স্বাধীনতা দিবসের ছুটির পরদিনটা শুক্রবার দেখে আগাপাশতলা না ভেবেই ছুটি এপ্লাই করা ছিল। তারপর এক উইকেন্ড ডিনার-এ বাঙালির বিশ্বজয়ের হাজারো প্ল্যানের মধ্যে একটা ফলে গেল! ঠিক হল আমরা চার বন্ধুতে ভরা বর্ষায় বেনারস (Benaras) যাব। কলকাতায় বর্ষা বলতে গেলে হয়ই নি এবার, তাই উত্তরপ্রদেশে বর্ষার হালহকিকত-এর খোঁজ নিয়ে ফ্লাইট-এর টিকিট কেটে ফেললাম পটাপট। ঘোরা জায়গায় আবার যাওয়া নিয়ে চাপ কম থাকে, নতুন কিছু করার চেয়ে যা করা হয়নি সে ইচ্ছে পূরণের তাগিদ থাকে। তাই সে মতোই বাকেট লিস্টে টিক দিতে দিতে দিন এগিয়ে এল। শাড়ির সুলুকসন্ধান আর খাবারদাবার চেখে দেখাই ছিল মূল লক্ষ্য। গঙ্গা লাগোয়া কোনও হোটেল-এ থাকার শখ সেই কবে থেকে। সে সাধ পূরণ আর সাধ্যের মিশেলে রিভিউ টিভিউ পড়ে বুক করলাম হোটেল সীতা। আসলে মন গণপতি গেস্ট হাউজ বা ব্রিজ রাম প্যালেসে ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু বেনারস (Benaras) গিয়ে অতো খরচে সেই মন-ই সায় দেয় না।
যেদিন রওনা দিলাম তার আগের দিন রাতে বর্ষা নামল এ শহরে। বর্ষা না বলে নিম্নচাপ বলাই ভাল। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে পৌঁছে গেলাম এয়ারপোর্ট। বেনারস (Benaras) নামলাম যখন তখন প্রায় 10 টা। গাড়ি যায় না ঘাটের কাছের হোটেল অবধি। আমাদের মদনপুরা-এ নামতে হল। বাঙালিটোলার রাস্তায় নেমেই বেনারস (Benaras) সম্পর্কে সম্যক ধারণা হল। আগে এসেও দেখেছি বেনারস (Benaras) অপরিস্কার, রাস্তাঘাটে এখানে সেখানে গোবর দেখা বা পথ চলতি গোবরে পা কোনও নতুন ঘটনা না, কিন্তু এবার হতাশ হলাম বেসিক হাইজিন-টাও হারিয়ে যাচ্ছে দেখে। বেলা 11 টা তেও অলি-গলিতে প্রচুর আবর্জনার স্তুপ। প্রায় প্রতি বাড়ির বাইরেই জড়ো করা আবর্জনা, মাছি ভন ভন, দুর্গন্ধ। সেই পথ পেরিয়ে হোটেলে পৌঁছন গেল। হোটেল ঘাটের পারে। অর্ধেকের বেশি সিঁড়ি জলের তলায়। বর্ষায় জল বেড়ে ভরা রূপ গঙ্গার। বুঝলাম ঘাট থেকে ঘাটে চলে বেড়ানোর ভাগ্য এবার নেই।
