বাংলা নববর্ষ, প্রত্যেক বাঙালি বাড়িতেই এই দিনটা বিশেষ। সে খাওয়া-দাওয়া হোক বা পুজো-আচ্চা, কাজের দিন হোক বা ছুটির দিন, বাড়ির সবার মন ভালো থাকে এই দিনটায়। আমাদের বাড়িতে বছরের প্রথম দিন মানে চিরকালই ছিল ছোট খাটো ঘরোয়া উৎসব। একান্নবর্তী পরিবার। আমার দুই কাকুর ব্যবসার কারণে বাড়িতে লক্ষ্মী-গণেশ-এর পুজো থাকতো। জোড়া লক্ষ্মী-গণেশ আসতো। কোনও কোনও বছর একই রকম দেখতে আবার কোনও বছর কার টা বেশি ভালো তাই নিয়ে ভাই-বোনদের মধ্যে হত ভোটাভুটি। মা-ঠাকুমা-কাকিমারা সকাল সকাল জোগাড় করতে বসে যেত। আমরা ছোটরা সব সকালে স্নান সেরে নতুন জামা পরে রেডি হয়ে নিতাম। কোনও কোনও বছর 3 বোন একই কাপড়ে বানানো একই ডিজাইনের জামা পড়তাম। তখন টুইনিং কী জানা ছিল না। পয়লা দিনে নতুন জামা পরাই ছিল রীতি।
এই পুজোটায় আমিষ খাওয়া এল্যাউড ছিল। ছোট থেকেই আমরা জেনে এসেছি পুজো মানে পড়ায় ফাঁকি, সারাদিন হুল্লোড়। বাড়িতে পুজো থাকলে সে আনন্দ এক লাফে চারগুণ হয়ে যায়। আমাদেরও তাই হত। নববর্ষের পুজোয় আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল হালখাতায় পয়সার ছাপ দেওয়া। ঠাকুর মশাই খাতায় আঙ্গুল দিয়ে স্বস্তিক এঁকে তার নিচে 1 টাকার কয়েন-এ সিঁদুর, হলুদ মাখিয়ে ছাপ দিতেন। কি নিখুঁত গোল হয়ে ফুটে উঠতো খাতার ওপর টাকার ছাপ। একটুও ধেবড়ে যেত না। পুজো শেষে আগের বছরের লক্ষ্মী-গণেশ বদলে তাকে উঠতো নতুন লক্ষ্মী-গণেশ।
ছোটকাকুর ব্যবসার মিষ্টির প্যাকেট তৈরি হত বাড়িতে। চারকোণা মিষ্টির বাক্স তৈরি করে তাতে 6-7 রকমের নোনতা আর মিষ্টি ভরে প্যাকেট করে রাবার ব্যান্ড দিয়ে আটকানো। আমাদের এক একজনের হাতে থাকতো এক একটা দায়িত্ব। সবাই মিলে হইহই করে হত সেই কাজ। ছোটকাকুর ডিলার, ডিস্ট্রিবিউটর, দোকানে দিত সেসব প্যাকেট। আমাদের ছোটদের মজা ছিল প্যাকেট করা হয়ে যাওয়ার পর সবার একটা করে বাক্স পাওয়ার আনন্দ। তারপর তার থেকে সব থেকে পছন্দের মিষ্টিটায় কামড়, আহা নববর্ষ শুভ হতে বাধ্য তখন।
দুপুরে সবাই একসঙ্গে মিলে খাওয়া হত। পাঁচ শাক, ভাজা, ডাল, চিংড়ি বা দইমাছ, মুরগির ঠ্যাং বা মাটন। মাংসর পিস নিয়ে ঝগড়া, বেশি ভাত অন্যের পাতে তুলে দেওয়া এসব ছিল পারিবারিক ভাব-ভালোবাসার লক্ষণ। এখনও সেসব খাবারের স্বাদ মুখে লেগে আছে। মায়ের হাতের রান্না খুব মনে পরে এমন দিনে। বছরের শুরুর দিন পছন্দের খাবার খেলে সারা বছর ভালো খাওয়া হয়, তখন শোনা এসব কথাকে আমি আজও মনে প্রাণে বিশ্বাস করে চলি।
