্ডা জমে মধ্যরাত অবধি, দশমীর বিকেলে সবাই সিঁদুরে লাল হয়ে যায় থিমের ঠাকুরকে সাক্ষী রেখে। যদিও এখানে দ্বাদশী অবধি প্যান্ডেলে ঠাকুর থাকে, কিন্তু দশমী থেকেই সঙ্গে থাকে ‘যাবে বিসর্জন’-এর অপেক্ষা। পুজোতে রোজ পাড়ায় থাকলেও অফিস শুরু হয়ে যাওয়ায় আমি ভাসানে থাকতে পারতাম না কোনো বারই। গতবছর সে সুযোগ হয়েছিল। তবে যখন শুনি পাড়ার ছোটদের উৎসাহে ডিজে আসছে, খুব খুশি হয়নি। ওই যে যতই মর্ডান হই মনের মধ্যে মফসসলি ঢাকটা এখনও বাজে। তবে সেই ভাসানের স্মৃতি এখনও আমার ঠোঁটের কোণে হাসি এনে দেয়।
ডিজে, ঢাকি সব নিয়ে দুটো টেম্পো আলোয় আলোয় সাজিয়ে যখন ঠাকুর বেরলো প্যান্ডেল থেকে তখন আমি ভিড়ের মধ্যে মিশে। মাইকের শব্দে পাশের লোকের কথাই কানে ঢুকছে না। অনেকেই ভীষণ নাচছে। ছোট ছোট বাচ্চারা বেতালে হাত-পা নেড়ে যাচ্ছে অনর্গল। ওদের আনন্দের তালটা কিন্তু পারফেক্ট। হঠাৎ দেখলাম আমাদের পাড়ারই একটি অটিস্টিক বাচ্চা মেয়ে মায়ের হাত ছেড়ে নাচতে শুরু করল। তাকে তখন আর থামানো যায় না। অন্যরা থামলেও সে তাদের থামতে দেবে না মোটেই। হাত-পা-কোমর নাচিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে তাঁর আনন্দ। আর একটি 1 বছরের বাচ্চা মায়ের কোলে একটা হাত তুলে আলতো আলতো মাথা নাড়ছে। প্রসেশন আর একটু এগোতে আমাদের পাড়ারই একটি ছেলে (ওরও কিছু অসুস্থতা আছে, ঠিক করে হাঁটতে-কথা বলতে পারে না, অনেকে বলে মৃগি রোগ আছে) ভিড়ের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পরে রুমাল ঘুরিয়ে নাচতে নাচতে এগোতে শুরু করল। কিছু অচেনা মানুষও যোগ দিল শুধু এক গলা আনন্দে ডুববে বলে। এক কাকিমা লজ্জা ঠেলে ফেলে নেচে উঠলেন ছোটদের সঙ্গে। আমি নিস্পলক দেখছি অচেনা-অজানা ছেলে-মেয়েগুলো হাত ধরাধরি করে নাচতে নাচতে বন্ধু হয়ে যাচ্ছে নিমেষেই। তখন আমার মুখে টেম্পো থেকে লাল-নীল-সবুজ আলো ঠিকরে পড়ছে পালা করে। ঠোঁটে নিজের অজান্তেই ফুটে উঠছে হাসি। হোক না কান ফাটানো গান, হোক না উদ্দাম নাচ, এর মাঝেই তো কত মানুষ স্রেফ একটু নিখাদ আনন্দের জন্য তালে তাল দিতে পারে। ওই যে বারান্দা থেকে যাঁরা ঝুঁকে দেখছেন, ওই যে উঁচু বারান্দায় নাচতে থাকা বাচ্চাটা মায়ের ডাকে ভিতরে গিয়েও আবার বারান্দায় ফিরে আসছে, ওই যে মুদির দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চাদুটো যেভাবে কোমর দোলাচ্ছে, ওই যে গাড়ি দাঁড় করিয়ে স্টিয়ারিং ছেড়ে যে ছেলেটা দু-হাত তুলে নেচে নিচ্ছে, ওদের উচ্ছাস তো মিথ্যে নয়। মিথ্যে নয় পুজোর রেষারেষি ভুলে পাশের ক্লাবকে আগে যাওয়ার জায়গা করে দিতে পারাটা। নাচতে নাচতে ঘেমে নেয়েও রাস্তার গাড়িগুলোকে সচেতনভাবে পাশ করিয়ে দিতে পারাটা। যাঁর সঙ্গে কথা নেই তাকেও জড়িয়ে কোলাকুলি করে নেওয়াটা। প্রতিমা বিসর্জন হলেও বিসর্জন হয় না এই ভালো লাগাগুলোর, এই মানবিক অনুভূতিগুলোর। সেখানেই হিন্দি গানে কোমর দোলানো, জেঠুর চোখরাঙানি, রাত অবধি কিছু মানুষের বিরক্তির কারণ হওয়াগুলোকে হারিয়ে দেয় উৎসবের আনন্দ। সেখানেই শুভ হয় বিজয়া।