হোটেল-এ খানিক অপেক্ষার পর রুম পাওয়া গেল। সেখানেও হতাশা। একটাতে সুন্দর ভিউ-সহ বারান্দা আছে তো অন্যটায় বড় বাথরুম থাকায় বারান্দা বাদ গেছে। সেক্ষেত্রে ঘরের জানলা দিয়ে গঙ্গা দেখতে হবে। অনেক বাগবিতন্ডার পর দুটো বারান্দা দেওয়া রুম পাওয়া গেল সেকেন্ড ফ্লোর-এ। কিন্তু ওই বারান্দাটুকুই সার। বাকি রুম খুবই বেসিক, সাধারণ মানের বিছানা, সাধারণ বাথরুম, কলে গোলমাল, টয়লেটারিস বলতে শুধু একটা ছোট্ট সাবান। দামের সঙ্গে খাপ খায় না। আমাদের ব্রেকফাস্ট-সহ প্যাকেজে রুমপ্রতি প্রায় 3000 টাকা করে পড়েছিল, সেই দামে এর চেয়ে ঢেড় ভাল হোটেল পাওয়া যায়। দেব দীপাবলির সময় বছর দুই আগে বেনারস (Benaras) গিয়ে গদলিয়া মোড়ে এর হাফ দামে এই ক্যাটাগরির রুমে ছিলাম। তবে হ্যাঁ ভিউ ছিল না। বারান্দায় গেলে ‘ও ঠিকাছে এই রুম-এ মানিয়ে নেওয়া যায় এমন ভিউয়ের জন্য’ টাইপের অনুভূতিটাও ছিল না ওখানে।
পৌঁছে থেকেই আমাদের খিদে পেয়েছিল ভীষণ। আর এবার ভেবেই এসেছিলাম বেনারসের বিখ্যাত কচুরি, চাট, ভেজ খাবার, রাবড়ি, মালাই তো আগেও চেখেছি, এবার নতুন কিছু টেস্ট করার দিকে ঝুঁকব বেশি। বেনারসে এমনিতেই বিদেশিদের দাপটে অলি-গলি-তে ক্যাফে গজিয়ে উঠেছে অনেক। হোটেল থেকে বেরিয়ে বাঙালিটোলার রাস্তা ধরে চলতে চলতে এদিক সেদিক তেমন কয়েকটা চোখেও পড়ছিল। সেরকমই ভালো ডেকর দেখে ঢুকে পড়েছিলাম The Dirty Chai তে। এই নামের একটা ক্যাফে অসি ঘাটে আছে। বাঙালিটোলার ব্রাঞ্চ আগস্ট-এই খুলেছে। বসার ব্যবস্থা বেশ। লম্বা বেঞ্চ, চেয়ার টেবিলের সঙ্গে মাটিতে ঘাসের গালিচাও আছে। আমরা গ্রাফিটি দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ঘাসের মেঝেতে বসলাম। খিদে খুব পেয়েছে। থাই, চাইনিজ, ইন্ডিয়ান নানান মেনু আছে। আমরা থাই কারি, ডিম কারি, ভাত, লেমন আইসড টি আর জিনজর আইসড টি নিলাম। লেমন আইসড টি ভালো, অন্যটা জমেনি। খাবার আসতে বেশ সময় লাগল। রেড, গ্রীন থাই কারি কোনওটাই ঠিক থাই কারি নয়, নারকেল দুধ থাকলেও ইন্ডিয়ান মশলা মেশানোয় স্বাদ বদলে গেছে। ডিম কারি-টা খুব ভালো কিন্তু সেই ডিম কারি-ই রিপিট অর্ডারে সম্পূর্ণ বদলে অন্য স্বাদের হয়ে গেল। এমন সুন্দর দেখতে ক্যাফে খুলে এমন কনসিসটেন্সি হারিয়ে ফেললে তো মহা মুশকিল! এদিকে দুপুর বাড়তেই গিজগিজে ভিড়, নানা দেশের মানুষের আড্ডার ঠেক। লোকে বসার জায়গা পাচ্ছে না। আমাদের শুরু থেকেই ম্যানেজার লোকটি যত্নআত্তি করছিলেন। কিন্তু খাবারে একেবারেই মন ভরাতে পারেনি ডার্টি চায়। অভিজ্ঞতাটাই উল্টে ডার্টি হয়ে গেছে।
