Roastery Coffee House in Kolkata
হঠাৎ চটজলদি প্ল্যানে অফিস ফেরতা হিন্দুস্তান পার্কের দিকে গেলে বা গড়িয়াহাটে দিনভর কেনাকাটা সেরে শেষ বিকেলে সস্তায় কফিতে চুমুক দিতে দিতে একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য অনেক কলকাতাবাসীরই প্রিয় জায়গা ছিল সাউথ ইন্ডিয়া ক্লাবের ক্যান্টিন। সেখানে ধোঁয়া ওঠা ফিল্টার কফি আর রাওয়া ধোসা খায়নি এমন রসিক বাঙালি খুব কমই আছে। সস্তায় ভালো সাউথ ইন্ডিয়ান খাবার পরিবেশনের উদ্দেশ্য নিয়ে স্থাপিত এই ক্যান্টিন এ শহরের অনেক ঐতিহ্যের মতোই যুগের হওয়ায় তাল মিলিয়ে উঠতে পারেনি। 1960 সালে ডাঃ সর্বপল্লী রাধকৃষ্ণন এবং স্যার সি ভি রমন-এর উদ্যোগে স্থাপিত ক্যালকাটা সাউথ ইন্ডিয়া ক্লাব-এর ক্যান্টিন জায়গার অত্যধিক ভাড়া বৃদ্ধির জন্য এ বছর জানুয়ারিতে বন্ধ হয়ে যায়। আর তখন থেকেই কানাঘুষো শোনা যায় সেখানে নতুন কফি হাউজ (coffee house) আসছে।
সাউথ ইন্ডিয়া ক্লাব-ক্যান্টিনের রিনোভেশন করে, পুরো জায়গাটা নতুন করে সাজিয়ে গত সপ্তাহ থেকে সেখানে চালু হয়েছে Roastery Coffee House. হায়দ্রাবাদের বানজারা হিলস-এর জনপ্রিয়তা ছুঁয়ে এবার কলকাতায়। কফি এক্সপার্ট Nishant Sinha এবং তাঁর স্ত্রী Sheetal Saxena-র ভেঞ্চার। সেখানেই সবান্ধবে ঘুরে এলাম শনিবার। সবে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। তখনও সন্ধে নামেনি। ভিজে বিকেলে পুরনোর মধ্যে তখন নতুনকে খুঁজছি। ঢুকে বুঝলাম ওল্ড ওয়ার্ড চাৰ্ম-টা একেবারে উধাও হলেও একটা আধুনিক রঙচঙে পন্ডিচেরি হাজির কলকাতার বুকে। গেট দিয়ে ঢোকা থেকেই আধুনিকত্বে মোড়া। বাহারি টবে গাছ, চেন্নাই, পন্ডিচেরির অনেক বাড়ির সামনে এমন টব দেখেছি। গেটের ভিতরের রাস্তায় ডান হাতে নানা মাপের টবে গাছ লাগানো। পুরনো বড় গাছগুলো আছে, গাছের গায়ে ঝোলানো বাহারি আলো। কিন্তু এত ভিড় শুরুতে মনে হল কোনও ইভেন্ট চলছে হয়তো। তবে তা একেবারেই না, 1 হপ্তাতেই এ জায়গা বেশ নাম করেছে তা বুঝলাম। ভালোলাগার শুরু সোজা হেঁটে এসে দাবার ছক মেঝে দেখে। সাদা-কালো টাইল-এর মেঝের ওপর টান নেই এমন বাঙালি তো কমই আছে! বাইরের এই সাদা-কালো মেঝেতে সাদা চেয়ার-টেবিল, সব ভর্তি। লোক গিজগিজ করছে। এদিক সেদিক নতুন জয়েন্ট-এ সেলফি তোলার হিড়িক। পুরো ক্লাবটার রঙে সাদা আর হলুদের কনট্রাস্ট। বাইরে ছাড়াও ভিতরে বসার জায়গা আছে। আমি এগিয়ে গিয়ে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে জিগেস করলাম জায়গা আছে কিনা, কিন্তু যা ভেবেছি তাই, সবই ভর্তি। অগত্যা অপেক্ষা। মানুষজন বৃষ্টিভেজা শহরে বেশ শেষ বিকেলের গল্পে মেতেছে। মিনিট দশেকের মধ্যেই ভিতরে জায়গা পেলাম। ভিতরটা এসি কিন্তু বাইরের চেয়ে আরও দ্বিগুণ কিচির-মিচির। কে বলেছে এখন মানুষ আর আড্ডা মারে না! তাদের অবিলম্বে একটা উইকেন্ডে এখানে নিয়ে যাওয়া হোক!