ছোটবেলায় নববর্ষের বিকেলে জামাকাপড় আর গয়নার দোকানে নেমন্তন্ন থাকতো। কি যে ভাল লাগত লাইন দিয়ে ক্যালেন্ডার আর শুকনো মিষ্টির প্যাকেট নিতে। কোনও কোনও দোকান আবার টু ইন ওয়ান আইসক্রিম বা কোল্ডড্রিংক খাওয়াতো, সেগুলো মিস করতাম না একেবারেই। বাড়ি ফিরে কোন বাক্সে কি মিষ্টি আছে, কোন ক্যালেন্ডারটা ভালো সেসব বাছাই চলত। আমাদের বেডরুমে আমার সবচেয়ে প্রিয় ক্যালেন্ডারটা বেছে লাগিয়ে দিতাম। বেশিরভাগই যদিও থাকতো ঠাকুরের ছবি। কিন্তু সেই বয়সে ওই ছোট ছোট জিনিসগুলোই ছিল সেরা প্রাপ্তি।
নববর্ষ মানে শুধু একটা দিন ছিল না কখনোই। চৈত্র মাস পরে গেলেই নতুন বছরের প্রস্তুতি পুরো দমে শুরু হয়ে যেত। আমাদের শ্রীরামপুরে মায়ের কিছু বাছাই করা দোকান ছিল, কোনটায় জামা ভালো, কোনটায় বেডকভার, পর্দা, বালিশের ওয়ার, কোনটায় ব্লাউজ, নাইটি বা ছিট কাপড় সেসব মনের মধ্যে লম্বা লিস্ট করা থাকতো। চৈত্র সেল ছিল সব পেয়েছির দেশ। সেলের সময় ফুটপাথের দোকান ছিল খাজানা। ছোটবেলায় ধর্মতলা, গড়িয়াহাটে সেলের শপিং হত না, কিন্তু মায়ের সঙ্গে প্রায় দিনই চলে যেতাম শ্রীরামপুরে মার্কেটে। সেখানে কত ভিড়, কত রকমের জামা-কাপড়। আমার ফি বছর কমপক্ষে দুটো ভালো জামা হতই। পয়লা বৈশাখের একটা আর একটা ঠিক একমাস পর জন্মদিনের। আর বেশি হলে সকাল বিকেল আলাদা আলাদা! কলেজে উঠে যখন কলকাতার ভূত চাপল চৈত্র সেল মানে ছিল গড়িয়াহাট। ওই ঠাসা ভিড়ে 10 টাকা দাম কমিয়ে যে কি তৃপ্তি পেতাম! হার, দুল, থালা, কুর্তি, ওরনা ,যাই দেখতাম মনে হত এর চেয়ে সস্তায় আর কোনওদিন পাব না! জমানো টাকা খরচ করে ব্যাগ বোঝাই করে বাড়ি ফিরতাম। চাকরি বাকরি করতে গিয়ে চৈত্র সেল একদিন দক্ষিণাপন আর একদিন বাইলুম, শিবানী, খাদি ভবন চলে যাওয়ায় এসে ঠেকেছিল আমার কাছে। কিন্তু তবু সে সুখের ভাগ হবে না।
শুধু এ বছরটা তার ব্যতিক্রম। এ বছর নববর্ষটা মন কেমনের। আমার মনে পড়ে না এর আগে কোনওদিন পয়লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে কিছু কিনি নি বলে। মনে পড়ে না পয়লা বৈশাখে সারাদিন চুপচাপ বাড়িতে বসে কাটিয়ে দিয়েছি বলে। মনে পরে না কোনও চৈত্র মাসে আমার ব্যাংক ব্যালেন্স একটুও কমেনি বলে। মনে পড়ে না মিষ্টি না খেয়ে কোনও পয়লা বৈশাখ কেটেছে বলে! ভাগ্যিস আলমারির কোণে পুজোয় না পরে উঠতে পারা একটা শাড়ি ছিল। হাজার মন খারাপকে তোয়াক্কা না করে নতুন টা পরে একটা ভীষণ দুঃখ মেশানো আনন্দ পেয়েছি এবার। মনে মনে চেয়েছি, নববর্ষগুলো যেন সেই ছোটবেলার মিষ্টি বাক্স খোলার মতো আনন্দ নিয়ে আসে এরপর থেকে। জীবন থেকে নববর্ষের মিষ্টির বাক্স আর চৈত্র সেল চলে যাওয়ার দুঃখ খুব গভীর, ওটা বাঙালি ছাড়া কেউ বুঝবে না।