তবে আমি হাল ছাড়ার পাত্র না, ঠিক করে নিয়েছিলাম বিকেলে ভালো একটা জায়গা খুঁজে নিতেই হবে। এখন থেকে রিসার্চ করে এবং বন্ধুবান্ধব-এর পরামর্শে যে জায়গাগুলো দেখে গিয়েছিলাম তার বেশিরভাগই অসি ঘাটের দিকে। সেদিকে যাওয়ার প্ল্যান পরদিন। আমরা ঘোরাঘুরি করে বাবা লস্যি থেকে অসাধারণ লস্যি খেয়ে বিকেল বিকেল রুমে ফিরেছিলাম। ব্লু লস্যি শপের মতোই ভালো এ লস্যির দোকান। বাঙালিটোলার আর একটা জেম।
হোটেল সীতা-র ছাদ থেকে গঙ্গার প্যানোরমিক ভিউ দেখা যায়। সন্ধে নামার পর বেশ লাগছিল। ওখানেই বসে সাত পাঁচ ভাবছিলাম। দেখলাম পাশের টেবিলে লোকজন বিয়ার খাচ্ছে। স্বাধীনতা দিবস ড্রাই ডে। অর্ক কাউন্টারে গিয়ে জিগেস করতেই তারা জানাল পাওয়া যাবে। ব্যাস ডিমের পকোড়ার সঙ্গে অর্ডার হয়ে গেল। কিছুক্ষনেই চাঁদ বেরিয়ে পড়ল মেঘের আড়াল থেকে। হাতে বিয়ার ক্যান, গঙ্গার ওপর জোৎস্না আর নৌকার বয়ে চলা মায়াবী করে তুলল পরিবেশ। ওখানেই বসে থাকতে ইচ্ছে হল বহুক্ষণ। কিন্তু এ হোটেল-এর রেস্টুরেন্ট এ অকারণে দাম বেশি খাবারের। আর বেনারস (Benaras) এসে হোটেল-এ ডিনার করার কোনও মানে নেই। তাই আমরা সাড়ে আটটার পর চাট খাব ভেবেই গুটি গুটি বেরোলাম।
খানিক যেতেই বৃষ্টি নামল টিপ টুপ। 3 টে ছাতা ব্যাগে করে নিয়ে গেলেও একটাও হাতে নিয়ে বেরোইনি কেউ। টিপ টাপ থেকে ঝম ঝম হতে সময় লাগল না মোটেই। আমরা চাট-এর চিন্তা বাদ দিয়ে ঢুকে পড়লাম বাঙালিটোলার আরও একটি রেস্টুরেন্ট-এ। সকালেও এটা দেখেছিলাম। ছিমছাম, ছোট্ট জায়গা, কটা টেবিল চেয়ার পাতা, রান্না হচ্ছে ওপরতলায়। নাম Sushi Cafe and Continental Restaurant. মূলত জাপানিজ, কোরিয়ান, কন্টিনেন্টাল ও চাইনিজ পাওয়া যায়, কিছু ইন্ডিয়ান-ও আছে। মেনুতে অনেক অপশন। চিকেন, পর্ক, ফিস সবই আছে। রাতে পর্ক শেষ। ভেজ, চিকেন মিলিয়ে অর্ডার করা হল। সিজলার প্লেটে আসা জাপানিজ মোমো, চিকেনের ঝাল রাইস বোল, ফ্রায়েড রাইস আর কোরিয়ান চিকেন মন কেড়ে নিল। দারুন টেস্ট, আর পরিমাণও খুব ভাল। পর্ক টেস্ট করতে আবার আসব তখনই ঠিক করে ফেললাম। এখানে লাইম সোডা-টা বানিয়ে দেয় না। লেবুর রস, চিনি আর সোডা-র বোতল টেবিলে রেখে যাবে, নিজে বানিয়ে নিতে হয়। তাতে একটা সুবিধে, সোডা টা বেশি পাওয়া যায়। আমাদের খেতে খেতে বৃষ্টি থেমে গেল। ভিজে রাস্তা ধরে হোটেল-এর পথ ধরলাম।