তো যাই হোক, ভিতরটা ছিমছাম, সুন্দর। আগের গঠনের বেশ খানিকটা পরিবর্তন ঘটেছে। দরজা ঠেলে ঢুকেই সোজাসুজি কফি গ্রাইন্ড করার মেশিন, তার পিছনে রান্নাঘর। ডান হাতে মর্ডান কাউন্টার, সেখানে কফি বিন, কাসকারা-র স্যাম্পেল থেকে শুরু করে দিনের স্পেশাল ডেজার্ট, কুকিজ শোভা পাচ্ছে। ভিতরে রঙের আধিক্য নেই, পুরোটাই সাদা। উপর থেকে ঝোলানো বাহারি টব, আলো ঝলমল। জানলায় আকাশী ইক্কত প্রিন্টের পর্দা। কাঠের চেয়ার পুরনো ধাঁচ অনুযায়ী তৈরি হলেও গদির ইক্কত প্রিন্ট আধুনিকতাৎ ছোঁয়া আনছে। মেনু কার্ডও আধুনিক, মেনু-ও। সাউথ ইন্ডিয়ান কফি ছাড়া পুরনো কিছু নেই, বরং পন্ডিচেরির ফ্রেঞ্চ কলোনির রেস্টুরেন্ট-এর মেনু-র সঙ্গে মিল বেশি। কফিতে প্রচুর অপশন, নিঃসন্দেহে লোভনীয়। হলুদ মেনু কার্ডের পাতা উল্টে খুঁজে পেলাম ওদের সিগনেচার কোল্ড ব্রিউ আর কাসকারা। কাসকারা স্প্যানিশ শব্দ, অর্থ শুকনো skin অর্থাৎ ছাল। কফি চেরির মধ্যে থেকে সিড বের করে নেওয়ার পর ছাল রোদে শুকানো হয় 6 দিন। সেই শুকনো খোসা জলে ফুটিয়ে তৈরি হয় কাসকারা। কোল্ড ব্রিউ, কফি গ্রাউন্ড কম তাপমাত্রায় 16-18 ঘণ্টা জলে ভিজিয়ে রেখে তৈরি হয়। হানি সিনামন, পমেগ্রানেট-এর মত ফ্লেভার বেশ নজরকাড়া। এ ছাড়াও Aero press, french press, Symphony coffee, Nitro cold brew, pour over brew, ice cream blend, Almond milk coffee-র নানান ভ্যারাইটি মন ভরাবেই। এদের সমস্ত কফি Thogarihunkal, Tat tvam, Malabar-এর অর্গানিক কফি এস্টেট থেকে আনা। একবার গিয়ে তো সব টেস্ট করা যায় না, সঙ্গীদের সঙ্গে অর্ডার মাফিক আমার হট কাসকারা, মনসুন মালাবার, হানি সিনামন কোল্ড ব্রিউ আর ব্রাউনি ব্লেন্ড টেস্ট করার সৌভাগ্য হল। আমি নিজে কোল্ড ব্রিউ নিয়েছিলাম। কোল্ড কফি যে ব্ল্যাকও হয় আর তাতে দারুণ ফ্লেভার যোগ করা যায় তা এই প্রথম জানলাম। ঢুকেই ডানদিকের টেবিলে সাজিয়ে রাখা কেকে লোভ দিয়েছিলাম, সেখান থেকে অর্ডার করলাম ক্যারট ওয়ালনাট কেক। এপেটাইজার হিসেবে সঙ্গে নিলাম চিজি ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ আর চিকেন কিমা স্যান্ডউইচ। কফিগুলোর প্রত্যেকটাই বেশ ভালো। কেক টা দারুন। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আমার সবসময়ই প্রিয়, চিজ আর ককটেল সস-এর গুণে তা আরও টেস্টি হয়েছে। কিন্তু গোল বাঁধল স্যান্ডউইচ-এ। অর্ডার করা চিকেন কিমা স্যান্ডউইচ-এর জায়গায় ভুল বশত টেবিলে এল অলিভ চিকেন স্যান্ডউইচ। আমরা প্রথম খাচ্ছি এখানে, ভাবলাম এদের কিমা স্যান্ডউইচ বোধহয় এমনই। কিন্তু তারপর আর ওয়েটার টেবিলে কিমা স্যান্ডউইচ এনে জিগ্যেস করতেই বুঝলাম কিছু একটা গন্ডগোল! কথা বলে জানা গেল পিছনের টেবিলের অলিভ চিকেন আমরা খেয়ে ফেলেছি। ভুল স্বীকার করে প্রায় জোড় করেই ম্যানেজার ছেলেটি আমাদের কিমা স্যান্ডউইচটা তারপর খাওয়ালেন। এত ভিড়ের চাপে নতুন জায়গায় এমন ভুল হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। দুটো স্যান্ডউইচই ভালো লাগল। ব্রেকফাস্ট, স্যালাড, পাস্তা, মেইন কোর্স, ডেজার্ট-এ নানান অপশন আছে, এবার আর সেসব দিকে হাত বাড়ানো হল না স্যান্ডউইচ-এর চাপে।
Roastery-তে খাবার দাবার, কফির দাম একটু বেশি দিকে, কিন্তু এমন এমবিয়েন্স-এ বসে খোশগল্প করার জন্য এই সিসিডি, স্টার বাকস-এর যুগে এখানকার দাম গায়ে লাগার কথা না। আর একটা সুবিধে, একবার সিট পেয়ে গিয়ে কফিতে চুমুক দিতে দিতে যত খুশি বকবক করাই যায়, কেউ উঠে যেতে বলবে না ভিড় থাকলেও। সন্ধের পর যখন আমরা বেরোচ্ছি বাইরে তখন আবার ঝিরঝিরে বৃষ্টি। বিকেলের ভিড়টা আর নেই। ভিতরটা ভর্তি, বাইরে প্রায় খালি। অন্ধকরে দাবার চক মেঝেতে তখন জলের আলপনা, গাছগুলো হাওয়ায় দুলছে। পুরনো আর নতুন-এর তুলনামূলক আলোচনা পেরিয়ে তখন সব কিছুকে আপন করে নিতে জানা প্রিয় শহরের পথে পা বাড়াচ্ছি আমরা, আবার কোনও সন্ধে নামার বেলায় সাউথ ইন্ডিয়া ক্লাবের উঠোনে Roastery coffee house-এর ধোঁয়া ওঠা ফিল্টার কফির টানে ফিরব বলে।
Lekha ta pore jawar ichha roilo!