ভোর ভোর এলার্ম দিয়ে শুয়েছিলাম সূর্যোদয় দেখতে যাব বলে। চোখ মেলে দেখলাম ঘর থেকেই সূর্যদেবতা বেশ দৃশ্যমান। দরজা ঠেলে বারান্দায় গেলাম। কমলা হয়ে আছে আকাশ, আশপাশে ভেসে যাওয়া মেঘ। নিচে গঙ্গায় নৌকাগুলো সার বেঁধে দাঁড়িয়ে। কেউ কেউ আবার এই কাকভোরে বোটিং-এ বেরিয়ে পড়েছে। আসতে আসতে কমলা আভা ছড়িয়ে পড়ল গোটা আকাশ জুড়ে। আলো বাড়ল, দিন নেমে এল গঙ্গার বুকে। আরও একটা সূর্যোদয়ের সাক্ষী হলাম। যখনই যেখানে বেড়াতে যাই সূর্যোদয় দেখে আলাদা আলাদা অনুভূতি হয়। নতুন দিনের শুরু হওয়া দেখাটা বার বার নানাভাবে মোটিভেট করে। আমরা ঠিক করেই রেখেছিলাম দুজনে বেরিয়ে পড়ব সকাল সকাল। দশাশ্বমেধ ঘাট বা মনিকর্নিকা ঘাটে সাতসকালে যাওয়ার অনুভূতিটাই আলাদা। হোটেল থেকে বেরিয়েই আবর্জনা ভর্তি রাস্তা। এত নোংরা দেখার অভ্যাস আমাদের নেই। কিন্তু তখন উপায়ও নেই। বিদেশি পর্যটকদের মুখে কাপড় জরিয়ে, নাক চিপে হেঁটে যেতে দেখে খারাপ লাগল। গলিপথ পেরিয়ে দশাশ্বমেধ-এ পৌঁছলাম। এত সকালেও এখানে ভিড়ের কমতি নেই। পুজোআচ্চা, চান, সূর্য নমস্কার সব চলছে। অন্যসময় এখানে এসে ঘাট থেকে ঘাট হেঁটে পেরিয়ে গেছি। এখন পাশের ঘাটে যেতেও রাস্তা ধরতে হচ্ছে। সেখানে জঞ্জাল বেশি, আনন্দ কম। আমরা বেশি সময় না কাটিয়ে হোটেল-এ ফিরে গেলাম।
ব্রেকফাস্ট হোটেল-এই। বৃষ্টিবাদলা হওয়ার ভয়ে ব্রেকফাস্টটা প্যাকেজ-এই নিয়ে রেখেছিলাম। আলুর পরোটা দেবে শুনে মনে হল খেয়ে দেখাই যাক। এক বাটি টক দই, আচার সহযোগে আলুর পুর ভরা পরোটা বেশ লাগল। আমাদের এদিনের প্ল্যান ছিল বিশ্বনাথের অলি-গলি একটু ঘুরে ফিরে অসি ঘাট-এ গিয়ে লাঞ্চ সারার। সেই মতো বেরিয়ে পড়া গেল। এদিকে হোটেল থেকে মদনপুরার দিকে যেতে যে পরিমাণ আবর্জনা পেরোতে হচ্ছিল বেরোনোর ইচ্ছেটাই হারাতে বসেছি। তাই হোটেল থেকে বিশ্বনাথ মন্দিরে যাওয়ার অপেক্ষাকৃত কম অপরিস্কার রাস্তা ধরাই শ্রেয় মনে করলাম। এ রাস্তা বেরোচ্ছে দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে। সেখান থেকে মেইন রোড বেশ খানিক হাঁটা। কিন্তু এ মন্দের ভালো। তবে এদিকের গলির মুখের কাছেই আমরা সন্ধান পেলাম 150 বছরেরও বেশি পুরনো পেঁড়ার দোকান কালিকা মিষ্টান্ন ভান্ডারের। ক্ষীরের লালচে পেঁড়ার স্বাদ অপূর্ব। মালিক-এর পূর্বপুরুষ কাশী বেড়াতে এসে কাশীবাসী হয়ে যান, দোকান শুরু হয়, তারপর বংশ পরম্পরায় চলছে ব্যবসা। ছোট্ট দোকান, একা মানুষ দোকান সামলান। গলি থেকে বেরনোর মুখে রাবড়ি মালাইয়ের দোকান-ও বেশ লোভনীয়। বেনারসে দুধের কোনও ঘাটতি নেই, দু-তিনটে দোকান ছাড়া ছাড়াই দুধে, পনির, ছানা-র দোকান। ইয়া বড় বড় দুধের পাত্র সার সার রাখা। চাঁই চাঁই পনির।
অসি ঘাট গেলাম টোটো-এ চড়ে। ওদিকটায় রাস্তাঘাট পরিষ্কার। গোবর আছে, কিন্তু যেখানে সেখানে আবর্জনার স্তুপ নেই। আমরা ঘাটের কাছে গিয়ে নামলাম। ম্যাপে দেখে নিলাম Pizzeria Vatika Cafe ঘাটের ওপরেই। গলি পেরিয়ে পৌঁছে গিয়ে বসলাম খোলা আকাশের নীচে। খোলা মেলা বসার জায়গা, গঙ্গা দেখা যায় খেতে খেতে। ভেজ ক্যাফে, মেনু কার্ড-পিৎজা, পাস্তা, ব্রেভারেজ, ডেজার্ট-এর সঙ্গে অল্প কিছু ভারতীয় আইটেম-ও আছে। তবে এদের পিৎজার ডিমান্ড-ই বেশি। ক্যাফে-র ম্যানেজার ভদ্রলোক বাঙালি। তার কাছে গল্প শুনলাম এটি 30 বছরেরও বেশি পুরনো দোকান। ভারতের প্রথম পিজারিয়া। সেই তবে থেকেই এনারা ওভেনে থিন ক্রাস্ট পিজা বানিয়ে যাচ্ছেন। বাঙালিটোলায় একটি দোকানের ওনার আমাদের বলে দিয়েছিল পিৎজার পাশাপাশি অবশ্যই Apple pie ট্রাই করতে। তখন দুপুর, আমাদের তেষ্টাও পেয়েছে খুব। ওয়েটার-এর সাজেশন-এ জানতে পারলাম এদের Nana Mint ড্রিংক খুব জনপ্রিয়। সেটা আর একটা জিঞ্জার-এর ড্রিংক অর্ডার করা হল। সঙ্গে মার্গারিটা পিৎজা ও মাশরুম অনিয়ন পিৎজা। পাস্তা থেকে আলিও অলিও-এর লোভ সামলানো গেল না, সেটাও অর্ডার হল। সব কটাই অসাধারণ লাগল। এমন জায়গায় রোজ খেতে পারি আমি। সারপ্রাইজ আরও বাকি ছিল। Apple Pie with icecream খেয়ে মনে হল এর চেয়ে ভাল আগে কখনও খাইনি। অসি ঘাট-এর কাছে এমন অনেক ভালো ভালো ফুড জয়েন্ট আছে। সেগুলো ঘুরে ঘুরে এক্সপ্লোর করার ইচ্ছে থাকলেও সময় ছিল না। বেনারস (Benaras) গেছি কিন্তু নৌকায় চড়ে গঙ্গায় ঘুরব না তা হয় না, তাই সেদিকেই মন দিলাম খাওয়ার লোভ ছেড়ে। অসি থেকে নৌকাতেই হোটেল ফেরা যেত, কিন্তু দাম হাঁকল 1500। অগত্যা ফিরলাম টোটো-তেই। বারাণসীর এদিকটাই মন কাড়লো বেশি।
গঙ্গায় খুব জল, জলে টানও খুব। দাঁড় টানা নৌকায় বেশি দূর যাওয়া যায় না, স্পিড বোট-ই ভরসা। আমাদের হোটেল-এর ঘাটের কাছেই সার সার নৌকো বাঁধা। তাদেরই একজনের সঙ্গে দর-দাম করে নৌকা ঠিক করে রেখেছিলাম সকালে। সে চৌষট্টি ঘাট থেকে আমাদের নিয়ে প্রথমে হরিশচন্দ্র ঘাট হয়ে অসি ঘাটের দিকে যাবে, তার পর অন্যদিকে দশাশ্বমেধ হয়ে মনিকর্নিকা পর্যন্ত যাবে। ফের দশাশ্বমেধ-এর দিকে নৌকা ভিড়িয়ে নৌকা থেকে গঙ্গারতি দেখে আমরা নেমে যাব। প্ল্যান মাফিকই নৌকায় ওঠা হল বিকেল বিকেল। এ ঘাট থেকে ও ঘাট বয়ে যেতে যেতে দেখলাম প্রায় সবই জলের নীচে। ছোট ছোট ছেলেদের সাঁতার, ফটোগ্রাফার-দের সার বেঁধে পোজ, পাখিদের উড়ে যাওয়া, জলের ছলাৎছল ফিরিয়ে দিল সেই চির চেনা বেনারসের স্মৃতি। এত্ত বছরেও এই একটা শহর একেবারে এক থেকে গেছে, গঙ্গার মতোই যেন শুধু বয়ে চলছে তো চলছেই। গঙ্গার এত স্রোত আমরা অসি ঘাট থেকে রাজেন্দ্রপ্রসাদ ঘাট অব্দি নৌকা ভেসে ভেসেই পৌঁছে গেল। সূর্য তখন আকাশে হলুদ কমলা আভা ছড়িয়ে ডুব দেওয়ার পথে। গঙ্গাবক্ষেই সূর্যাস্ত দেখলাম মনিকর্নিকা ঘাটে পৌঁছে। পাশাপাশি জ্বলতে থাকা চিতা, আকাশে মিলিয়ে যাওয়া ধোঁয়ার কুন্ডলী, শেষ বিকেলের গোলাপি হলুদ আলোর ছটা মিলে মিশে অদ্ভুত এক দৃশ্যপট তৈরি করল। সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই ঝুপ করে নেমে এল অন্ধকার।
নৌকা বয়ে চলল দশাশ্বমেধ-এর তীরে। সেখানে গঙ্গারতি দেখার চিরাচরিত ভিড়। পরপর নানা মাপের নৌকা এসে ভিড়েছে। ঘাটে বসার জায়গা কম থাকায় নৌকা থেকেই দেখার দল বেশি। জলের তোরে এক একটা নৌকা একে অপরের গায়ে ধাক্কা জোড়ে ধাক্কা দিয়ে দাঁড়াচ্ছে। মাঝিরা রাশ টেনে বসে আছে। দশাশ্বমেধ-এ মন্ত্রোচ্চারণ, গঙ্গারতি, জলের স্রোতে ভেসে যাওয়া প্রদীপ, মানুষের হর্ষধ্বনি, জলে ছড়িয়ে পড়া চাঁদের আলো ফিরিয়ে দিল চির চেনা বেনারস (Benaras)। আরতি দেখে এত নৌকা পেরিয়ে নামতে গেলে অনেক সময় লেগে যাবে তাই আমরা চৌষট্টি ঘাটে এসেই নামলাম। সেখান থেকে আমাদের সঙ্গীরা গেল পুজো দিতে আর আমরা দুজন রাবড়ি মালাই খেয়ে মন ভরাতে। বিশ্বনাথ গলিতে ঢুকে একটু এগোতেই রাবড়ির বিখ্যাত দোকান। খাদ্যরসিকদের সকলেরই চেনা। ভদ্রলোক কথা বলেন কম। কাজে খুব ফাস্ট। এখানে লস্যি, মালাই দুধ, মালাই, রাবড়ি সবই আমার খুব প্রিয়। বেনারস (Benaras) এসে কাশী বা দিনা চাট ভান্ডারের চাট মিস করা অন্যায়, তাই এদিন রাতে আমাদের ডিনার হল চাট দিয়েই। টম্যাটো চাট, টিকিয়া চাট, পালং পাপড়ি চাট আর কুলফি ফালুদা, জাস্ট জমে গেল।
এবারের এজেন্ডাতে বানারসি আচার, পাঁপড়, আতর এসবও ছিল। দাশগুপ্ত বাবুর পান মশলার দোকান বেনারস (Benaras) বেড়াতে আসা বাঙালিদের মধ্যে খুব জনপ্রিয়। সেখানে যাওয়া আমাদের বাঁধা। দেখা সাক্ষাৎ, কেনাকাটা করার পর জানলাম ওনার কাছে আতরও আছে। কয়েকটা শুঁকে দেখলাম। গন্ধ চড়ার দিকে। ওরই মধ্যে বেল, চন্দনের মতো কয়েকটা ভাল লাগল। একটা গন্ধ শুকলাম খুব দামি, ভালো কিন্তু নাম ভুলেছি। সেখান থেকে না কিনে আরও কয়েকটা জায়গা এক্সপ্লোর করলাম। মনিকর্নিকা ঘাটের গলি ধরে হেঁটে যাওয়ার পথে একটা আতরের দোকানে প্যারাডাইস নামের একটা আতর বেশ মনে ধরল। কিনে ফেললাম। সরদার্জির আচার পাঁপড়ের দোকান থেকে আমলকি, লঙ্কার আচার আর আলুর পাঁপড় নেওয়া হল।
এবার যাওয়ার আর একটা বড় লক্ষ্য ছিল বেনারসি শাড়ি! সে ভেঞ্চার-এ ডাহা শূন্য পেয়ে এসেছি। বেনারস (Benaras) থেকে বেনারসি কেনার অনেক গল্প শুনেছি অনেকের কাছেই। রিসার্চ করে লিস্ট করে নিয়েছিলাম কোথায় কোথায় যাব। দুজন উইভারকে ফোন করেও কথা বলা ছিল। প্রথম দিন গিয়ে ঠিকানা দেখিয়ে কিভাবে যাব জানতে চাওয়াতে হোটেল থেকে দোকান অনেকেই মুখ বেঁকিয়েছে। ‘ও তো মুসলিম এরিয়া, কিঁউ জায়েঙ্গে?’ এসবও শুনতে হয়েছে। রেওরিয়া তালাব এলাকায় এক উইভার-এর বাড়ি রিকশা করে পৌঁছে দেওয়ার সময় রিকশাওয়ালা-ও নিয়ে যেতে চেয়েছে অন্য কোনও ফ্যাক্টরি-তে। স্থানীয় লোকজনের আচার-ব্যবহার মোটেই ভাল লাগেনি। মুসলিম উইভারের ঘরে বসে ভাল শাড়ি দেখার সুযোগও হয়েছে, কিন্তু শাড়ির রেট যে হোলসেল না তা সহজেই বুঝেছি। একটা-দুটো শাড়ি কিনলে হোলসেল রেট-এ না পাওয়াই স্বাভাবিক, কিন্তু দাম কলকাতার মতোই হওয়ায় কিনতে মন চাইল না। কাতান সিল্কের বেনারসী 12000 থেকে শুরু, পছন্দ যা হচ্ছে 15-16 হাজারের কাছাকাছি। অন্য আর একজনকেও ফোন করা ছিল, তার কাছেও জানলাম পিওর বেনারসী 9-10 হাজার পড়বেই। মদনপুরার কাছেই আমাদের হোটেল। সেখানে পপ পর গদি। সে গদিগুলোয় নানান শাড়ি আছে, কিন্তু যে বেনারসী আমি খুঁজেছি তা পাইনি। ফেরার দিন গোলঘর যাওয়ার জন্য একটা বেলা রাখা ছিল। সেখানে কোনও রিকশাই নিয়ে যেতে চায় না। নিয়ে যাবে বলে উঠিয়েও ফ্যাক্টরি নিয়ে যেতে উদ্যত হল একজন! অবশেষে টোটো বুক করে নিজেরা ম্যাপ দেখে সেখানে হাজির হলাম। সেখানেও বিপত্তি। নামতেই বিভিন্ন গদি থেকে এসে ঘিরে ধরল এক এক জন লোক। আমি কোথায় যাব ঠিক করার আগেই তারা আমায় ধরে নিয়ে যেতে চায়। পিছু পিছু ঘোরে। মন্দিরে পুজো দিতে যাওয়ার পরিস্থিতি যে শাড়ি কিনতে গিয়ে হতে পারে তা এখানে না গেলে জানতে পারতাম না। জানা ছিল গদি তে ঠকে যাওয়ার চান্স প্রবল। কিন্তু শাড়ি আমি চিনি, আমায় ঠকান সহজ না। একটা গদিতে ঢুকে বেনারসী দেখতে চাওয়ায় সে পাওয়ার লুমের সিনথেটিক শাড়ি দেখিয়ে পিউর হ্যান্ডলুম বলে দেখাতে শুরু করল। তাকে যত বলি ঠিক জিনিস দেখাতে, সে এটাকেই পিওর বলে বিক্রি করতে উদ্যত। ঠিক তখনই মন উঠে গেল। এত ঠগবাজদের রাজ্য থেকে শাড়ি কিনবই না ঠিক করে ফেললাম। রোদ মাথায় নিয়ে বাঙালিটোলা ফিরে লাঞ্চ সারা হল সেই সুসি ক্যাফে-তে। পর্ক পাওয়া গেল। জাপানি পর্ক সিজলার ডিস মন ভরাল। সঙ্গে রাইস, চিকেন, ভেজ মিলিয়ে জমে গেল খাওয়া।
আমাদের ফেরার ফ্লাইট ছিল রাত সাড়ে 11 টায়। চলে আসার আগে ভাটিকা ক্যাফে কম বেশি টানছিল সবাইকেই। এবার পুরো ট্রিপটায় সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে ওই জায়গাটা। আমরা সাড়ে 5 তা নাগাদ চেকাউট করে হোটেল-এর ঘাট থেকেই উঠে পড়েছিলাম নৌকায়। হোটেল-এর একটা বিষয় খুব ভাল লেগেছিল, চেক-আউট টাইম দুপুর 12 টায় হলেও আমাদের একটা রুম ওনারা দিয়ে রেখেছিলেন লাগেজ রাখা ও ফ্রেশ হওয়ায় জন্য। অসি ঘাট পৌঁছে ঘন্টাখানেক বসেছিলাম পিজারিয়া-য়। Nana mint, Alio Olio আর Apple Pie অর্ডার হয়েছিল। অসি ঘাটের পাশেই anjora বলে একটা বেনারসি বুটিক আছে। পুরোনো বাড়ির একটা ফ্লোর-কে রেনোভেট করে বানানো। আগের দিনও চোখ গিয়েছিল। এদিন একবার দেখে আসতে ইচ্ছে হয়েছিল খুব। দোকানটায় ঢুকে মন ভরে গিয়েছিল। দারুন সব বেনারসী। দামে বেশি কিন্তু এক্সক্লুসিভ। কিনি আর না কিনি মন ও চোখ দুইই জুড়িয়েছিল। আর বুঝেছিলাম এত বড় বুটিকে যদি 15-16 হাজারে পিওর বেনারসী পাওয়া যায় তাহলে সরাসরি উইভারের কাছে তা সস্তা হতে বাধ্য। কিন্তু তেমন উইভার খুঁজে পাওয়া আমাদের হয়ে ওঠেনি। ভাটিকাতে জমিয়ে খেয়ে সঙ্গে করে Apple Pie প্যাক করে নিয়ে রাত আট-টা নাগাদ ওলা ক্যাব-এ উঠলাম। গাড়ি ছুটল এয়ারপোর্ট-এর দিকে।
আর মনে হয় বেনারস যাওয়ার দরকার হবেনা।
আর পাচটা বাঙালীর মত ঘুরতে যাওয়ার নেশা আমার আছে,কিন্তু বেনারস এখনো যাইনি। এই লেখা পরে বেনারসের একটা পরিষ্কার ছবি চোখের সামনে এসে যায়।
ধন্যবাদ। বেনারস-এ একবার দেব দীপাবলি দেখে আসুন। আজীবন মনে রাখার মতো সে ভালোলাগা।